“পলিথিনের বিকল্প যেটা আছে, সেটাকে বাজারে অ্যাভেইলঅ্যাবল করতে না পারার কারণে আগেও পলিথিন নিষিদ্ধটা বাস্তবায়ন করতে পারি নাই,” বলেন কামরুজ্জামান মজুমদার।
Published : 18 Apr 2025, 01:39 AM
মিরপুরের মুসলিম বাজারের এক দোকানে দুটি পলিথিনে মুড়িয়ে সবজি কিনলেন আনোয়ার হোসেন। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকটি পলিথিন নেওয়ার জন্য তিনি ফিরে এলেন।
দোকানির কাছে চাওয়া মাত্র সেটি পেয়েও গেলেন। পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “ছোট দুইটা ব্যাগ বড় পলিথিনে ঢুকিয়ে ফেলব; নিতে সুবিধা। আমরা সচেতন হলে কী হবে- ওই সব ব্যাগ তো কোথাও পাই না। থাকলে ব্যবহার করতাম।”
কারওয়ান বাজার, মিরপুরের বিভিন্ন বাজার ও মহাখালীর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেল পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার। অথচ ছয় মাস আগে অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পলিথিনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল।
ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই বলছে, পলিথিন বন্ধে বড় পরিসরে বিকল্প ব্যাগের ব্যবস্থা যেমন জরুরি, তেমনই পলিথিন কারখানাও বন্ধ হওয়া দরকার; কেবল নিষিদ্ধ ঘোষণা আর মাঝেমধ্যে অভিযানে ব্যবহার ঠেকানো যাবে না।
সুপারশপ ও কাঁচাবাজারে নিষিদ্ধের ছয় মাস পরেও পলিথিনের অবাধ ব্যবহারের বড় কারণ হিসেবে বিকল্প ব্যাগের অভাবকে দুষছেন তারা।
বাজারগুলোর ব্যাগ বিক্রির দোকান ঘুরেও পাট, কাপড়ের পরিবেশবান্ধব ব্যাগের দেখা মেলে না সেভাবে। তার বদলে বিক্রি হচ্ছে পলিথিন, নেটের ব্যাগ, টিস্যু ব্যাগ।
ব্যাগ বিক্রেতারাও পরিবেশবান্ধব ব্যাগের যোগান না থাকার কথা বলছেন। আর বিকল্প ব্যাগ উৎপাদকরা বলছেন, তাদের প্রচারের জন্য চাই সরকারি উদ্যোগ।
পরিবেশের সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইন করে সাধারণ পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেই ২০০২ সালে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর ১ অক্টোবর থেকে ফের সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। এক মাস পর ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারগুলোতে পলিথিনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অভিযানের কথা জানানো হয়।
একইসঙ্গে পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, মজুদ, পরিবহন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর বিরুদ্ধে অভিযানও পরিচালনা করেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। পলিথিন জব্দের পাশাপাশি জরিমানাও করার খবরও আসছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তখন ক্রেতাদের জন্য সব সুপারশপে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখতে বলেন।
মুসলিম বাজারের মায়ের দোয়া স্টোরে বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিকের তৈরি বাজারের ব্যাগ। দোকানটির বিক্রেতা রাকিব বলেছেন, এগুলো যে নিষিদ্ধ বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তা তার জানা নেই।
“প্রচার হলে জানতে পারব। পাটের ব্যাগ তো দেখিই না, মুসলিম বাজার পুরাটা ঘুরবেন- কোনো দোকানদারের কাছে পাইবেন না। খালি এখানে না, সব জায়গায়। হকাররা ব্যাগ নিয়ে আসে, তাদের কাছেও নাই।”
সবজি বিক্রেতা আজিজুল ভূঁইয়া বললেন, সরকার পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করতে পারলে সেগুলো ভোক্তা পর্যায়ে আসত না এবং তারাও ব্যবহার করতেন না।
“পলিথিনের দোকান খোলা, আমাদের তো কাস্টমারকে দিতে হয়। আরও পাঁচজন দিতেছে, আমি না দিলে কেমনে হইব? বিকল্প ব্যাগ তো সচারচর নাই। এটার জন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হইব।”
পলিথিনে সবজি নিয়ে ফিরছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুর রউফ রাকিব। তিনি বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে পলিথিন ব্যবহার করছেন তিনি।
“সেটা তো নাই এখানে। মানুষজন কোথা থেকে কিনবে? আশেপাশে সবজায়গায় পলিথিন, প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি হয়।”
বিকল্প না পেয়ে বাধ্য হয়ে পলিথিনে ফল বিক্রি করার কথা বললেন পল্লবীর ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা সাইদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “মানুষ তো পাটের ব্যাগ পায় না। পাইলে না নিয়ে আসত। পলিথিন নিষিদ্ধ ছিল, এখন নাই। পলিথিন নিষিদ্ধ হইলে মানুষ জিনিস বেচব কেমনে, কাস্টমারে মালডা নিবে কিসে?”
