দুই সিটিতে ইভিএমে ভোট হওয়ায় গণনার প্রয়োজন হবে না। মেশিন থেকে ফলাফল প্রিন্ট করে তাতে এজেন্ট ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সই নিয়ে পাঠানো হবে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখান থেকেই ঘোষণা করা হবে ফলাফল।
Published : 09 Mar 2024, 03:28 PM
কুমিল্লায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে গোলাগুলি, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ওপর হামলা এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধার অভিযোগ আর ময়মনসিংহে ইভিএমে ভোট দিতে ভোগান্তির মধ্যে শেষ হল দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
ভোট শুরুর পর কুমিল্লায় কয়েকটি কেন্দ্রে গোলযোগে উত্তেজনা ছড়ায় কিছু সময় ও প্রার্থীদের অভিযোগ ছিল বেশি। তবে ময়মনসিংহে গোলযোগ না থাকলেও ভোটারদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে বেশি।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এই দুই নগরে ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলে। দুই সিটির পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউপির দুই শতাধিক পদে নির্বাচন হয় এদিন।
বিধি অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দিতে থাকা ভোটারদের সবার ভোট নেওয়া হবে। পর কেন্দ্রে কেন্দ্রে চলবে গণনা।
তবে ময়মনসিংহ ও কুমিল্লাসহ যে সব নির্বাচনি এলাকায় ইভিএমে ভোট হয়েছে, সেখানে গণনার প্রয়োজন হবে না। মেশিন থেকে ফলাফল প্রিন্ট করে তাতে এজেন্ট ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সই নিয়ে পাঠানো হবে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। সেখান থেকেই ঘোষণা করা হবে ফলাফল।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দুই মাস বাদে শনিবারই বড় পরিসরে স্থানীয় সরকারের প্রথম ভোট হল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন বা দলীয় প্রতীক না দেওয়ার বিষয়টি ছিল এবারের নির্বাচনের প্রধান আলোচনার বিষয়।
ময়মনসিংহে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগের। এর বাইরে আছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী, কেবল তিনিই দলীয় প্রতীকে লড়ছেন।
কুমিল্লায় চার প্রার্থীর মধ্যে দুজনই আওয়ামী লীগের। ভোট বর্জন করা বিএনপির দুই বহিষ্কৃত নেতাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে আছেন। এই সিটিতে দলীয় প্রতীকে কারো প্রার্থী নেই।
কুমিল্লায় তিন প্রার্থী তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া এবং ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন সকাল থেকেই। এর মধ্যে এক কেন্দ্রের বাইরে গোলাগুলিতে দুজন আহত হন।
পাশাপাশি দুই সিটিতেই ইভিএমে ভোট দিতে আঙুলের ছাপ না মেলা এবং ধীর গতিতে ভোটগ্রহণের অভিযোগ আসে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বেলা ১২টায় জানান, স্মার্ট নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অ্যাপে পাওয়া আংশিক তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা সিটিতে বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে ২৭ শতাংশ পড়ে।
কুমিল্লায় গোলাগুলির বিষয়ে তিনি বলেন, “কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের একটি কেন্দ্রের বাইরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কেন্দ্রের বাইরে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।”
অভিযোগ বেশি কুমিল্লায়
কুমিল্লায় ভোটের শুরু থেকেই এজেন্টদের বের করে দেওয়া, এজেন্টের উপর হামলার অভিযোগ করে আসছিলেন কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু (টেবিল ঘড়ি), কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া) এবং কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি)। অন্যদিকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা (বাস) ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
এর মধ্যেই সকাল ১০টায় নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে গোলাগুলি হয়। পরে সেখান থেকে দুজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়।
স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত নেতা কায়সার এ ঘটনার জন্য কুমিল্লা সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে সূচনাকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, “আমার এজেন্টদের তারা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিবাদ করলে বাস প্রতীকের সন্ত্রাসীরা আমার নেতাকর্মীদের ওপর গুলি চালায়।”
বাস প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভোটার ও এজেন্টদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন দুই বারের সাবেক এমপি সাক্কুও। তবে তিনি ‘শেষ পর্যন্ত’ লড়াইয়ে থাকার কথা বলেন।
সাক্কু বলেন, “নির্বাচনে আমি লাস্ট পর্যন্ত আছি। নির্বাচনের লাইগাতো থাকা না থাকার ব্যাপার না, সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কিনা সেটা দেখার ব্যাপার। আমার চাওয়া হইল, জনগণ কেন্দ্রে যাইব, ভোট দিব, যে ইচ্ছা পাস করব। কিন্তু পোলিং এজেন্ট ঢুকাইতে পারতেছি না, আর জনগণ ভোট দিতে যাইব কেমনে?”
