আল-কায়েদার সামনে এখন কী?

জাওয়াহিরির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হুমকিও শেষ হয়ে যাবে মনে করলে, তা হবে নির্বোধের মত ভাবনা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2022, 03:26 AM
Updated : 4 August 2022, 03:26 AM

একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও গত সপ্তাহে হঠাৎ আক্রমণে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির মৃত্যুর ঘটনায় অবধারিত যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হল- আন্তর্জাতিক এই জঙ্গি সংগঠনটির সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে?

বস্তুত, আল-কায়েদার অবস্থা এখন কী এবং ২০২২ সালে এসে আদৌ এর প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

আরবি শব্দ আল-কায়েদার অর্থ ‘ঘাঁটি’। নিষিদ্ধ এই সংগঠনটি বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এ ছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার পশ্চিমা-ঘেঁষা দেশগুলোর সরকার পতনেও তাদের তৎপরতা দেখা গেছে।

১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে আফগানিস্তানে যাওয়া একদল আরব মুজাহিদের হাত ধরে আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে গড়ে ওঠে আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক। মাত্র এক প্রজন্ম আগেও আল-কায়েদা ছিল সারা বিশ্বে ঘরে ঘরে পরিচিত একটি নাম, যাদের ‘এক নম্বর হুমকি’ হিসাবে বিবেচনা করত পশ্চিমা দেশগুলো।

কেন এই আতঙ্ক? কারণ সে সময় একের পর এক শক্তিশালী, জটিল আক্রমণ চালিয়ে সফল হচ্ছিল আল-কায়েদা। আর তাদের সেই সাফল্য আরও বেশি উগ্রবাদীদের এ সংগঠনে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করছিল।

১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে পর পর বোমা হামলা চালিয়েছিল আল-কায়েদা, তাতে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই আফ্রিকার নাগরিক।

২০০০ সালে বিস্ফোরকবাহী একটি স্পিডবোট দিয়ে ইয়েমেনের এডেন বন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল বিধ্বংসী জাহাজে হামলা চালিয়ে ১৭ নাবিককে হত্যা করে আল-কায়েদা। ওই ঘটনায় বিলিয়ন ডলারের মার্কিন যুদ্ধজাহাজটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের এক সুন্দর রোদেলা সকালে এই বিশ্ব চিরতরে পাল্টে যায়।

কয়েক মাস ধরে গোপন পরিকল্পনার পর আল-কায়েদা মাঝ আকাশে চারটি বেসামরিক উড়োজাহাজ ছিনতাই করে, যার মধ্যে দুটি নিউ ইয়র্কের আইকনিক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে। ভয়াবহ ওই হামলায় গগণচুম্বী ভবন দুটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

ছিনতাই হওয়া আরেকটি উড়োজাহাজ পেন্টাগনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগে বিধ্বস্ত হয়। চতুর্থ উড়োজাহাজটির যাত্রীরা ছিনতাকারীদের ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেটি বিধ্বস্ত হয় এবং উড়োজাহাজে থাকা সবাই মারা যান।

সেদিন সব মিলিয়ে ৩ হাজারের মত মানুষ নিহত হয়। বিশ্ব কাঁপানো ওই সন্ত্রাসী হামলা মার্কিন ক্যালেন্ডারে নবম মাসের ১১তম দিনে ঘটেছিল, সে কারণে তা ৯/১১ নামে পরিচিত পায়। যে কোনো বিচারে সেটা ছিল আমেরিকার মাটিতে জঘন্যতম হামলা, যার ফল হিসেবে দুই দশকের বিতর্কিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ পথে হাঁটে যুক্তরাষ্ট্র।

৯/১১ এর পরিকল্পনা হয়েছিল আফগানিস্তানের পার্বত্য এলাকায় আল-কায়েদার ঘাঁটি থেকে, যেখানে তারা তালেবানের আশ্রয়ে ছিল। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তানে আক্রমণ করে এবং তালেবানদের সরিয়ে আল-কায়েদাকে উৎখাত করে।

সেই প্রতিশোধ পর্বে আল-কায়েদার সর্বোচ্চ নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের আরও এক দশক সময় লেগেছিল। ২০১১ সালের মে মাসে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন কমান্ডো হামলায় নিহত হন তিনি।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিন লাদেনের মৃত্যুর আল-কায়েদায় কী বিবর্তন ঘটেছিল? আর এখন, আল-কায়েদার সর্বোচ্চ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি নিহত হওয়ার পর এ জঙ্গি সংগঠন কোন অবস্থায় আছে?

শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন এবং নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী

ওসামা বিন লাদেনের পর খুব দ্রুত আল-কায়েদার সর্বোচ্চ আসনে বসেন তার বয়স্ক উপদেষ্টা, তত্ত্ববাগিশ, চশমাধারী আয়মান আল জাওয়াহিরি, যিনি রোববার সিআইএ এর ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন।

উগ্র আর সহিংস তরুণ জঙ্গিরা বিন লাদেনের মাঝে যে ক্যারিশমাটিক নেতার দেখা পেয়েছিল, আল-কায়েদায় ১১ বছরের নেতৃত্বে তার ধারেকাছেও যেতে পারেননি মিশরের সাবেক চক্ষু চিকিৎসক জাওয়াহিরি।