মুসলিম বাজারের রাজু ওয়ানটাইম বিজনেস সেন্টারে বিক্রি হচ্ছে পলিথিন, নেট, টিস্যু ব্যাগ।
দোকানটির বিক্রেতা সাকিব বলেন, “আমরা এখনও পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ পাইনি। কোথাও নাই, থাকলে তো আনতাম। নিষিদ্ধ করার পর পলি বেচতেছিলাম না, কিন্তু আমি না বেচলেও; অন্য দোকানদাররা তো বেচতেছে।”
মহাখালী কাঁচাবাজারের পান বিক্রেতা খোকনের দোকানেও পণ্য বিক্রির জন্য পলিথিনই দেখা গেল। তিনি বলছেন, ২৫০ গ্রামের দুই কেজি পলিথিন ৪৬০ টাকায় কেনা যাচ্ছে। এ টাকায় বড় আকারের পলিথিন নিলে ২৫০টি; মাঝারি নিলে ৩০০টি; আর ছোট নিলে ৪০০টি পলিথিন পাওয়া যায়।
দৈনিক তার পাঁচশ থেকে এক হাজার ব্যাগের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি বিকল্প ব্যাগের দাম ৩ টাকা হলেও দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকা খরচ গুনতে হবে খোকনকে। ফলে ব্যবসায় বড় ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা দেখছেন তিনি।
“সরকারকেই ব্যাগগুলো বাজারে আনতে হবে। আমরা কিনতে গেলে তো পলিথিনই পাচ্ছি। অর্ধেক বিড়া পান বিক্রি করে ৫ টাকা লাভ করি, সরকারের আমাদেরকে এটা দিতে হবে।”
এ বাজারে ব্যাগ বিক্রির দোকানেও পরিবেশবান্ধব ব্যাগ দেখা যায়নি। ফলে বাজারে পর্যাপ্ত বিকল্প না রেখে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করাটাকে ‘অন্যায়’ বলছেন ফল বিক্রতা জামাল।
তার ভাষায়, “আমাদের তো প্রতিবাদের সুযোগ নাই, প্রতিবাদ করলে হেনস্তা করবে। বিকল্প কিছু আনতে হবে, এছাড়া হবে না। আপনি আমার কাছ থেকে কিছু কিনলে আমি কিসে দেব? জরিমানা করতে আসলে দিয়ে দেব।”
কারওয়ান বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতারাদের হাতে হাতেও পলিথিন দেখা গেল।
সবজি বিক্রেতা সোহেল বললেন, “সরকারের লাভ আছে- বন্ধ করবে না। খালি সাধারণ মানুষের থেকে টাকা নিয়ে যায় ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে। কিন্তু এমন জায়গায় বন্ধ করতে হবে- যাতে আমি কিনতে না পারি।”
দৈনিক আয়ের শ্রমিক তোফাজ্জল হোসেন মনে করেন, বিকল্প ব্যাগে সবজি দেওয়ার দায় কেবল দোকানির।
“দোকানদার দিবে, আমি কী করব? এটা যদি বন্ধ করে দেয়, আমার কোনো অসুবিধা নাই।”
ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রেতা আশরাফুল পলিথিন ব্যাগ কিনছিলেন এক দোকান থেকে। দোকানটিতে পলিথিন, নেট, প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি হয়।
আশরাফুল বলেন, “বেচাকিনি করা লাগে; এর জন্য তো নেওয়া লাগে। বিকল্প পাইলে আর কিনতাম না।”
বিকল্প ব্যাগের উৎপাদন কম থাকায় সেগুলো বিক্রি না করতে পারার কথা বলছেন দোকানটির বিক্রেতা শাকিল।
পলিথিন সম্পর্কে মানুষের আচরণ নিয়ে গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রধান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গবেষণা করলে পরিস্থিতি বুঝতে পারতাম; পলিথিনের বিকল্প যেটা আছে, সেটাকে বাজারে অ্যাভেইলেবল করতে না পারার কারণে আগেও পলিথিনের নিষেধাজ্ঞাটা বাস্তবায়ন করতে পারি নাই।”
সুপারশপের কী হাল?
