ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধে দরকার পুতিনের পতন, গাজায় হামলা বন্ধ তবে কার পতনে?

দুই বছরে রুশ বাহিনীর আক্রমণে যে পরিমাণ ইউক্রেইন নাগরিক নিহত হয়েছে, গত ছয় মাসে তার তিনগুণ নিহত হয়েছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 27 March 2024, 06:43 PM
Updated : 27 March 2024, 06:43 PM

ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের একটি মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। কিন্তু সাক্ষাৎকারটি আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের আগেই প্রকাশ হয়ে যায়। সেখানে তিনি বলেছেন, “রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেইনের শান্তি আলোচনার সাহস থাকা উচিত।” সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হবার পর ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, “ন্যায়সঙ্গতভাবে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির উপায় হচ্ছে পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো।” তাকে গণহত্যাকারী হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “অত্যাচারীর পতন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসবে না।”

দ্য গার্ডিয়ানের মতামত কলামে সাইমন টিসডাল এই বিষয়টি তুলে ধরে একটি বিশ্লেষণ হাজির করেন। রাশিয়ার ইউক্রেইন অভিযান ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা যে প্রধান যুক্তিটি তুলে ধরে তা হলো, রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে যদি প্রতিহত করা না যায়, তাদের পরাজয় যদি নিশ্চিত করা না যায়— তাহলে পৃথিবীর কোনো দেশ নিরাপদ থাকবে না। রাশিয়ার এই কাজ বৈধ হলে বিশ্বে উদাহরণ তৈরি হয়ে থাকবে যে, যার ক্ষমতা আছে সে শক্তি দিয়ে যে কোনো দেশ ও অঞ্চলকে দখল করে নিতে পারবে। সাধারণ ‍যুক্তিতে তাদের এই বক্তব্য ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য মনে হলেও বিয়ষটি কি আসলে এতটা নিরীহ ও সরল? মোটেই তা নয়, এর আছে দীর্ঘ আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কূটনীতি ও পরাশক্তির দ্বন্দ্ব। যার দায় মার্কিন ও পশ্চিমারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। তাদের ছকেই ইউক্রেইনকে দিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধের ফাঁদে টেনে আনা হয়েছে। যাতে করে রাশিয়া কোনোভাবেই বিশ্বশক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।

তারা যুক্তি দিচ্ছে, রাশিয়ার এই আগ্রাসন বিশ্বে খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে! কিন্তু এই উদাহরণ কি রাশিয়া প্রথম তৈরি করেছে? ফ্রান্স, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র কি শতাব্দীর পর শতাব্দী সারা দুনিয়ায় তা চালিয়ে যায়নি? এখানও চালাচ্ছে না? আমেরিকা কি মিথ্যা অজুহাতে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ার মতো দেশসমূহকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়নি? লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা এবং কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করেনি? ম্যাক্রোঁর ফ্রান্স আফ্রিকার দেশে দেশে তাদের পছন্দের অনুগত শাসক বসিয়ে দখল ও অত্যাচারের রাজত্ব কায়েম করেনি? ব্রিটেন কি এশিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেনি? শতাব্দীর পর শতাব্দীর তারা শাসন-শোষণ লুণ্ঠন করেনি? সময়ের পরিবর্তনে তারা তাদের দখল-শোষণের কৌশল পরিবর্তন করে তাদের লুণ্ঠন আজও অব্যাহত রেখেছে। তাহলে তারা কোন নৈতিকতায় ও যুক্তিতে রাশিয়াকে এমন অপবাদে অভিযুক্ত করছে?

কাহিনী নিশ্চয়ই অন্য কিছু? এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হোক সেটা পশ্চিমারা চায় না, তাকে তারা মেনে নেবে না। সেটাই এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার মূল কারণ নয় কি?

ম্যাক্রোঁর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, তারা পুতিনের পতন চান, প্রত্যাশ করেন। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকার আগাম শিরোনামও হয়, পুতিনের মৃত্যু হলে কি হবে রাশিয়ার? কে ধরবেন দেশটির হাল? ইত্যাদি। তার নানামাত্রিক বিশ্লেষণও তৈরি করছেন? তারা শুধু ওই কথা বলেই ক্ষ্যান্ত নয়। ওই চেষ্টাও কি করছে না? করছে। তারা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যত তৎপর পুতিন তত শক্তপোক্ত হয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসছেন। সেখানে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি পুতিনের এককেন্দ্রিক শাসন ও ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকাকে সমর্থন করি না। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে রাশিয়ায় তার জনপ্রিয়তা আছে। তারা মনে করেন এই মুহূর্তে রাশিয়ার তার কোনো বিকল্প নেই। দেশের সিংহভাগ মানুষ তাকে সমর্থন করেন। রুশ জনগণ মনে করে পশ্চিমারা রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চায় ও তাদের ক্ষতি করতে চায়। তারা সেখানে তাদের অনুগত শাসক চায়। তারা বিশ্বশক্তি হিসেবে রাশিয়ার উত্থানকে ঠেকাতে চায়। এমতাবস্থায় তারা মনে করে রাশিয়ার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পুতিনের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। সর্বশেষ মধ্য মার্চের ৩ দিনের নির্বাচনের ফলাফল ওই কথাই প্রমাণ করেছে।