তার রেকর্ড করা ভিডিও বার্তাগুলো সবসময় পশ্চিম ও তাদের মিত্রদের উপর আক্রমণের আহ্বান জানিয়ে গেছে, এক পর্যায়ে হয়ে উঠেছে একঘেয়ে, ‘আবেদনহীন’।

এদিকে ততদিনে সিরিয়া আর ইরাকের মাটি থেকে অতি উগ্রপন্থি আরেকটি সন্ত্রাসী দল দ্রুত ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করতে করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে, যারা নিজেদের পরিচয় দেয় ইসলামিক স্টেট বা আইএসআইএস নামে। সেই সংগঠনের উত্থানে পিছু হটতে থাকে আল–কায়েদা।

আইএস এর তরুণ জিহাদিরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন হামলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকছিল; তারা আল-কায়েদার নেতৃত্ব নিয়ে উপহাস করতে ছাড়ছিল না। তাদের ভাষ্য ছিল, আল-কায়েদা কেবল বকবক করে, আর আইএস আসল কাজটি করে দেখায়।

বদলে গেছে গোয়েন্দাদের দুনিয়া

৯/১১ হামলা ছিল মার্কিন গোয়েন্দাদের জন্য বিশাল এক ব্যর্থতার নাম। হামলার ক্লুগুলো ধরতে ওয়াশিংটন ব্যর্থ হয়েছিল। তবে আল-কায়েদা সেই হামলায় এতটা সাফল্য পেয়েছিল অংশত আরেকটি কারণে, সেটা হল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তখন এফবিআইয়ের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করত না।

এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মার্কিন ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন জঙ্গি কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক বেশি অবগত। সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা করে। আর আল-কায়েদা ও আইএসআইএসের ভেতর নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিতে পারা মানে হল, সন্ত্রাসী হামলাগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনা কমে যাবে।

আফগানিস্তানই আশ্রয়?

দুই দশকের যুদ্ধের পর আফগানিস্তান থেকে গত বছর সব সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে পশ্চিমারা। ফলে আফগানিস্তান আবারও আল-কায়েদার জন্য নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাস্তবতা হল, কাবুলের ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ তালেবান নেতৃত্বের ছায়াতলে খুব আয়েশেই ছিলেন আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি। এর মানে হল, চরমপন্থি জিহাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ‍ভাঙার কোনো ইচ্ছে তালেবানের নেই।

তাছাড়া আল-কায়েদার জন্য অন্য কারণেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান।

জনশ্রুতি আছে, সম্পদশালী তরুণ ওসামা বিন লাদেন ১৯৮০ এর দশকে পরিবার থেকে পাওয়া গুহা কমপ্লেক্স তৈরির প্রকৌশল দক্ষতা নিয়ে আফগানিস্তানে এসেছিলেন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়তে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি তালেবানের আশ্রয়ে সেখানে ছিলেন। আর এখানেই আল-কায়েদা তাদের উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেহেতু পুরনো বন্ধু তালেবানই ফের ক্ষমতায় এসেছে।

নতুন যুদ্ধক্ষেত্র আফ্রিকা

আল-কায়েদা এক সময় ভৌগলিকভাবে ছোট এলাকায় সীমিত এবং কেন্দ্রীভূত সংগঠন ছিল, কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রণহীন ও দুর্বল শাসনের দেশগুলোতে নিজেদের উপস্থিতি বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। যেমন- সোমালিয়ায় আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন ‘আল-শাবাব’ এর জিহাদি গোষ্ঠী রয়েছে।

আফ্রিকা, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার সাহেলের আশেপাশের এলাকাগুলো আল-কায়েদা ও আইএসআইএস- এর মত জিহাদি গোষ্ঠীর জন্য নতুন চারণক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা কেবল তাদের বিরুদ্ধ মতের সরকারের বিরুদ্ধেই লড়াই করছে না, তারা একে অপরের সঙ্গেও যুদ্ধ করছে এবং সেই ক্রসফায়ারে পড়ে প্রাণ যাচ্ছে বেসামরিক মানুষে।

মধ্যপ্রাচ্য

মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে আল-কায়েদা। বিন লাদেন ছিলেন সৌদি আরবের, আল-জাওয়াহিরি মিশরের। দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের প্রায় সবাই আরবের। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় এ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে মার্কিন ড্রোন এবং বিশেষ বাহিনীগুলো একের পর এক সন্দেহভাজন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

আল-জাওয়াহিরির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আল-কায়েদা এখন নতুন নেতা এবং নতুন কৌশল নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। শীর্ষ নেতার মৃত্যুর সঙ্গে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের হুমকিও শেষ হয়ে যাবে- এমনটি যদি কোনো গোয়েন্দা সংস্থা মনে করে, তবে সেটি হবে নির্বোধের মত ভাবনা।

পুরনো খবর

Also Read: জাওয়াহিরি: দুর্গম পাহাড়ে ছিলেন অধরা, মৃত্যু কাবুলের বিলাসী জীবনে এসে

Also Read: যেভাবে জাওয়াহিরিকে খুঁজে বের করে হত্যা করল সিআইএ

Also Read: ক্ষেপণাস্ত্রে জাওয়াহিরি মরলেও স্ত্রী, কন্যা অক্ষত যেভাবে

Also Read: জাওয়াহিরিকে হত্যার খবর স্বাগত জানাল সৌদি আরব

Also Read: আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি মার্কিন হামলায় নিহত