নতুন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করার পর পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারের তোড়জোড় দেখা গেলেও এখন আগের মতোই নেটের ব্যাগে বিক্রি চলছে।
সুপারশপ আগোরার মিরপুর-১২ নম্বরের বিক্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন কাঁচা সবজি পলিথিনে ঢেকে রাখতে দেখা গেছে, ক্রেতাদেরও নেটের ব্যাগে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে সেখানে বিকল্প হিসেবে কাপড়ের ব্যাগের ব্যবস্থাও করা হয়েছে, যেগুলো চাইলে ক্রেতারা কিনতে পারেন।
বিক্রয়কেন্দ্রটির প্যাকেটার রফিক বলেন, “এগুলো ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয়। বেশি জিনিস কিনলে নেয়, নাহলে নিতে চায় না। দাম বেশি তো, আমরাও দিতে পারি না।“
শুকনো খাবার কিনতে আসা সরকারি চাকরিজীবী রফিক হোসেন বলেন, “কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছি; কিছু কেনা উচিত মনে হল কিনলাম; ব্যাগ আনিনি। বারবার তো আমি একই জিনিস কিনব না, দাম কম হলে কেনা যেত; অল্প জিনিস।”
সুপারশপ স্বপ্নের মিরপুর-১০ নম্বরের বিক্রয়কেন্দ্রে ক্রেতাদের নেটের ব্যাগে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। তবে পাটের ব্যাগও রাখা হয়েছে, যেগুলো ক্রেতারা ২০-২৫ টাকায় কিনতে পারেন।
বিক্রয়কেন্দ্রটির চেক আউট অ্যাসিসটেন্ট ধ্রুব চৌধুরী বলেন, “প্লাস্টিকের চেয়ে তো পাটের দাম অনেক বেশি; এ কারণে ফ্রি দিতে পারছি না। ভালো ক্রেতারা কিনে নিয়ে যায়, কিছু আছে যারা কিনতে পারে না। আমরা আমাদের চাহিদা মত বিকল্প ব্যাগ পাচ্ছি।”
মহাখালীর প্যারাগন মার্টে পণ্য বিক্রির জন্য নেটের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে কোনো বিকল্প ব্যাগের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে এ বিষয়ে দোকানের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বিকল্পের যোগান কম কেন?
