কাদের বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়নি, আর মামলাও সরকার করেনি।
Published : 01 Apr 2023, 04:40 PM
‘মাছ, মাংস ও চালের স্বাধীনতা’র বিষয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোতে এক দিনমজুরের নামে যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেটির সত্যতা নিয়ে এবার প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এটি আসলেই জাকির হোসেন নামে কারও বক্তব্য, নাকি প্রথম আলোর নিজের ‘বয়ান’, তা নিয়ে সন্দিহান তিনি। প্রথম আলো কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চাইছে বলেও ধারণা করছেন তিনি।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা নিয়ে আলোচনা, এরপর মামলা, সাংবাদিক গ্রেপ্তার এবং তা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে শনিবার আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহানগর ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় আসেন কাদের, সেখানে এনিয়ে কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “প্রথম আলোর সংবাদটি যে ভাষায় একটি দিনমজুরের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশ করেছে, এটি সাধারণ কোনো দিনমজুরের বক্তব্য, না কি প্রথম আলোর দেওয়া বয়ান, সেটি ভাববার সময় এসেছে।
“৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিমিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর এই উদ্যোগ জাতিসত্ত্বাবিনাশী অপতৎপরতা নয় কি? স্বাধীনতা দিবস তরুণ প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেম ও দেশত্ববোধ সৃষ্টির এক অনন্য দিন। এই দিনে বিশেষ এক এজেন্ডা সেটিংয়ের উদ্দেশ্যে কি এই সংবাদ? এটা কি মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অর্জনকে অস্বীকার করার শামিল নয়?”
সেই সংবাদ নিয়ে যা যা হয়েছে
প্রথম আলোর তুমুল বিতর্ক তোলা সেই সংবাদে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম দিয়ে তার বক্তব্যে লেখা হয় “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।”
ওই মন্তব্য ধরে শিরোনাম করা হলেও ছবি দেওয়া হয় আরেক শিশুর, যার কথা প্রতিবেদনের ভেতরে ছিল। ওই ছবি ও শিরোনাম দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় একটি কার্ড পোস্ট করা হয়, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
পরে প্রথম আলো প্রতিবেদনটি থেকে সেই শিশুর ছবি সরিয়ে শিরোনাম বদলে দেয়। পাশাপাশি তাদের সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টও প্রত্যাহার করে।
পরদিন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলে একাত্তর টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। তাতে দাবি করা হয়, একটি শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে সেই কথা বলানো হয়েছে। তবে যার নামে বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেই ‘জাকির হোসেনের’ তালাশ করেনি টেলিভিশনটি।
এর মধ্যে বুধবার ভোররাতে ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে তার সাভারের বাসা থেকে সিআইডি ধরে নিয়ে যায়। এরমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। একটি মামলায় প্রথম আলো সম্পাদককেও আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার শামসকে পাঠানো হয় কারাগারে।
দেশের ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই মামলা এবং শামসকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছে সরকার সমর্থক সংগঠনগুলো।
যুবলীগ নেতার মামলা সিআইডিতে, সাংবাদিক শামস কোথায়?
জামিন নাকচ, সাংবাদিক শামস কারাগারে
প্রথম আলো সম্পাদককে ‘হুকুমের আসামি’ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আবার বিতর্কে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে স্থগিত করুন: জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান
‘মিথ্যা সংবাদে’ তরুণদের উসকানির চেষ্টা
ওবায়দুল কাদের শনিবারের সভায় দাবি করেন, প্রথম আলোর সেই সংবাদটি ‘মিথ্যা’।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতা দিবসের দিন অন্যান্য দেশে দেখি, সে দেশের গণমাধ্যমে উদ্দীপনামূলক, অনুপ্রেরণামূলক বাণী দিয়ে নতুনভাবে দেশকে ভালোবাসার উৎসাহ জোগায়। অথচ দৈনিক প্রথম আলো তাদের নিজস্ব ও প্রভুদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য জাতির সামনে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে তরুণ প্রজন্মের মনে হতাশা ক্ষোভ সৃষ্টি করার জন্য উসকানি দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে।
“যেখানে সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতিকে বিভক্ত করারর উসকানি রয়েছে এবং দেশের নৈরাজ্য, অশান্তি সৃষ্টি করে এটি মহলের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটা দেশের কোনো বিবেকবান মানুষের না বোঝার কথা নয়।”
প্রথম আলোর প্রকাশক ও সম্পাদক এই দায় এড়াতে পারেন কি না- সেই প্রশ্ন তোলে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “তারা কি তাদের এই গর্হিত অপরাধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন অথবা ক্ষমা চেয়েছেন? কোনোটাই করেননি। চরম ঔদ্ধত্য তারা দেখিয়েছেন।
“ঐতিহ্যগতভাব দৈনিকটি এক বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যে কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকে, তা হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়ানোর জন্য কুৎসামূলক সংবাদ পরিবেশন করে। তারা বরাবরই বিরাজনীতিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে।”
একাত্তর টেলিভিশনের সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে কাদের বলেন, “সাত বছরের একটি শিশুকে ১০ টাকা ঘুষ দিয়ে তাকে অসৎ পথে পরিচালিত করা কি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা?”
