একুশে অগাস্ট: ভয়াল সেই স্মৃতি

সেদিনের সন্ধ্যায় মানুষের আর্তনাদ, ছোটাছুটি, ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাঁচার এবং বাঁচানোর আকুতির দৃশ্যগুলো মনে পড়লে আজও শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 August 2023, 06:10 PM
Updated : 20 August 2023, 06:10 PM

একুশে অগাস্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও একটি কালো অধ্যায়। যে অধ্যায়টি রচনার সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নেতৃত্বের যোগ ছিল। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল, এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন করে দেয়ার এক নৃশংস ঘটনার দিন এই একুশে অগাস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যার চেষ্টা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।

একুশে অগাস্টের ঘটনা ১৯৭৫ সালের পনেরো অগাস্টের ঘটনারই ধারাবাহিকতা। ৭৫-এ যা সম্পূর্ণ হয়নি, তা-ই করতে চেয়েছিল ঘাতকরা একুশে অগাস্টে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টায় গ্রেনেড হামলা, হামলাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া, তদন্তের নামে জজ মিয়া আবিষ্কার, বিচার বিভাগীয় তদন্ত রসিকতা, ‘আওয়ামী লীগই করেছে, শেখ হাসিনা আঁচলের তলে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছে’ বলে প্রচারণা চালানো, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে জোর করে ফুটেজ নিয়ে যাওয়া এবং ধ্বংস করে ফেলা, এসবই করেছিল বিএনপির মন্ত্রী ও নেতারা। তখন বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল বিএনপি সংসদে পর্যন্ত কথা বলতে দেয়নি।

তারা সেদিন পরিকল্পিতভাবে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়েছিল, তা কেবল একা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার লক্ষ্যেই নয়, সমগ্র জাতির স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে অন্ধকারে নিক্ষেপের এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে।

বয়সের কারণে পঁচাত্তরের পনেরই অগাস্টের ঘটনার কথা স্পষ্ট মনে নেই, কিন্তু ২১ অগাস্টের ঘটনাটি স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন সংবাদে কাজ করি। কার্টুনিস্ট কুদ্দুস (যিনি কিছুদিন আগে অকালে প্রয়াত হয়েছেন) অনেকক্ষণ ধরেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ দেখতে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। হাতের কাজ শেষ করতে করতে সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। ততক্ষণে কুদ্দুস সমাবেশ দেখতে চলে গেছে। কথা ছিল কাজ শেষ করে আমি ওখানে গিয়ে কুদ্দুসের সঙ্গে যোগ দেব।

সাড়ে পাঁচটার পর আমি বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশ দিয়ে এগোতে থাকি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দিকে। জিপিওর সামনে যেতেই কয়েকটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের আওয়াজ কানে এলো। গুলিস্তান সিনেমা হলের দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখতে পেলাম। মুহূর্তেই দেখি সমাবেশে আসা মানুষজন দিগ্বিদিক ছুটছে। আমি জিপিওর কোনায় স্টেডিয়াম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যাই। জিরোপয়েন্ট এলাকায় একটা দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানকে দ্রুত চলে যেতে দেখি।

শুনতে পাই আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে বলেন যে শত শত মানুষ মারা গেছে! আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খানিকক্ষণ একা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি!

একটু পরেই দেখি রক্তাক্ত ছিন্ন-ভিন্ন শরীরের অনেককে রিকশা ও ভ্যানে করে জিপিওর সামনে দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়া হচ্ছে। কাউকে কাউকে কোলে-কাঁধে ধরাধরি করে আনা হচ্ছে। রিকশা-ভ্যান-গাড়ি কিছুই নেই। অসহায় সহকর্মীরা চিৎকার করছে! কাঁদছে!

ভয়ে-আতঙ্কে-রাগে-ক্ষোভে-অসহায়তায় পুরো এলাকার পরিস্থিতি ভয়াল হয়ে ওঠে। ওখানে দাঁড়িয়ে গ্রেনেডে ঝলসানো ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা কয়েকটা শরীর দেখে আমিও প্রায় নিঃসাড় হয়ে যাই!

এরপর আমি কী করেছিলাম, কীভাবে বাসায় ফিরেছিলাম কিছুই মনে নেই। তবে বাসায় ফিরতে রাত হয়েছিল–এটুকু শুধু মনে আছে। একুশে অগাস্ট আমার জীবনেও একটি দুঃসহ ভয়াল স্মৃতি! সেদিনের সন্ধ্যায় মানুষের আর্তনাদ, ছোটাছুটি, ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাঁচার এবং বাঁচানোর আকুতির দৃশ্যগুলো মনে পড়লে আজও শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়!

শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঘটনাটা বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের জ্ঞাতসারেই হয়েছে। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার পরও কিন্তু এই হামলার দায় আওয়ামী লীগের ওপরই চাপানো হয়েছিল। অনেকে তা বিশ্বাসও করেছিল! ১৯৭৫ সালে যেভাবে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক একই রকম ছক ছিল ২১ অগাস্টেও। দৈবক্রমে গ্রেনেডটি মঞ্চে ফাটেনি!

এরপর ২১ অগাস্টের ঘটনাটিকে আড়াল করা, আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপানো, জজমিয়া নাটক সাজানো সব কিছুই করা হয়েছে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে সে সময়ে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিল। পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করতে বলা হয়েছিল। তৎকালীন সরকার এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করেছে।

আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়।

২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের এমপিরা ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে। তখন বিএনপি ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল।

ক্ষমতাসীনরা দেশবাসীকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিল যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকার ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে ওইসব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। সরকার সমর্থক লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন, প্রচার করেছিলেন।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর, সশস্ত্র বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের দেড় বছরে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। আদালতের রায়ে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জেনেশুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ও প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল।

‘রাজনীতি মানে কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে?’ ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালত এমন মন্তব্যই করেছিল। উল্লেখ্য, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার দায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির আদেশ এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। এ ছাড়া আরও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

বিএনপির নেতারা এখন গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে মায়াকান্না কাঁদেন। কিন্তু একুশে অগাস্টের এই কলঙ্ক থেকে কীভাবে মুক্ত হবেন তারা? সভ্য জগতে কোনো সরকার বা দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার জন্য এমন বর্বর পন্থাকে মদদ জোগাতে পারে তার উদাহরণ বিরল।

২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কলঙ্কিত ঘটনা। দল হিসেবে বিএনপি কোনো যুক্তিতেই এই হত্যার রাজনীতির দায় থেকে রেহাই পেতে পারে না। আওয়ামী লীগের শত ত্রুটি-বিচ্যুতি-অপরাধ সত্ত্বেও না। এই বিএনপির সঙ্গে জোট করে যারা ‘গণতন্ত্র উদ্ধারের’ নামে মাতামাতি করছেন, তারাও কি নৈতিক অপরাধে অপরাধী নন? তারাও কি বিএনপির রাজনৈতিক পাপের ভাগীদার হিসেবে ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হবেন না?

একুশে অগাস্টের ভয়াল সেই স্মৃতি ভোলা যায় না। ভোলা উচিতও নয়। দার্শনিক সান্তয়ানা বলে গেছেন, যারা অতীতকে মনে রাখতে পারে না তাদের আবার সেই অতীতের জীবন পুনর্যাপনের শাস্তি পেতে হয় (Those who do not remember the past are condemned to relive it)। আশা করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একুশে অগাস্টের মতো ঘৃণ্য ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। একুশে অগাস্ট সৃষ্টিকারীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তা না হলে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরাই পরাজিত হবে।