“হঠাৎ বাসটি ছিটকাইয়া রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে ডুবে যায়; এরপর আব্বারে আর পাই না”, বলে ছেলে মাহাদি।
Published : 22 Jul 2023, 11:38 PM
ঝালকাঠি সদর উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে নিহত বাস যাত্রীদের ১৭ জনের মধ্যে আটজনই পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার। তাদের মরদেহ এরই মধ্যে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শনিবার সকালে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বিকালে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ সবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় বলে জানান ভাণ্ডারিয়া থানার ওসি আশিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, এর মধ্যে একই পরিবারের একাধিক সদস্য রয়েছেন। এসব পরিবারের শোক বিরাজ করছে। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা চিকিৎসার জন্য বরিশালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু পথেই তাদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে।
শনিবার সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ছত্রকান্দা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসটি উল্টে পুকুরে পড়ে গিয়ে এ মর্মান্তিক দুঘটনা ঘটে। আহত অবস্থায় অন্তত ৩০ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বাশার স্মৃতি পরিবহনের বাসটি ভাণ্ডারিয়া থেকে ঝালকাঠির উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ছত্রকান্দায় পৌঁছে বাসের চাকা ফেটে গেলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারান এবং বাসটি উল্টে রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে যায়।
ঝালকাঠিতে বাস পুকুরে: ১৫ জনের পরিচয় মিলেছে, দুজন মর্গে
পুকুরের গভীরতার কারণেই মৃতের সংখ্যা বেড়েছে: ফায়ার সার্ভিস
ঝালকাঠিতে বাস উল্টে পুকুরে, নিহত ১৭
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বলছে, পুকুরটি বেশ গভীর হওয়ায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। বাসটি টেনে তোলার জন্য ক্রেন নিয়ে আসা হয়। নিহতদের মধ্যে আটজন নারী, ছয়জন পুরুষ ও তিনজন শিশু।
নিহতদের মধ্যে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার আটজন হলেন- পৌর এলাকার পান্না মিয়ার ছেলে তারেক রহমান (৪৫), একই এলাকার মুজাফফর আলীর ছেলে সালাম মোল্লা (৬০), ভাণ্ডারিয়া পৌরসভার মৃত সালাম মোল্লার ছেলে শাহীন মোল্লা (২৫), ভাণ্ডারিয়ার পশারিবুনিয়া এলাকার জালাল হাওলাদারের কন্যা সুমাইয়া (৬), ভাণ্ডারিয়া রিজার্ভ পুকুর পাড় এলাকার মৃত লাল মিয়ার স্ত্রী রহিমা বেগম (৬০), মৃত লাল মিয়া হাওলাদারের ছেলে আবুল কালাম হাওলাদার, ভাণ্ডারিয়ার উত্তর শিয়ালকাঠি এলাকার মৃত ফজলুল হক মৃধার স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৮০), তেলিখালী গ্রামের রাসেল সিকদারের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার (২৪)।
দুর্ঘটনার পর থেকে লাশ গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত উপজেলার প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ ও মিরাজুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম। তিনি ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় নিহত সবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
ভাণ্ডারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত মিরাজুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের অ্যাম্বুলেন্সে করে আটজনের লাশ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকের দাফনের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তরিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ভাণ্ডারিয়া থেকে বরিশালের উদ্দেশে যাচ্ছিল বাশার স্মৃতি পরিবহনের বাসটি। বাসের সিংহভাগ যাত্রী ছিলো ভাণ্ডারিয়ার। তাদের কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ ছেলে, কেউ মেয়ের চিকিৎসার জন্য বরিশাল যাচ্ছিলেন।
হৃদরোগে আক্রান্ত কৃষক বাবা সালাম মোল্লাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বরিশাল যাচ্ছিলেন তার দুই ছেলে শাহীন মোল্লা ও রাসেল মোল্লা। দুর্ঘটনায় বাবা সালাম মোল্লা ও শাহীন মোল্লা নিহত হয়েছেন। রাসেল মোল্লা গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সালাম মোল্লার প্রতিবেশী ফেরদৌস মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন সালাম মোল্লা। ট্রাকচালক ছেলে শাহীন মোল্লা ও বেসরকারি চাকরিজীবী রাসেল মোল্লা বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে রওনা দেন।
সালাম মোল্লা ও তার বড় ছেলে শাহীন মোল্লা ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন। একই পরিবারের বাবা-ছেলে নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে বলে জানান ফেরদৌস।
তিনি আরও জানান, শাহীনের স্ত্রী নাজমা বেগম অন্তঃসত্ত্বা। তিনি চট্রগ্রামে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে ভাণ্ডারিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন নাজমা।
পৌর শহরের দক্ষিণ ভাণ্ডারিয়া মহল্লার ওষুধ ব্যবসায়ী তারেক হোসেন বেপারী তার ছেলে সাত বছরের শিশু সন্তান মাহাদির চিকিৎসার জন্য বরিশাল যাচ্ছিলেন। মাহাদ বেঁচে আছে, কিন্তু প্রাণ হারিয়েছেন বাবা তারেক।
ঝালকাঠিতে বাস উল্টে পুকুরে: তদন্তে জেলা প্রশাসনের ৫ সদস্যের কমিটি
বাসটি ছিল যাত্রীতে ঠাসা, চালককে দুষছেন সবাই
শিশু মাহাদি সাংবাদিকদের বলে, “হঠাৎ বাসটি ছিটকাইয়া রাস্তার পাশে পুকুরে পড়ে ডুবে যায়। এরপর আব্বারে আর পাই না। আমি বাসের জানালা দিয়া হাত বাইর করলে কেডা জানি আমারে টাইনা বের করে। পরে লোকজন আমারে বাড়িতে নিয়ে আসছে।”
মাহাদির পরিবার জানায়, দুইদিন আগে সে আছাড় খেয়ে হাত ভেঙে ফেলে। ছেলের হাতের চিকিৎসার জন্য তারেক ভাণ্ডারিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বরিশালগামী বাসটিতে উঠেছিলেন।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি তার শাশুড়ি রহিমা বেগমের চিকিৎসা করতে শ্যালক আবুল কালাম হাওলাদার ও শ্যালিকা রহিমা বেগমকে নিয়ে রওনা দেন।
তিনি বলেন, “বাসের চালক এত জোড়ে চালিয়েছে যে দুর্ঘটনায় পড়েছে। এতে শাশুড়ি রহিমা বেগম ও শ্যালক আবুল কালাম নিহত হয়েছেন।
মামুন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও রহিমা বেগম ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।
বাস দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, কোনো কোনো যাত্রী বলেছেন যে চালক মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছিলেন। আবার কারো অভিযোগ, যাত্রীদের কাছ থেকে তোলা মোট ভাড়া সহকারীর কাছ থেকে গাড়ি চালানোর সময়ই বুঝে নিচ্ছিলেন চালক। সে সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এর কোনোটিই প্রমাণিত নয়।
যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, বাশার স্মৃতি পরিবহনের বাসটিতে ভেতরে প্রচুর যাত্রী দাঁড়িয়েও ছিলেন। যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাসভর্তি করে যাত্রী তোলা হয়। একপর্যায়ে ভেতরে জায়গা না পেয়ে যাত্রীদের ছাদের উপরে তোলা হয়।
ফলে বাসটিতে কত যাত্রী ছিল সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্ঘটনার পর চালক ও তার সহকারী পালিয়ে গেছে।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।