এই সংবাদটিকে ১৯৭৪ সালে বাসন্তীর গায়ে জাল পরনোর সঙ্গেও তুলনা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, “আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এভাবেই ঘুষ দিয়ে ব্রহ্মপুত্রপাড়ের চিলমারীর প্রতিবন্ধী নারী বাসন্তীকে ১৯৭৪ সালে ১০ টাকার শাড়ি খুলে ৩০০ টাকার জাল পরিয়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পটভূমি রচনা করা হয়েছিল।”
সরকার নয়, মামলা করেছে ‘সংক্ষুব্ধ নাগরিক’
সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে ‘রিপোর্টার্স ইউদআউট বর্ডার’ নামে আন্তর্জাতিক সংগঠন যে অভিযোগ এনেছে, তারও জবাব দেন কাদের।
তিনি বলেন, “সরকার এখানে কোনো মামলা করেনি। মামলা সাধারণ একজন নাগরিকও করতে পারে, সংক্ষুব্ধ নাগরিক।”
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে কাদের বলেন, “কাকে ভয় দেখাব? যাকে ভয় দেখানোর কথা বলা হচ্ছে, তিনি এই দেশের মানুষকে ভয়ের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিলেন।তিনি এই দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভয় দেখিয়েছিলেন, এই দেশের রাজনীতিতে ভয় দেখিয়েছিলেন, এই দেশের সাংবিধানিক সরকারকে ভয় দেখিয়েছিলেন, অসাংবিধানিক সরকারের পক্ষে ওকালতি করেছেন, তাদের পক্ষে কাজ করেছেন। এক-এগারো কি আমাদের মনে নেই।
“তিনিই তো এই দেশে ভয় দেখিয়েছেন ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, বিরাজনীতিকরণের ফয়সালা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করেছেন, সম্পাদকীয় লিখেছেন। সেগুলো আমরা কি ভুলে গেছি? সেদিন কি বহু আগে?”
বিএনপিকে ‘সাধু বানাতে প্রচারের দায়িত্বে প্রথম আলো’
প্রথম আলো আর বিএনপি সরস্পরকে সহযোগিতা করে বলেও অভিযোগ করেন কাদের। তিনি বলেন, “টার্গেট হচ্ছে সরকার, টার্গেট শেখ হাসিনা, টার্গেট গণতন্ত্র, টার্গেট আগামী নির্বাচন ভণ্ডুল করা।
“একেকদিন একেক মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করবে, এমন এজেন্ডা তাদের রয়েছে। মন্ত্রণালয়কে ব্যর্থ প্রমাণ করে রিপোর্ট করছে, মির্জা ফখরুল ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন।”
তিনি বলেন, “তারা বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, বিশ্ব সমাজের কাছে খাটো করার জন্য, বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য হেন কোনো তৎপরতা নেই যা বিএনপি নামক দল এবং প্রথম আলো নামক পত্রিকাটি না করছে।…বিএনপিকে সাধু বানানোর জন্য প্রচার প্রচারণার মূল দায়িত্ব প্রথম আলো নিয়েছে।”
সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে কাদের বলেন, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয় কয়েক মাস আমাদের দেশের পত্রিকায় টকশোতে কথা হচ্ছে। এজন্য সরকার কি একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে?
“তাহলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, এটা কেন বলা হচ্ছে? সাংবাদিকরা আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু প্রথম আলো আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে। বিএনপিকে ভাবি প্রতিপক্ষ, বিএনপি আমাদের ভাবে শত্রু।”
শুক্রবার ঢাকার পল্লবীতে বিএনপির এক ইফতার আয়োজনে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের উপর হামলার বিষয়টিও তুলে ধরেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “দাওয়াত দিয়ে সাংবাদিকদের মারধর করা হয়েছে। আর ফখরুল দাঁড়িয়ে প্রথমে দুঃখপ্রকাশ করে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা চান। পরপরই বলেন, আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা এ ঘঠনা ঘটিয়েছে।
“নিজেরা গোলমাল করে আওয়ামী লীগের ওপর দায় চায়। এই মিথ্যাচারের রাজনীতি বিএনপি করছে। এর সহযোগী হচ্ছে প্রথম আলো। কই একটা পত্রিকাতে তো এই সংবাদ আসল না, প্রথম আলোও করল না।”