আরিফ ভোটে থাকছেন? ‘চমকের’ অপেক্ষায় সিলেট

“নির্বাচন না করলে কেন উনি জনসভা করে, লোক জমায়েত করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। জনসভা করে সিদ্ধান্ত জানানোর মানে কী,” বলছেন এক বিএনপি নেতা।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2023, 04:49 PM
Updated : 19 May 2023, 04:49 PM

সবকিছু ঠিক থাকলে শনিবার দুপুরে জনসমাবেশের মাধ্যমে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, যা নিয়ে গত প্রায় এক মাস ধরে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ‘ধোঁয়াশা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব’ কাজ করছে।

আরিফ প্রার্থিতার ব্যাপারে কী ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন- এ নিয়ে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির তিনজন এবং দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হলে মিশ্র ধারণা পাওয়া গেছে।

জল্পনা-কল্পনার মধ্যে আরিফ শুক্রবার বিকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সিলেটে এক সমাবেশে স্পষ্ট করেই বলেছেন, তার দল যে নির্বাচনে যাচ্ছে না। তবে নিজের প্রার্থিতার ব্যাপারে আগের মতই তিনি কৌশলী ছিলেন; খোলাসা করেননি কিছু। ফলে অপেক্ষার পালা শনিবার দুপুর পর্যন্ত গড়াচ্ছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন জ্যেষ্ঠ নেতা শুক্রবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবশ্যই নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে মেয়র আরিফকে নিয়ে। শনিবার চমক দেবেন তিনি।“

ওই নেতা আরও বলেন, “নির্বাচনের বিষয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট। নির্বাচনে অংশ নিলে দল তাকে আজীবন বহিষ্কারের চিঠি দিতেও বিলম্ব করবে না। কারণ সিটি নির্বাচনে বিএনপি বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।“

তবে সিলেট মহানগর বিএনপির একজন নেতা বলেন, “নির্বাচন না করলে আরিফ নির্বাচনকেন্দ্রিক এত কথাবার্তা বলতেন না। দেশের বাকি চার সিটি করপোরেশনে তো বিএনপির প্রার্থী নিয়ে এত আলোচনা নেই; কিন্তু সিলেটে বর্তমান মেয়র আলোচনায় রয়েছেন।

“আর উনি ২০ মে নগরীর রেজিস্ট্রি মাঠে জনসভা করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছেন। নির্বাচন না করলে কেন উনি জনসভা করে, লোক জমায়েত করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। জনসভা করে সিদ্ধান্ত জানানোর মানে কী? মানে হল– ‘নির্বাচন করছি’। আমার কাছে এটাই মনে হয়।“  

বিএনপির এই নেতা তার ধারণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, “আরিফ গত একমাস ধরে দলের নেতাকর্মী শুধু না, প্রতিটি মহল্লার পঞ্চায়েত প্রধান, মুরুব্বি, সামাজিক সংগঠন, দলের ওয়ার্ড কমিটির নেতা, নিজের শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে নিবিড়ভাবে কথা বলেছেন।

“লন্ডনে গেছেন। ঢাকায় শুধু দলের কেন্দ্রীয় নেতা না, সিলেটের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। শনিবারের জনসভায় আসতে এলাকাবাসীকে দাওয়াত দিয়েছেন। এই প্রস্তুতি নির্বাচনে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে।”

তার ভাষায়, আরিফ নির্বাচনে এলে সেটা ‘চমক’ হবে, না এলেও।

সিলেট জেলা বিএনপির আরেকজন নেতা বলেন, আরিফের সমাবেশে জেলা ও মহানগর বিএনপির মূল নেতৃত্ব সম্ভবত যাবে না, তেমনটাই তারা শুনছেন।

“তিনি যদি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিতেন, তাহলে তো সেটা দলের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করা হত। তাহলে সেখানে তো দলের নেতাদের থাকার কথা। দলের নেতাদের সেখানে না যাওয়ার মানে কী? আরিফ নির্বাচনে যাচ্ছেন, এজন্য তার সঙ্গে যাবেন না?”