কিন্তু পশ্চিমারা মনে করে পুতিনের দেশে তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তিনি গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছেন। বিষয়টি কি আসলে তাই? একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই তিনি তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপর্যয়ের পর তিনিই দেশটিকে বিশ্ব পরাশক্তি হিসেবে আবারও মর্যাদার স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কিন্তু পুতিনের পতন কবে, কীভাবে হবে? তারা কি সেটা বলতে পারেন? আপাতত ২০৩০ সাল পর্যন্ত পুতিন তার ক্ষমতায় থাকাকে নিশ্চিত করেছেন। যদি কোনো দৈব না ঘটে তিনি আরও ৬ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তার মানে ইউক্রেইনকে আরও ৬ বছর যুদ্ধ টেনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপরও সেটা শেষ হবে— এমন নিশ্চয়তা কোথায়? তাহলে? যুদ্ধের দুই বছরেই পশ্চিমা শক্তি হাঁপিয়ে উঠেছে। মার্কিন সাহায্য আটকে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের টানাপোড়েন, ন্যাটোতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলমান। সম্প্রতি জেলেনস্কিই তার বক্তব্যে এমন অভিযোগ, অভিমানের কথা উল্লেখ করেছেন। যে মার্কিন নেতৃত্বে ইউক্রেইন যুদ্ধ প্রযোজিত হচ্ছে সেখানেও পরিবর্তন অত্যাসন্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যুদ্ধ ও সাহায্য বন্ধের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। জেলেনস্কি ওই কারণে মিডিয়াতে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করতে ভুলে যাননি।

পুতিনের পতন হলে ইউক্রেইন যুদ্ধের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে— সেই সুখ স্বপ্নের ঘোরে ম্যাক্রোঁ, জেলেনস্কিরা থাকুক। কিন্তু ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা করে ধুলোয় মিশিয়ে দিল, সেটা বন্ধ হবে কীভাবে? কার পতনে? কার কোমরের শক্তিতে নেতানিয়াহু এতটা বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন? জাতিসংঘ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাজার মাটিকে শ্মশান ও পোড়া মাটিতে পরিণত করা হচ্ছে? জাতিসংঘে কারা, কোন শক্তি বার বার ভেটো প্রদান করছে? তাহলে ওই শক্তির পতন না হলে কি গাজার হত্যা ও রক্তপাত বন্ধ হবে না?

সাইমন টিসডালরা সে কথা বলেন না, লিখতে পারেন না, তাদের দম ফুরিয়ে যায়। গাজার যুদ্ধ শুরু হয়েছে গত বছর ৭ অক্টোবর, তার মানে এই যুদ্ধ চলছে প্রায় ৬ মাস। আর ইউক্রেইনের যুদ্ধ তিন বছরে পড়ল। ইসরায়েলের হামলা-আক্রমণে গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার, আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ নারী-শিশু, সাংবাদিক শতাধিক, মানবাধিকার কর্মী কয়েকশ, যাদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতার এমন কোনো নজির নেই যে, এই মার্কিন সমর্থিত এই ইসরায়েল শাসক গাজায় করেনি।

২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর এখন পর্যন্ত ইউক্রেইন যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ৭০৩ জন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৫৯৪ জন। দুই বছরে রুশ বাহিনীর আক্রমণে যে পরিমাণ ইউক্রেইন নাগরিক নিহত হয়েছে, গত ছয় মাসে তার তিনগুণ নিহত হয়েছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে। তাহলে এই যুদ্ধ দুই বছর টানলে নিহতের সংখ্যা কত হবে? ওই কথা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

তাদের উদ্দেশ কী? ইউক্রেইনে শান্তি না পুতিনের পতন? পুতিনের পতন না হওয়া অবধি কি হত্যা, ক্ষতি, ধ্বংস অব্যাহত থাকবে? প্রতিপক্ষকে মঞ্চ থেকে সরাতে ইউক্রেইন নামের দেশটিকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে? কিন্তু সেটা কি সম্ভব?

রাশিয়া কি ইরাক বা লিবিয়ার মতো কোন দেশ? পুতিন কি সাদ্দাম-গাদ্দাফির মতো কোনো শাসক বা নেতা যে, তারা স্বপ্ন দেখেন মাটির কোনো গর্ত বা মরুভূমির ধুলো থেকে তাকে আবিষ্কার করবেন? পুতিনের তর্জনী উঁচানো হুঙ্কার কি পশ্চিমারা বুঝতে অক্ষম? এতটা নাদান কি তারা? তাহলে কীসের ভরসায়, কোন ছকে সিংহের সামনে মেষ শাবককে এভাবে ছেড়ে দিলেন?