বাজারে বিকল্প ব্যাগের অপ্রতুল যোগানের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগের অভাবের কথা বললেন উদ্যোক্তারা।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ভুট্টা, হাড়ের গুঁড়া দিয়ে বিকল্প ব্যাগ তৈরি করছে আর্থ ম্যাটার্স লিমিটেড। বর্তমানে তারা মাসে ১০ লাখ ব্যাগ তৈরি করছে।
পলিথিনের যে ব্যবহার, এর ১ শতাংশ বিকল্প ব্যাগও দেশে উৎপাদন হচ্ছে না বলে জানালেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিমুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনও করপোরেট অর্ডারগুলোই আসছে; সরকারের তরফ থেকে স্বচ্ছ নির্দেশনা না পাওয়ায় বাজার পর্যায়ে যেতে পারছেন না তারা। দুই মাস আগে পরিবেশ অধিদপ্তরে তথ্য ও নমুনা জমা দিয়েছেন, তবে হালনাগাদ তথ্য আসেনি।
“এটার দাম বেশি, আমাদেরও খরচ বেশি হয়। যে কারণে সুপারস্টোর ছাড়া অন্যদের কেনাটা কষ্ট হয়ে যায়। যারা বানাচ্ছে, তাদের উৎপাদন দিয়ে একটা বিভাগকেও কাভার করা যথেষ্ট না, অনেককে আসতে হবে। অনেক প্রোডাক্ট এক্সপোর্টে যাচ্ছে।
“সরকার যদি কোনো গাইডলাইন দেয়, তখন দেখা যাবে- অনেকেই আসতেছে এটাতে। এটা সম্পর্কে মানুষ জানে না। সচেতনতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু উৎপাদন কম। সরকারকে এটার ব্যাপারে আগে আসতে হবে এবং রেগুলেটরি বডি তৈরি করতে হবে।”
পলিথিনের বিকল্প অজৈব পচনশীল ব্যাগ অনুমোদনের জন্য নমুনাসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে গত ১৯ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে আর্থ ম্যাটার্সের মতো আরও কোম্পানি আবেদন করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবেদনগুলো পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনা শেষে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিন বছর ধরে ভুট্টার মাধ্যমে বিকল্প ব্যাগ তৈরি করছে রাজশাহীর ক্রিস্টাল বায়োটেক। দিনে দুই লাখ ব্যাগ তৈরির সক্ষমতা থাকলেও এ পর্যায়ের উৎপাদনে যেতে পারছে না তারা।
এর কারণ হিসেবে পলিথিনের সহজলভ্যতা, মানুষের পলিথিনে আগ্রহ, টিস্যু ব্যাগ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগ না থাকাকে দায়ী করছেন কোম্পানির সত্বাধিকারী ইফতেখারুল হক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকল্প ব্যাগটাকে প্রমোট করতে হবে সরকারের, পলিথিন বন্ধ করতে হবে। আমাদের ব্যাগটা যেহেতু পচনশীল, সেহেতু অর্ডার ছাড়া বানাই না। বেশি দিন রাখতে পারি না, নষ্ট হয়ে যায়। সুপাশ শপ অর্ডার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে সরকার পাট, কাপড় এবং কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে বলছে।”
বর্তমানে ইফতেখারুলের ক্রেতা মূলত পরিবেশবাদীরা। জনপরিসরে বিকল্প ব্যাগ পৌঁছাতে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরকারের বসা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।
“যে পলিথিন কারখানাগুলো আছে, সেগুলোকেও কনভার্ট করে বিকল্প উৎপাদনে যাওয়া যেতে পারে। এর জন্য তিন মাসও লাগবে না।”
গোপালগঞ্জের কোম্পানি জে কে পলিমার্স পরীক্ষামূলকভাবে ভুট্টা দিয়ে বিকল্প ব্যাগ তৈরি করছে। দিনে এক হাজার ব্যাগ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে তাদের।
কোম্পানির পরিচালক বি এম নুরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্ডার পেলে এ সপ্তাহেই তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবেন।
“দেশের অবস্থা তো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভালো না, এ কারণে আস্তে ধীরে আগাচ্ছি। সরকার যদি মালামালগুলো আনার ক্ষেত্রে সহায়তা করে…মাল আনতে গেলে কাস্টমসে ঝামেলা করে, বিভিন্ন রকমের সমস্যা আছে- এ সমস্যাগুলো যদি দূর হয়- আরও ইনভেস্টররা আসতে পারে।
“সব জায়গায় বিকল্প ব্যাগ ব্যবহার করতে গেলে আরও অনেক মেশিন, কারখানা লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকলে- এটা সম্ভব না।”
দিনে ৩০/৪০ হাজার পাটের ব্যাগ তৈরির সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে এক হাজার ব্যাগ তৈরি করছে কাস্টমাইজ জুট ব্যাগ।