শুক্রবার দুপুরেও সিলেট নগরীর ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমা শেষে মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আরিফুল হক চৌধুরী। এ সময় তিনি এলাকার উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ফিরিস্তি দেন তাদের কাছে।

তিনি বলেন, “আমি সবসময় সিলেটের জনগণের পাশে ছিলাম, যে অবস্থানেই থাকি না কেন প্রিয় সিলেটের জনগণের পাশেই থাকব।” 

২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী বদর উদ্দিন কামরান ২০০৮ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও কারাগার থেকে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল থেকে মেয়র পদে আছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী।

২১ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তখন থেকেই দুইবারের মেয়র আরিফের প্রার্থিতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়।

আরিফ সরাসরি কখনই এ ব্যাপারে কিছু না বললেও কিছু কাথাবার্তায় মানুষ ভেবে নেয়, তিনি হয়ত ভোট ছাড়বেন না।

মে মাসের শুরু থেকে সিলেটে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয় বলে দলটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ। ফলে তার পর থেকে সিলেট বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর নির্বাচনের মাঠে থাকার ব্যাপারে কিছুটা চাপে পড়ে যান আরিফ।

এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ করে মেয়রের বাসার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা ছয় জন আনসার সদস্যকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন সামনে রেখে ‘নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে ছবি তুলছেন, রাতের বেলা তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের অতি-উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা এমন একজন জনপ্রতিনিধিকে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয় সেটিও সম্ভবত ভুলে গেছেন। আমি দেখছি, আমার নগরবাসী থেকে আমাকে দূরে রাখার সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি নগরবাসীর কাছে দোয়া চাই।“

তিনি বলেন, “আমাকে যদি নির্বাচন করতে হয়, তবে দল ছাড়তে হবে; দলের আদর্শ থেকে সরে আসতে হবে। আর দল করতে হলে নির্বাচন ত্যাগ করতে হবে।“

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চারবারের কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান লোদী ওরফে কয়েস লোদী। তারপর আরিফের প্রার্থিতা নিয়ে নগরীতে জল্পনা-কল্পনা আরও জোর পায়।

এদিকে আরিফের সমর্থকরা রেজিস্ট্রি মাঠের জমায়েতের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছেন। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এলেও বিএনপির জেলা বা মহানগরের নেতারা সেখানে উপস্থিত থাকবেন না বলে জানা যাচ্ছে।

আরিফ ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাগরিক কমিটির ব্যানারেই এই সমাবেশ হবে। সেখানে আরিফের ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতারা কেউ কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন। 

শুক্রবার বিকালে সেখানে মঞ্চ তৈরির জন্য শ্রমিকরা গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ করেন আরিফের সমর্থকরা। খবর পেয়ে অনুসারীদের নিয়ে মাঠের সামনে যান আরিফ। তিনি ফটকে একটি চেয়ারে বসে পড়েন এবং মঞ্চ তৈরির জন্য পুলিশ বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। পরে অবশ্য পুলিশ এসে মঞ্চ তৈরির অনুমতি দেয়। তারপর শ্রমিকরা কাজ শুরু করেন।  

তবে আরিফ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ এক নেতা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আরিফুল হক চৌধুরী দলের নীতি-নির্ধারণীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বার বার কথা বলেছেন। তাকে দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

রাতে কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক জ্যেষ্ঠ সদস্য বলেন, “সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনও আরিফ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন। কারণ, স্থানীয় ভোটারের অনেকে চায় তিনি যেন নির্বাচন করেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় তার সমর্থক রয়েছে। ফলে কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তার বিষয়।”

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে ৩৫ বছরের সম্পর্ক তার রাজনৈতিক সহকর্মী সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহ আহমদ খসরুর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার প্রত্যাশা বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। কারণ তিনি তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন রাজনীতিবিদ। বিএনপি ছাড়ার মানুষ তিনি না।”

সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, “দল নির্বাচনে যাচ্ছে না। আরিফুল হক চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির মানুষ, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও তিনি। ফলে তিনি নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল সিদ্ধান্তই নেবেন।”

মেয়র আরিফুলের নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, “সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে যত বড় নেতা হোন না কেন; কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে দলের উচ্চ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছে।”

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২৩ মে এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। মনোনয়নপত্র বাছাই ২৫ মে ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১ জুন।

 

আরও পড়ুন:

সিলেট সিটি নির্বাচনে অংশ না নিতে বিএনপি নেতাকর্মীদের চিঠি  

মেয়র আরিফের ঢাকা সফর, সিলেটে গুঞ্জন  

সিলেট বিএনপির নেতাদের ঢাকায় বৈঠক, ২৫ ‘প্রার্থীর’ নাম কেন্দ্রে  

সিলেটে ভোট করার ইঙ্গিত বিএনপির আরিফের  

ভোটে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে ৩ সপ্তাহ সময় চাইলেন আরিফ  

মেয়র আরিফকে নিয়ে শোভাযাত্রা; বললেন, ‘মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করব’  

লন্ডন থেকে ‘সিগন্যাল’ নিয়ে ফিরছেন মেয়র আরিফ