“জীবনে আর ভোট দিতাম পারি কিনা জানি না। মনডা বেশি খারাপ অইয়া গেছে। ”
Published : 09 Mar 2024, 12:05 PM
জীবনে বহুবার ভোট দিয়েছেন লায়লী বেগম, কিন্তু ৮২ বছর বয়সে এসে প্রথমবারের মতো ভোট না দিয়েই কেন্দ্র থেকে ফিরেছেন তিনি।
ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মেলায় ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনের ভোট দিতে না পারা এই বৃদ্ধা আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, “জীবনে কতো ভোট দিলাম। এইরহম কাণ্ড আর দেহি নাই। আমার ভোট আমি দিতাম পারলাম না। “
প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা এই বৃদ্ধার ভোটার নাম্বার ১১২৩। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরও ভোট দিতে না পেরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভোটকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।
হতাশা ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, “আর কয়টা দিন বাঁচি কওন যায় না। এই জীবনে আর ভোট দিতাম পারি কিনা জানি না। মনডা বেশি খারাপ অইয়া গেছে। ”
সকাল ৮ টা থেকে ইভিএমে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর সকাল সোয়া ৯টার দিক থেকেই দেখা যায় তার মতো আরও অনেকেই ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন।
তেমনই আরেক নারী নগরীর কালীবাড়ি কবরখানা এলাকার বাসিন্দা ফরিদা ইয়াসমিন। ১৯৬৩ সালে জন্ম নেওয়া এই নারীর ভোটার নম্বর ০০৯০।
সকালে ঘণ্টা খানেক লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট কক্ষে ঢুকেছেন। কিন্তু সুযোগ পাননি নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের।
বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে বাড়ি ফেরার পথে এই নারীর কণ্ঠে ঝরল ক্ষোভ। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও নিজের ভোট দিতে পারলাম না। আমার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রও ছিল, তবুও কিছু হল না।”
কেন্দ্রের ভোট গ্রহণে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাকে পরে আসার কথা বলে বিদায় করলেও ফের কেন্দ্রে আসার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার কথা বলছেন তিনি।
একইভাবে এই কেন্দ্র থেকে ভোট দিতে না পেরে ফিরে গেলেন ৬৮ বছরের ভারতী ভাসফোর। তার ভোটার নাম্বার ১১৪৪।
তিনি বলেন, “ফিঙ্গার মিলে নাই। ভোটটা দিতাম পারলাম না। পরে আইতে কইছে। পরে আর আইয়া কি অইবো।”
তবে সঙ্গে আসা তার মেয়ে দিপালী বাসফোর ভোট দিতে পেরেছেন। তিনি বলেন, “সকাল ৭টার দিকে আইছি কেন্দ্রে। আমি দিতাম পাররাম, মা ভোটটা দিতে পারলো না। তার মতো অনেকেই ভোট দিতে পারতেছে না।”
ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাওয়ার সময় কথা হয় কালীবাড়ি এলাকার ৫৬ বছর বয়সী ভোটার রাহেলা আক্তারের সঙ্গেও।
তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে ৭টার সময় ভোট দিতে আইছি। লাইনে দাড়ায়া থাইক্যা ৯টার দিকে ভোট দিতাম ঢুকলাম। পরে হেরা কয় ফিঙ্গার মিলে না। কইনছেন দেহি, এইটা কি আমার দোষ।”
ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, “হেরা ভোটের মেশিন ঠিক না রাইখ্যা ভোট নিতাছে কেন। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটের কার্ডটাতো ঠিকি আছে। আমার ভোটটা দিতাম পারলাম না। এইডার জবাবডা কেডা দিবো। ”
তবে প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী ভোটকেন্দ্রটির প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, “ইভিএম মেশিন ঠিক আছে। অনেকের আঙুলে ময়লা, কাজ করার কারণে হাতের রেখায় পরিবর্তন হয়। এসব কারণে এরকম হচ্ছে।
“তবে তাদেরকে বলা হচ্ছে হাত পরিষ্কার করে আসার জন্যে। তাদের ভোট গ্রহণের জন্যেও আমরা চেষ্টা করছি।”
ইভিএমে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটার শনাক্তে স্মার্টকার্ড ব্যবহার বা স্মার্টকার্ডের আইডি নম্বর বা ১৩/১৭ ডিজিটের এনআইডি নম্বর অথবা আঙুলের ছাপ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভোটারদের সবাই এখনও স্মার্টকার্ড না পাওয়ায় সবার দশ আঙুলের ছাপও ইসির তথ্যভাণ্ডারে নেই।
ফলে যাদের দুই আঙুলের ছাপ দেওয়া আছে, সেটা তথ্যভাণ্ডারের সাথে না মিললে ভোটার শনাক্তে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
যখনই ইভিএমে ভোট হয়েছে, দেখা গেছে বয়স্ক অনেকের আঙুলের ছাপ মিলছে না। কারণ বয়সের কারণে চামড়া কুঁচকে গেলে বা ভারী শ্রমের কাজে হাতের ত্বকে পরিবর্তন এলে যন্ত্রের পক্ষে আঙুলের ছাপ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
তবে আঙ্গুলের ছাপের জটিলতায় প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিজের আইডি ব্যবহার করে কেন্দ্রের মোট ভোটারের ১ শতাংশের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারেন।
এই বিষয়ে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, “কেন্দ্রে ৩ হাজার ২২০ জন নারী ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রেই জটিলতা হচ্ছে। কয়েকজনকে ভোটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।”
তবে কতজন ভোটারকে এমন সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তা জানাতে পারেননি তিনি।
ময়মনসিংহ আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের আঞ্চলিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী জানান, সকাল ৮টা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। নির্বাচনে পাঁচ মেয়র, ১৪৯ সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৬৯ সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে লড়ছেন।
নগরীর ৩৩ ওয়ার্ডের ১২৮টি ভোটকেন্দ্রের ৯৯০ বুথে দেড় হাজার ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলছে।
প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে চারজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে পাঁচজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
স্ট্রাইকিং ফোর্সের পাশাপাশি সাত প্লাটুন বিজিবি, ১১ প্লাটুন পুলিশ, আর্মড পুলিশ এবং আনসার সদস্য, ১৭ টিম র্যাব ছাড়াও ৩৩ জন নির্বাহী হাকিম (ম্যাজিস্ট্রেট) এবং ১১ জন বিচারিক হাকিম (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) দায়িত্ব পালন করছেন।
ভোটে ৩৩টি ওয়ার্ডের তিন লাখ ৩৬ হাজার ৪৯০ ভোটারের মধ্যে এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৭১ জন পুরুষ এবং এক লাখ ৭২ হাজার ৬১০ জন নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৯ জন।
টেবিল ঘড়ি প্রতীকের সদ্য সাবেক মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটুর সঙ্গে মেয়র পদের ভোটের লড়াইয়ে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক) এবং শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কী টজু (হাতি প্রতীক)।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাবেক সদস্য কৃষিবিদ ড. রেজাউল হক হরিণ এবং জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়ছেন।
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর ময়মনসিংহ পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন ঘোষণার গেজেট হয়। পরের বছর ৫ মে ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। যদিও সিটির প্রথম ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন টিটু। ওই ভোটে কেবল কাউন্সিলর পদগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।