কোম্পানির সত্বাধিকারী নুসরাত জাহান বলেন, “প্রমোশনাল যে ব্যাগগুলো হয়, সেগুলো তৈরি করি। বাজারের ব্যাগ কম করি।
“পাটের ফ্রেবিক্স পাচ্ছি না; দাম বেশি বলে উৎপাদন বাড়াতে পারছি না, আমাদের স্পেসও কম। বাজারে চাহিদা আছে, দাম কম থাকলে আরও হয়ত বাড়বে।”
উৎপাদন বাড়াতে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে কাঁচামাল বাড়ানোর পাশাপাশি সেগুলোর দাম কমানোর দাবি করছেন তিনি।
উত্তরণ কোন পথে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু দিন পরপর নিষিদ্ধ করে জরিমানা আরোপ করেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত বিকল্প।
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ধীরে ধীরে বাজার থেকে পলিথিন সরাতে হবে; যাতে এ সময়ের মধ্যে মানুষ বিকল্পে অভ্যস্ত হয়।
“সাধারণ জনগণের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য, সুলভ ব্যাগ আনতে পারেনি। বিকল্পের ব্যবস্থা না করে জরিমানা করাটা উচিত না। প্রতিদিন ১ কোটির বেশি পলিথিন ব্যবহৃত হয়। ১ কোটি পাটের ব্যাগ সাপ্লাই দেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না? ক্যালকুলেশনটা তো আমাদের সামনে নাই। বন্ধ জিনিস আবার বন্ধ করে দিলাম সেটা টেকসই হবে না, গবেষণা প্রয়োজন।”
পলিথিনের ব্যবহার কমাতে উৎপাদন পর্যায়ে বন্ধ করা, কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া, বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
২০২৩ সালে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। ঢাকায় এক একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে।
দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। এসব ব্যাগ কৃত্রিম তন্তু দিয়ে তৈরি হলেও কাপড়ের ব্যাগ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় পরিমাণটা কমই; তবে সেটার ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না।
“সেগুলো নদী-নালায় যাচ্ছে। এটা প্রপার ম্যানেজমেন্টে নিয়ে গেলে বাজার মনিটরিং, উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়বে না, বা কম প্রয়োজন হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসিব আহমেদ বলেন, পলিথিন উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের সঙ্গে সরকারের বসার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে।
“একটা শক্ত আইন করে দিলাম, কদিন পরপর অভিযানে গেলাম- এমন লুকোচুরি করে পসিবল না। পরিবেশে পলিথিনের সরাসরি চলে যাওয়াটা বন্ধ করতে হবে, তাহলে অসুবিধা তেমন হবে না।
“কারখানাগুলোকে একটা রেগুলেশনের মধ্যে নিয়ে আসা- এই ক্যাটাগরির পলিব্যাগ উৎপাদন করা যাবে, এগুলো যাবে না। ধাপে ধাপে পলিথিন সরিয়ে নিতে হবে বাজার থেকে, এ সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যাগগুলো নিয়ে আসতে পারে।”
পলিথিনের ব্যবহার কমাতে অভিযান ছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর বিকল্প পণ্যের সচেতনতা ও বিকল্প পণ্য সরবরাহ সহজ করতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর দিনব্যাপী মেলা এবং স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে বলে জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে পলিথিন/পলিপ্রপাইলিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ বিষয়ক গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও ছাত্র-ছাত্রীদের টিম সপ্তাহব্যাপী ঢাকা শহরের সুপারশপগুলোতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা করেছে।
“বাজার মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে ঢাকার ৬টি কাঁচাবাজারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, ক্লিন-আপ ক্যাম্পেইনও করা হয়েছে।”
এরপরও ব্যবহার বন্ধ করতে না পারার মূল কারণ হিসেবে পলিথিনের সহজলভ্যতা ও জনগণের সচেতনতার অভাবকে দায় দিচ্ছেন কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “পলিথিনের স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়ে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও প্রয়োজনীয় প্রচারের অভাব রয়েছে। তার পরও সরকার খুবই অন্তরিক এবং আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য।”