“ঘুম থেকে জেগে দেখি ভবন মারাত্মকভাবে দুলছে। কাঁপাকাঁপি প্রায় তিন থেকে চার মিনিট চলে,” বলেন এক ব্যক্তি।
Published : 28 Mar 2025, 09:49 PM
সন্তানদের নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলেন সিরিনিয়া নাকুতা, হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি শুরু হলে বেশ কিছু সময়েও তা না থামায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন তিনি।
রয়টার্সকে নাকুতা বলেন, “কম্পন থামছিল না। উপরের তোলা থেকে পাথরের মত জিনিস খসে পড়ার শব্দ শুনতে পাই। তখন বাচ্চাদের বলি, আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না, বাইরে চলে যাওয়া উচিত।”
শুক্রবার ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে তীব্র ঝাঁকুনির বর্ণনা দিচ্ছিলেন মিয়ানমারের এই নারী। তিন-চার মিনিট ধরে চলা কম্পনে অনেক ভবন ও স্থাপনা ধসে পড়েছে। মিয়ানমারে এ পর্যন্ত ১৪৪ জনের প্রাণ যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
ভূমিকম্প-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে গত ২০ বছরের মধ্যে এত তীব্র ভূমিকম্প আর দেখা যায়নি। মিয়ানমার জান্তা জরুরি অবস্থা জারি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেছে।
ভূমিকম্পের তীব্রতায় কেঁপে ওঠে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককও। সেখানে নির্মানাধীন একটি বহুতল ভবন ধসে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আরও অন্তত ৮১ জন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে থাইল্যান্ড সরকার বলেছে।
মিয়ানমারের সবথেকে বড় শহর ইয়াঙ্গনের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, কম্পন ছিল বেশ তীব্র। প্রায় চার মিনিট ধরে ঝাঁকুনি চলে।
নাম প্রকাশ না করে আরেক ব্যক্তি ঘটনার বর্ণনায় বলেন, “ঘুম থেকে জেগে দেখি ভবন মারাত্মকভাবে দুলছে। কাঁপাকাঁপি প্রায় তিন থেকে চার মিনিট চলে। বন্ধুদের কাছ থেকে মেসেজ পাচ্ছিলাম। দেখলাম কম্পন শুধু ইয়াঙ্গুন নয়, দেশের অনেক এলাকাতেই হয়েছে।”
মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড ছাড়াও চীন, ভারত ও বাংলাদেশও কেঁপে উঠেছে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ৩০ তলা একটি ভবন পুরোটা ধসে পড়েছে। সেটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ভবন থেকে অনেক দূরে থেকে একজন ভিডিও করছেন। নির্মাণাধীন ভবনটি ধসে পড়ার সময় সেখানকার শ্রমিকরা দৌড়ে সরে আসছেন। অনেক দূর থেকে ভিডিও করা ব্যক্তিও পরে দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। গোটা এলাকা ধুলোয় ঢেকে যায়। ভবনটির ধসে পড়ার ঘটনায় সেখানে ৪৩ শ্রমিক আটকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
থাইল্যান্ডের বাং সু জেলার ডেপুটি পুলিশ প্রধান ওরাপাত সুকথাই বলেন, টাওয়ারটি নিচে পড়া শ্রমিকদের চিৎকার তিনিও শুনেছেন।
“ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর আমি লোকেদের সাহায্যের আর্তনাদ শুনতে পাই। তারা বলছে, সাহায্য করুন। আমাদের অনুমান শত শত মানুষ আহত হয়েছে। তবে আমরা সেই সংখ্যা নির্ধারণ করছি।”
ধ্বংস ও হতাহতের মাত্রা বাড়ায় মিয়ানমারের কর্মকর্তারা নেপিদো জেনারেল হাসপাতাল ঘিরে ‘বড় হতাহত এলাকা’ ঘোষণা করেছে। হাসপাতালের বাইরে বেডে আহতদের রাখা হয়েছে।
ভূমিকম্পের কারণে ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন করেছে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে দেশের ক্ষমতা দখলে নেওয়া মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
নেপিদোর হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন জান্তার সরকারের প্রধান মিং অং হ্লাইং। বিদেশি সাহায্য কামনা করে তিনি বলেছেন, “যতদ্রুত সম্ভব মানবিক সাহায্য চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে।”
বিবিসি লিখেছে, সেনাশাসিত মিয়ানমারে তথ্য অধিকার সীমিত। ইন্টারনেট ব্যবহারও সীমিত। যোগাযোগ ব্যবস্থাও সীমিত বলে মনে হচ্ছে। কারণ মাঠ পর্যায়ের সাহায্য সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না বিবিসি।
ভূমিকম্পের পর ব্যাংককে মেট্রো ও রেল সেবা স্থগিত করা হয়েছে। সুজসান্না ভারি-কোভাকস নামে একজন বলেন, “রেস্তোরাঁয় আমি বিলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেসময় কম্পন বুঝতে পারি। প্রথমে মনে করেছিলাম, শুধুই আমার কাছেই এমন মনে হচ্ছে। তারপর দেখি সবাই তাকিয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ আমরা বাইরে দৌড়ে বের হয়ে যাই।”
ডেবোরা পুনমাসেট যখন তার ফোন চেক করছিলেন, ঠিক তখনই তার চেয়ারটি হঠাৎ উল্টে যায়। তিনি বলেন, একটি ‘আর্ম-চেয়ারে’ ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ সেটি এদিক-সেদিক নড়তে থাকে এবং তারপর উল্টে যায়। এতে টেবিলের সঙ্গে আমার মাথা গিয়ে লাগে।”
ব্যাংককে বিবিসির সাংবাদিক বুই থু বলেন, এক দশকের মধ্যে এমন শক্তিশালী ভূমিকম্প দেখল ব্যাংকক।
অপরদিকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বড় শহর মান্দালয়ে ধ্বংসাবশেষের ছবি ও ভিডিও এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রয়্যাল প্যালেস, ৯০ বছরের পুরনো ব্রিজ ধসে পড়ার পাশাপাশি আর মহাসড়কও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস একটি ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করে বলছে, মিয়ানমারে ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাণহানি হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন-