“ভবিষ্যতে যদি রাজনীতি করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়, জনগণের সাথে আলাপ আলোচনা করে তখন একটা রাজনৈতিক দল হতে পারে। কিন্তু নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক দলে রূপান্তর হবে না।”
Published : 07 Oct 2024, 01:31 AM
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের যে আলোচনা তৈরি হয়েছিল, গত দুই মাসে তা অনেকটাই স্থিমিত হয়ে এসেছে।
সরকার পতনের ডাক দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলা সফরের যে কর্মসূচি দিয়েছিলেন, সেটিও এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন বলছেন, তারা একটি নতুন ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চান, সেটি রাজনৈতিক নতুন দল গঠনের পথে এগিয়ে যাবে কিনা, তা আরও পরে ঠিক হবে।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেখানে উপদেষ্টা হিসেবে ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি রয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তরুণদের নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে যাচ্ছেন।
‘শিক্ষার্থী’ ও ‘নাগরিক’ এই দুই ধরায় বিভক্ত হয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার করে একটি মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের নতুন রূপরেখা নিয়ে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ার কর্মসূচিতে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের নেতারা। গঠন হয়েছে ‘নাগরিক কমিটি’ যাকে অভ্যুত্থান সুরক্ষার উদ্যোগ বলা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
গৎবাঁধা রাজনীতি আর চায় না তরুণ প্রজন্ম: আখতার হোসেন
অভ্যুত্থান সুরক্ষার এমন তৎপরতা ‘ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার দিকে মোড় নিচ্ছে’ কি না, সে বিষয়ে আলোচনা ছিল। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করা ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র নেতারা এখন ‘একটি নির্দিষ্ট সময়’ অতিবাহিত হওয়ার পর এ নিয়ে ভাবার কথা বলছেন। ওই ‘সময়’ কবে আসবে সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় নাগরিক কমিটি এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দিতে চাইছে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ‘চেতনা’ অক্ষুণ্ন রাখার কাজ করবে এটি।”
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়েই আমরা শেখ হাসিনার ‘ফ্যাসিবাদী’ শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিলাম। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কার পক্রিয়ায় সহযোগিতা করা; পাশাপাশি সরকারের কর্মকাণ্ডের যৌক্তিক সমালোচনাও আমরা করব।
“যে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন সেই আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নিতে এখন আমরা সমাজের তৃণমূলে পৌঁছাতে চাই। সেই লক্ষ্যেই রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে যেতে চায় জাতীয় নাগরিক কমিটি।”
তাহলে নতুন দল হচ্ছে না? এ জিজ্ঞাসায় জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যে এমন অনেককে পাওয়া যাবে যারা দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতিই করবেন। ভবিষ্যতে যদি রাজনীতি করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়, জনগণের সাথে আলাপ আলোচনা করে তখন একটা রাজনৈতিক দল হতে পারে। কিন্তু নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক দলে রূপান্তর হবে না।”
স্বতন্ত্র কোনো রাজনৈতিক দল ‘হলেও হতে পারে’, এমন কথাও বলেন আখতার।
“এই কমিটির অনেকেই হয়ত সেখানে যোগ দিতে পারেন, অথবা অনেক নতুন মুখ এনে এই দল গঠন করা হতে পারে। এই বিষয়গুলো অনেক পরের ব্যাপার।”
কী করছে জাতীয় কমিটি
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা গত জুলাই মাসের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। আন্দোলনের মূল নেতৃত্বের বড় একটি অংশ ছিলেন আখতারের উদ্যোগে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি নতুন ছাত্র সংগঠনের নেতা।
অবশ্য প্রতিষ্ঠার এক বছর পার হওয়ার আগেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকার পতনের দ্বিতীয় মাসে ৮ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের একাংশ এবং এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমাজের বিভিন্ন স্তরের তরুণ প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘গণঅভ্যুত্থানের চেতনা’ বাস্তবায়নে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামের একটি ৫৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে লেখক, সাহিত্যিক, ইউটিউবার, ইনফ্লুয়েন্সার, সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার তরুণদেরও যুক্ত করা হয়।
গত এক মাসে কমিটি কী করেছে, এই প্রশ্নে আখতার হোসেন বলেন, “নাগরিক কমিটি গঠনের পর এই এক মাসের মধ্যে তিনটা সাধারণ সভা করেছি। প্রতিদিন কিছু বিষয়ভিত্তিক ছোট ছোট মিটিং হচ্ছে। আমরা সেল গঠন করছি, লিগ্যাল টিম গঠন করেছি। এই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবারের মধ্যে যারা মামলা করতে চায় তাদেরকে সহযোগিতা করবে এই টিম।
“বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হেলথ টিমের বাইরে নাগরিক কমিটিরও একটি হেলথ টিম কাজ করছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ যেসব জায়গায় আন্দোলনে শহীদদের পরিবার রয়েছে, সেখানে আমরা গিয়ে সাক্ষাৎ করেছি।”
