ক্ষেপণাস্ত্রে জাওয়াহিরি মরলেও স্ত্রী, কন্যা অক্ষত যেভাবে

জাওয়াহিরির নিয়মিত বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাসই তার কাল হয়েছে। হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র সুনির্দিষ্টভাবে ওই বারান্দাতেই আঘাত হেনেছে। বাড়ির বাকি অংশ থেকেছে মোটামুটি অক্ষত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2022, 10:08 AM
Updated : 3 August 2022, 10:08 AM

অন্যান্য দিনের মতো গত ৩১ জুলাইও সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক পর কাবুলের শহরতলির বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ান দীর্ঘদিন ধরে আল-কায়েদাকে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া আয়মান আল-জাওয়াহিরি।

বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিশরীয় এ জিহাদি যে ফজরের নামাজের পর বারান্দায় যেতে পছন্দ করতেন তার খবর আগেই মিলেছিল। কালও হল সেটিই।

বিবিসি জানিয়েছে, রোববার মৃত্যুর আগে সর্বশেষ তিনি ওই বারান্দাতেই যেতে পেরেছিলেন; যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ক্ষেপণাস্ত্র স্থানীয় সময় সকাল ৬টা ১৮ মিনিটের দিকে বারান্দাতে আঘাত হানলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আল-কায়েদার ৭১ বছর বয়সী শীর্ষ নেতা। অথচ ঘরের ভেতরে থাকা তার স্ত্রী ও কন্যা থেকে যান অক্ষত।

ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা ও ছবিতে মনে হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্র দুটি ক্ষতি যা করার তা কেবল ওই বারান্দারই করেছে।

কীভাবে এত নিখুঁত হামলা করা গেল?

অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রায়ই লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে, কখনো কখনো ভুল টার্গেটে মেরে বিপুল বেসামরিক হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কিন্তু এবার ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন আর জাওয়াহিরির দৈনন্দিন অভ্যাস নিয়ে নিবিড় অধ্যয়নের পর হামলা হয়েছে। জাওয়াহিরি মারা গেছে, আর কারও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই সফলতা ভবিষ্যতে এমন হামলার সম্ভাবনাও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

লেজারের কেরামতি

নিখুঁত হামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র বেছে নেওয়া।

জাওয়াহিরিকে হত্যায় ড্রোন থেকে ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয় বলে মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে।

এই ‘হেলফায়ার’ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য; ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার হামলার পর এই ক্ষেপণাস্ত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানে নিয়মিত ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে।

হেলিকপ্টার, স্থলে চলা যান, জাহাজ, বিমান, মনুষ্যবিহীন ড্রোনসহ নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া যায়।

২০১৫ সালে সিরিয়ায় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি ‘জিহাদি জন’ এবং ২০২০ সালের শুরুর দিকে বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেমানিকেি হত্যায়ও এই ‘হেলফায়ার্’ই ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

বারবার এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে হামলার সক্ষমতা।

ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগে ড্রোনটির পরিচালক লাইভ ভিডিও স্ট্রিম দেখে ‘টার্গেটের’ অবস্থান নিশ্চিত হয়ে নেন; ড্রোনের ক্যামেরা উপগ্রহের মাধ্যমে ওই ভিডিও পাঠায়।

দূরে, কখনো কখনো এমনকী যুক্তরাষ্ট্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে থাকা ড্রোন পরিচালক, সেই ভিডিও থেকে লক্ষ্যের অবস্থান ঠিক করে তার দিকে লেজার তাক করে দেন। ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়ার পর সেটি ওই লেজারের পথ অনুসরণ করে লক্ষ্যে আঘাত হানে।

তবে সেই ‘সুইচ’ টিপে দেওয়ার আগে ড্রোন পরিচালনাকারী ক্রুকে বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি কমাতে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।

অতীতে মার্কিন সামরিক বাহিনী বা সিআইএ-কে হামলায় যেতে হলে যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সামরিক আইনজীবীকে ডেকে তার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। তারপরই দেওয়া হতো হামলার নির্দেশ।