হাতি প্রতীকের প্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম অভিযোগ করেন, বাস প্রতীকের প্রার্থী সব জায়গায় ‘শক্তি প্রয়োগ’ করছে।
“হাজী আকরাম উদ্দীনে (হাজী আকরাম উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে) কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দিচ্ছে না। এজেন্ট যারা ভেতরে ঢুকেছে, তাদেরকে হুমকি দিয়ে ভেতরে বসিয়ে রাখা হয়েছে, বাইরে থেকে কোনো লোককে যেতে দিচ্ছে না, ভোটারদের যেতে দিচ্ছে না। শুধু তাদের চিহ্নিত ভোটাররা সেখানে গিয়ে ভোট দিচ্ছে।”
সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসীন বাহার সূচনা সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিপক্ষের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি সকাল থেকে খোঁজ নিয়েছি। সব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোট হচ্ছে।”
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার ওসি আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া জানান,ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষের ঘটনায় আবু সুফিয়ান অন্তু নামের একজনকে পুলিশ আটক করেছে।
অন্তু কুমিল্লা মহানগর ছাত্রদলের সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা পেলে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছেন ওসি।
কুমিল্লা সিটি
১০৫টি ভোটকেন্দ্র
ভোটার দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন
প্রার্থী: কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু (টেবিল ঘড়ি), কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া), কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা (বাস) এবং কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি)
এই সিটিতে ২০১২ সালের নির্বাচনে ৭৫%, ২০১৭ সালে ৬৪% এবং ২০২২ সালে ৫৯% ভোট পড়ে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনে ভোট পড়ে ৩৯%।
ময়মনসিংহে ইভিএম বিড়ম্বনা
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে বড় কোনো গোলযোগের খবর না এলেও ইভিএমে ভোটগ্রহণের গতি কিছুটা ধীর হওয়ায় এবং অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের।
প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ৮২ বছর বয়সী লায়লী বেগম দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরও ভোট দিতে না পেরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভোটকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।
হতাশা ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, “আর কয়টা দিন বাঁচি কওন যায় না। এই জীবনে আর ভোট দিতাম পারি কিনা জানি না। মনডা বেশি খারাপ অইয়া গেছে।”
তার মতো আরও অনেকেই ভোট দিতে না পেরে ফিরে যেতে দেখা যায়। প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী ভোটকেন্দ্রটির প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, “ইভিএম মেশিন ঠিক আছে। অনেকের আঙুলে ময়লা, কাজ করার কারণে হাতের রেখায় পরিবর্তন হয়। এসব কারণে এরকম হচ্ছে।”
ইভিএমে ভোটগ্রহণের গতি কিছুটা ধীর হলেও ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মেয়র প্রার্থী মো. ইকরামুল হক টিটু।
তিনি বলেছেন, “ভোটারদের ব্যাপক সাড়া রয়েছে। তবে ইভিএমে ভোট দিতে ধীরগতি হচ্ছে।”
সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি টিটু এবার টেবিল ঘড়ি প্রতীকে ভোট করছেন।
ভোটে প্রভাব খাটানোর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “হাতি প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাদেকুল হক খান মিল্কীর এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
ময়মনসিংহ সিটি
১২৮টি ভোটকেন্দ্র
ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন
প্রার্থী: মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু (দেয়াল ঘড়ি), জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক), শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কী টজু (হাতি প্রতীক), কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সদস্য কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক) এবং জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল (লাঙ্গল প্রতীক)
২০১৯ সালে ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী কেবল একজন হওয়ায় ভোট করতে হয়নি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে ভোটের হার ছিল ৪৪%।
ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচন: আঙুলের ছাপের জটিলতায় ফিরছেন অনেকেই
কুমিল্লায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ ২
দুই সিটিতে প্রথম চার ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ২৬%: ইসি
সূচনা বললেন, অভিযোগ ‘মিথ্যা’, পরিবেশ ‘সুষ্ঠু-সুন্দর’
কুমিল্লায় ভোট: এজেন্ট বের করা, ভোটারদের হুমকির অভিযোগ তানিমের