‘নতুন বাংলাদেশের’ বন্দোবস্ত করতে গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের মতামত শোনা হচ্ছে বলে জানান আখতার।
“বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কেমন চাওয়া সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। ‘ফ্যাসিবাদী’ ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত করতে তাদের পরামর্শ চাচ্ছি। পাশাপাশি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত সবার চাওয়াগুলোর একটা সারমর্ম আমরা তৈরি করছি।”
‘তৃণমূল থেকে গড়ে উঠবে নেতৃত্ব’
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর ৫২টি থানায় ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১০ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। থানাগুলোতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠনের পর তাদের মতামতের ভিত্তিতে মহানগর কমিটি গঠনের চিন্তা রয়েছে বলে জানান আখতার।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন জানান, প্রাথমিকভাবে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে এ প্ল্যাটফর্মে যোগদানে ইচ্ছুকদের পরিচয় সংগ্রহের কাজটি করছেন।
"আমরা গুগল ফর্ম, লিখিত ফর্মের মাধ্যমে অনেকের প্রাথমিক পরিচয় ও তথ্য সংগ্রহ করেছি। এছাড়াও আমাদের ফোন নম্বর অনেক স্থানে দেওয়া আছে। যারা ফোন করে যোগাযোগ করেছেন তাদের সাথে কথা বলে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছি।”
এই কমিটি কোনো রাজনৈতিক দল নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো নাগরিক চাইলে কোনো দলের ভেতরে থেকে অথবা দলের বাইরে থেকেও এ কমিটিতে থাকতে পারেন।"
ঢাকা মহানগরে কমিটি গঠনে সফল হলে একই প্রক্রিয়ায় জেলা পর্যায়েও কমিটি করা হবে জানিয়ে আখতার হোসেন বলেন, “আগে উপজেলায় কমিটি দেওয়া হবে। সেই কমিটি থেকে লোক বাছাই করে জেলা কমিটি গঠন করা হবে। উপজেলায় যারা এই আন্দোলনের মূল চেতনা পুরোপুরি ধারণ করবে, তাদেরকে ভোটাভুটির মাধ্যমে আমরা জেলা কমিটিতে নিয়ে আসব।”
কমিটিতে লোক নেওয়ার ক্ষেত্রে কাদেরকে কীসের ভিত্তিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক নেতা আখতার বলেন, “এখনকার ৫৫ জনের কমিটিতে শহীদ পরিবারের লোক যেমন আছেন, তেমনি ডান চিন্তা, বাম চিন্তার মানুষও আছেন। মাদ্রাসা পড়ুয়ারা যেমন আছেন, স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারাও আছেন। পাহাড়ের জনগোষ্ঠী, সমতলের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর লোকজনও আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
“এখানে শ্রমিকদেরকেও যুক্ত করার চেষ্টা করছি। এখানে অন্তত ২৫ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই। তবে সেটা নারী হিসাবে কোটার ভিত্তিতে নয়; তাদের যোগ্যতা, আন্দোলনকে ধারণ করার যোগ্যতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব- এসব গুণ আমরা নতুন লোক নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছি।”
ছাত্ররা কী করছে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা গত ৮ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৪৪টি জেলায় মতবিনিময় কর্মসূচি নিয়ে গেছেন।
আন্দোলনের নিহতদের পরিবারগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্র-নাগরিক মতবিনিময় সভা করেছেন তারা।
কয়েকটি জেলায় এ ধরনের কর্মসূচিকে ঘিরে সমন্বয়ক ও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছোটখাট হাতাহাতিও হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা এখনই রাজনৈতিক দল গঠন করছি না। গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দান করেছেন এবং সক্রিয় ছিলেন তাদের সাথে জনসংযোগ করতে আমরা জেলায় জেলায় গেছি।"
আরও পড়ুন:
তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর মানুষের আস্থা নেই: সারজিস
‘বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম’ সরকারের কোনো অংশ নয় মন্তব্য করে হান্নান বলেন, "জেলা-উপজেলায় আমরা যে কমিটি দেব, সেটা কোন রাজনৈতিক দল নয়। গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় জনতা যেন ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত থাকে সে উদ্দেশ্যে কমিটি দেয়া হবে।"
দল না করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে জানিয়েছেন আরেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার।
তিনি বলেন, “সদস্য আহ্বান ও জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহ এখনও শুরু হয়নি; তবে দ্রুত শুরু হবে। এসব নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত নয়, তবে শিগগিরই হবে।"
স্থানীয় পর্যায়ে কমিটির সদস্য সংখ্যা কত হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "জেলার আকার এবং আন্দোলনকারীদের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে তা বিভিন্ন হতে পারে।"
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম এবং নাগরিক কমিটি সমান্তরালভাবে থাকবে। ছাত্রদের উদ্যোগ ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং নাগরিকদের উদ্যোগ নাগরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে এর মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না।"