জাওয়াহিরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র হেলফায়ারের স্বল্প পরিচিত সংস্করণ ‘আর৯এক্স’ ব্যবহার করেছে বলেও ইঙ্গিত মিলেছে। গতিশক্তি ব্যবহার করে ‘টার্গেটকে’ ফালি ফালি করে কাটতে এতে ছয়টি ব্লেড থাকে বলেও জানা গেছে।

২০১৭ সালে সিরিয়ায় আল-কায়েদার আরেক নেতা, জাওয়াহিরির সহকারী আবু খায়ের অল-মাসরিকে হত্যায়ও এ ‘আর৯এক্স’ হেলফায়ার ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ধরা পড়েছিল জাওয়াহিরির ‘বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাস’

কাবুলে জাওয়াহিরির ওপর হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছিল, তার কিছু কিছু সবেমাত্র প্রকাশিত হতে শুরু করেছে।

আল-কায়েদা নেতার ওপর হামলার পর মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, নিয়মিত বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাস ছাড়াও ঘরের ভেতর জাওয়াহিরির জীবনচক্র বিষয়ে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল।

এতেই বোঝা যায়, মার্কিন কর্মকর্তারা জাওয়াহিরির বাড়ির ওপর কয়েক মাস না হলেও অন্তত কয়েক সপ্তাহ ধরে নজর রেখেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামলার আগে নানামাত্রিক পদ্ধতিতে তথ্য নেওয়া হয়েছিল বলেই ধারণা করা হচ্ছে। নিচে থেকে ধারণা পাওয়া যায় না এমন দূরত্ব থেকে মার্কিন ড্রোন বা এয়ারক্রাফটগুলোও কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে হামলার স্থানটির ওপর নজর রেখেছে বলে অনেকের অনুমান।

এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেে আল-কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের খোঁজ বের করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাও।

তবে এর আগে এই ধরনের অনেক হামলাই পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। গত বছর অগাস্টের শেষদিকে কাবুল বিমানবন্দরে উত্তরে একটি গাড়িতে ড্রোন হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তাদের উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় শাখার একজনকে হত্যা করা। তার বদলে নিষ্পাপ ১০ জন মারা পড়ে। পেন্টাগন পরে ওই হামলাকে ‘বেদনাদায়ক ভুল’ বলে স্বীকারও করে নেয়।

কাছাকাছি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি না থাকায় জাওয়াহিরির ওপর হামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের আগের হামলাগুলোর তুলনায় ‘একটু জটিল ছিল’ বলে মনে করেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো বিল রোজিও।

আগে যেমন পাকিস্তানে ড্রোন হামলার সময় সেগুলো আফগানিস্তান থেকে উড়ে যেত, সিরিয়ায় হামলা চালানো যেত ইরাক থেকে; গত বছর তালেবানের হাতে ছেড়ে আসার পর আফগানিস্তান বা তার আশপাশে সেরকমটা করা যাচ্ছে না।

“যুক্তরাষ্ট্র দেশটি ছেড়ে আসার পর এটা আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার বিরুদ্ধে প্রথম হামলা। এটা মোটেও সাধারণ ঘটনা নয়,” বলেছেন তিনি।

এরকম আরও ঘটবে?

আফগানিস্তানে আল-কায়েদার নেতাদের ওপর এ ধরনের আরও হামলা হলে ‘বিস্মিত হবেন না’ বলে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের এ জ্যেষ্ঠ ফেলো।

“এখন আফগানিস্তনে যদি নাও থাকেন, তাহলেও আল-কায়েদার সম্ভাব্য পরবর্তী নেতারা খুব সম্ভবত আফগানিস্তানেই যাবেন।

“প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কী খুব সহজে এই ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা থেকে যাবে, নাকি তাদেরকে জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে?,” জিজ্ঞাসা রোজিওর।