জাওয়াহিরি: দুর্গম পাহাড়ে ছিলেন অধরা, মৃত্যু কাবুলের বিলাসী জীবনে এসে

আল কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি গোয়েন্দাদের চোখে ধুলা দিয়ে বছরের পর বছর আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে কাটালেও তার জীবনের শেষ দিনগুলো বিলাসিতায় কেটেছে কাবুলের অভিজাত এলাকায়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2022, 03:46 AM
Updated : 3 August 2022, 03:46 AM

গোয়েন্দাদের চোখে ধুলা দিয়ে বছরের পর বছর আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলেন জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি। পাহাড়ের ওই কঠিন পরিবেশ ছেড়ে জীবনের শেষ ক’টি মাসে তিনি রাজধানী কাবুলের কাছে এক অভিজাত এলাকায় থাকতে শুরু করেছিলেন, যেখানে থাকেন তালেবানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও।

আর সেটাই যেন জাওয়াহিরির জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দ‍াদের নজরে পড়ে যান এবং তাকে হত্যা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, গত রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন থেকে ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ৭১ বছরের জাওয়াহিরিকে হত্যা করা হয়। এ আল-কায়দা নেতা কাবুলে নিজ বাড়ির বারান্দায় হামলার শিকার হন।

তবে এতে কোনও বেসামরিক নাগরিক মারা যাননি বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তালেবানও নিশ্চিত করে বলেছে, কাবুলের শেরপুর এলাকার আবাসিক ভবনে হামলা হলেও কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

গত বছর তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের কয়েকমাস পরই জাওয়াহিরিকে ‘খুব নিরাপদ একটি স্থানে’ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল- মঙ্গলবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে এমন কথাই জানিয়েছেন তালেবানের এক জ্যোষ্ঠ নেতা।

তার ওপর হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক নীতির’ লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

জাওয়াহিরি হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত জানতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স থেকে তালেবানের দুই মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাওয়াহিরি যে বাড়িতে ছিলেন তার কিছু ছবি ছড়িয়েছে। যদিও ওই ছবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন রয়টার্স। ছবিগুলোতে গোলাপি রঙের একটি ভবনের কয়েকটি জানালা ভাঙা দেখা যাচ্ছে। বাড়িটি তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা এবং বেড়ার উপর কাঁটাতার মোড়ানো। দুই বা তিন তলা ভবনের চারপাশে অনেক গাছগাছালি।

জাওয়াহিরি যে বাড়িতে থাকতেন সেটি কাবুলের শহরতলি শেরপুরে অবস্থিত। অভিজাত এলাকা শেরপুর অনেক নিরিবিলি, অনেক সবুজ এবং সেখানে বড় বড় ভবন রয়েছে। আফগানিস্তানের সাবেক জেনারেল এবং আদিবাসী উজবেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আব্দুল রশিদ দোস্তাম সেখানে বাস করতেন। তালেবানের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ওই এলাকায় বাস করেন। সেখানে কিছু কিছু বাড়িতে বাগান এবং সুইমিংপুলও রয়েছে।

Also Read: আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি মার্কিন হামলায় নিহত

Also Read: যেভাবে জাওয়াহিরিকে খুঁজে বের করে হত্যা করল সিআইএ

Also Read: আয়মান আল-জাওয়াহিরি: কায়রোর চিকিৎসক থেকে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা

জাওয়াহিরির বাড়ির কাছেই বাস করেন এমন এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন, রোববার বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার পর তিনি এবং তার নয় সদস্যের পরিবার তাদের বাড়ির সুরক্ষিত গোপনকক্ষে আশ্রয় নেন।

পরে যখন তিনি বাড়ির ছাদে যান তখন তিনি কোনও ধরনের হৈচৈ বা বিশৃঙ্খলা দেখতে পাননি। তিনি বুঝতে পারেন, কোথাও রকেট বা বোমা হামলা হয়েছে। কাবুলে এমনটা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়।

তালেবানের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী তালেবান সরকারকে উৎখাত করার পর থেকে জাওয়াহিরি বেশিরভাগ সময় আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের মুসা কালা জেলার পাহাড়গুলোতে থাকতেন।

তিনি সেখানে নিজেকে খানিক আড়ালেই রাখতেন। তবে ওই সময়ে বেশ কয়েকবার জাওয়াহিরি পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যাতায়াত করেছেন বলেও জানান ওই তালেবান নেতা।

জাওয়াহিরির পাকিস্তান যাতায়াত নিয়ে প্রশ্ন করতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তালেবানের আরও কয়েকজন নেতা রয়টার্সকে বলেন, তালেবান প্রশাসন কাবুলে জাওয়াহিরিকে ‘উচ্চ-পর্যায়ের নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছিল’। তবে সেখানে তিনি খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না এবং কোথাও যেতে হলে তাকে তালেবানের অনুমতি নিতে হত।

কাবুলের একজন পুলিশ কর্মকর্তা শেরপুরকে রাজধানীর সবচেয়ে ‘নিরাপদ এবং সুরক্ষিত শহরতলি’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, এ কারণেই সেখানে ড্রোন হামলার খবর শুনে তিনি ‘খুবই হতবাক’ হয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই এবং আশরাফ গনির সাবেক সরকার শেরপুরে বড় বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন। সেগুলোতে এখন তালেবানের শীর্ষ নেতা এবং তাদের পরিবার বাস করে।

আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার নেতৃত্ব পেয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেনের কাছ থেকে, যদিও তার বহু বছর আগে থেকেই তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক এ জঙ্গি সংগঠনের প্রধান সংগঠক, কৌশলবিদ এবং আধ্যাত্মিক নেতা।

মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেছেন, জাওয়াহিরির পরিবার- তার স্ত্রী, মেয়ে এবং নাতি-নাতনিরা কাবুলের একটি বাড়িতে গিয়ে উঠেছে বলে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। পরে তারা ওই একই জায়গায় জাওয়াহিরি আছেন বলেও শনাক্ত করতে পারেন।

জাওয়াহিরি ওই বাড়ি ছেড়ে গেছেন বলে কখনও শোনেননি বা জানতেন না কর্মকর্তারা। বরং তারা বেশ কয়েকবারই বাড়ির বারান্দায় জওয়াহিরিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। আর সেই বারান্দা থেকেই শেষ পর্যন্ত জাওয়াহিরিকে শেষ বিদায় নিতে হয়।