নারী প্রতিনিধিত্ব: আরপিও সংশোধন হয়নি, দলগুলোরও ‘গা’ নেই

এখন ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য পূরণের জন্য আরপিও সংস্কারের প্রস্তাব পাঠিয়ে রেখেছে ইসি।

মঈনুল হক চৌধুরীকাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 02:46 PM
Updated : 8 March 2023, 02:46 PM

রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমা দুই বছর ধরে পার হলেও আইন সংস্কারের কাজ শেষ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।

২০২০ সালের মধ্যে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও)। ২০০৮ সালে নিবন্ধন নেওয়ার সময় দলগুলো তা পূরণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পূরণ করতে পারেনি নিবন্ধিত দলগুলো।

এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আরপিও সংস্কারের প্রস্তাব পাঠিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন। বিগত কে এম নূরুল হুদা কমিশন এ বিষয়ে এক দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনও গতবছর অগাস্ট মাসে একগুচ্ছ প্রস্তাব পাঠায়। পরে নভেম্বরে সিইসির বিশেষ অনুরোধের পর আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়।

আইন সংস্কার না হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোয় তেমন ‘গা’ নেই। অধিকাংশ দল নিয়ম মাফিক কমিশনকে জানাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তাদের দল ‘কাজ করে যাচ্ছে’।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমাদের কমিটিগুলোতে ইতোমধ্যে ২৮% নারী এসেছে। আশা করছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৩৩% কমিটিতে আসবে।"

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সঠিক হিসাবটা এই মূহুর্তে দেওয়া কঠিন হবে। নির্বাচন কমিশনের শর্ত শতভাগ পূরণ না হলেও আমরা ৩৩% থেকে বেশি দূরে নেই। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমাদের সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩% নারী রাখতে পারব।"

বিএনপি নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিল না করায় দলটির পক্ষ থেকে সময় চেয়ে ইসিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির নারী প্রতিনিধিত্ব ২০% এর নিচে বলে ইসি কর্মকর্তারা জানান। আবার কয়েকটি ইসলামী দল ইসির সংলাপে গিয়ে নারী প্রতিনিধিত্বের ওই বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা করে এসেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে বাস্তবতার নিরিখে এগোতে চায় নির্বাচন কমিশন।

২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের নিয়ম চালু করে ইসি। আরপিওর ৯০ খ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির সব দলের সব স্তরের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে ২০২০ সাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তখন।

এখন ইসিতে ৪০টি নিবন্ধিত দল রয়েছে। কিন্তু ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের শর্ত কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।

নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালন না করলে নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ‘বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে’ বলে মনে করেন এ নির্বাচন কমিশনার।

মো. আলমগীর বলেন, “দলের সব স্তরে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্বে রাখার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু নিবন্ধিত কোনো দলের তা নেই, পূরণ করতে পারেনি (২০২০ সালের মধ্যে)-এটা বাস্তবতা। তাহলে তো সব দলের নিবন্ধন যাবে। এ বিষয়টা যারা আইনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তারা বাস্তবতা বিবেচনা করেননি।”

বর্তমান কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার সময়সীমা ২০২০ এর পরিবর্তে ২০৩০ সাল করার প্রস্তাব দিয়েছে।

“আমরা বলেছি ২০৩০ এর মধ্যে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে পারবে দলগুলো,” বলেন আলমগীর।

সবশেষ ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের পর্যায়ে রয়েছে। ভেটিং শেষ হলে আইন সংশোধনের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাঠানো হবে।

প্রধান তিন দলের চিত্র

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন হয় গত ডিসেম্বরে। নারী নেতৃত্বের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলটির ৭৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ জন। দলটির ৮১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির দুটি পদ শূণ্য রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া দলটির সভাপতিমণ্ডলিতে ৩ জন, সম্পাদকমণ্ডলীতে ৭ জন ও কেন্দ্রীয় সদস্য পদে ৯ জন নারী রয়েছেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে ৪৫ জন সদস্যের মধ্যে নারী রয়েছে ৫ জন।

নারী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বিএনপি। দলটির ৫০২ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির মধ্যে নারী ৬৭ জন। দলটির উপদেষ্টা পরিষদে ৮২ জনের মধ্যে নারী ৬ জন।

জাতীয় পার্টিতে প্রায় ২০ শতাংশ নারী রয়েছে দাবি করে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা।

জনপ্রতিনিধি ও আমলা

একাদশ সংসদে সংসদ নেতা, স্পিকার, সংসদ উপনেতা ও বিরোধী দলীয় নেতা পদে রয়েছেন নারী।

জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে নারী রয়েছেন ২৩ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০ জন, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দুইজন ও জাসদের একজন। আর সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন নারী রয়েছেন।

দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে মাত্র একজন নারী। এসব সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড সদস্যের ৪৭৬টি পদের বিপরীতে নারী রয়েছেন মাত্র দুজন। অবশ্য সিটি করপোরেশনে সংরক্ষিত সাধারণ ওয়ার্ডে ১৬০ জন নারী রয়েছেন।

জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৬১ জনের মধ্যে নারী রয়েছে মাত্র একজন। উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৪৯২ জনের মধ্যে নারী ৮ জন। দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান পদে নারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।

মন্ত্রিপন্ত্রিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, সিনিয়র সচিব/সমমর্যাদা এবং সচিব/সমমর্যাদার ৮৬টি পদের বিপরীতে নারী রয়েছেন ১০ জন। সিনিয়র সচিবদের মধ্যে একজন দুজন। বর্তমানে ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে নারী রয়েছেন ১০ জন। 

পুরনো খবর

Also Read: ৩৩% নারী: প্রতিশ্রুতিপূরণে  সময় দেওয়ার পক্ষে আওয়ামী লীগ

Also Read: আরপিও সংস্কার প্রস্তাব ভেটিংয়ের অপেক্ষায়: ইসি রাশেদা

Also Read: ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব: অপেক্ষা আরও ‘এক দশক’

Also Read: সংসদে নারী আসন: জামানত দ্বিগুণ করতে চায় ইসি

Also Read: সংসদ ও দলে নারীর বিধান বাতিল চায় খেলাফত আন্দোলন

Also Read: নিবন্ধনের শর্ত: অর্ধেক দলেরই সাড়া নেই, সময় চায় বিএনপিও