সব পক্ষের অনড় অবস্থান ফ্রান্সের রাজনীতিতে বিভাজনের মাত্রা তীব্র করেছে। এর সবকিছুই পেনের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থিদের রাজনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে।
Published : 04 Sep 2024, 01:13 PM
ফ্রান্সে জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফার সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে একটা উদ্বেগ ছিল। তাদের উদ্বেগের মূল কারণ ম্যারি লো পেনের দক্ষিণপন্থি ন্যাশনাল র্যালি (এনআর) নির্বাচনে জয়লাভ করলে ফ্রান্সের সঙ্গে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ কী হবে এ প্রশ্নে। উল্লেখ্য, পেন ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি দলটির একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে সক্রিয় থাকলেও দলটি আবর্তিত হচ্ছে তাকে ঘিরে।
শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই নয়, পেন এবং তার দলকে ঘিরে উদ্বেগ রয়েছে বাম এবং মধ্যপন্থার সমর্থক ফরাসি জনগণ, অভিবাসী এবং মুসলমান কমিউনিটির মাঝেও। এ উদ্বেগ চরম মাত্রায় পৌঁছায় প্রথম দফার নির্বাচনে এনআর চরম দক্ষিণপন্থি দলগুলোকে নিয়ে যে জোট করেছে, ওই জোট অন্যান্যদের চেয়ে সংসদীয় আসনে এগিয়ে থাকায়।
এনআরের উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান সংক্রান্ত উদ্বেগ থেকেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উদ্যোগে উদার মধ্যপন্থী ধারার দলগুলো নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বরে গঠিত হয় এনসেম্বল জোট। অপরদিকে, বামপন্থি দলগুলো নির্বাচনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবার জন্য ২০২৪ সালের ১০ জুন প্রতিষ্ঠা করে নিউ পপুলার ফ্রন্ট, যেটাকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় নুভ ফ্রন্ট প্পুলারিয়ে বা সংক্ষেপে এনএফপি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবেই ফ্রান্সে বাম ধারার দলগুলোর একটা জোরাল অবস্থান রয়েছে। এনআর সম্পর্কে বামপন্থিদের মূল্যায়ন হল—১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখলে নেবার পর নাৎসি জার্মানি যে ফ্যাসিবাদী ভিসি সরকার প্রতিষ্ঠা করে—আজকের পেনের দল হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতা।
১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপ জুড়ে যে ফ্যাসিবাদের উত্থান, তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য ফ্রান্সের বাম দলগুলো একত্রিত হয়ে ১৯৩৬ সালে গঠন করেছিল পপুলার ফ্রন্ট। এ ফ্রন্টের বিষয়টা মাথায় রেখেই বাম দলগুলো এবার গঠন করেছে এনএফপি। নানাবিধ মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে, যখনই অতি ডানপন্থীরা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখনই ফ্রান্সের বামদলগুলোকে নিজেদের দ্বন্দ্বকে সরিয়ে এক প্ল্যাটফরমে সামিল হতে। এনএফপিতে দশটি দল থাকলেও মূল রাজনৈতিক দল হচ্ছে চার: ফ্রান্স আনবয়েড, সমাজতান্ত্রিক দল, গ্রিন পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি।
প্রথম দফার নির্বাচনে সবাইকে বিস্মিত করে এনএফপি পেনের রাজনৈতিক জোটের চেয়ে সামান্য ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। একইসঙ্গে এনআর নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচনী সাফল্য বাম এবং মধ্যপন্থীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি করে। তারা দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে পেনের জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠেকাতে বদ্ধপরিকর হয়। এরই অংশ হিসেবে বাম এবং মধ্যপন্থীদের মাঝে এক ধরনের অলিখিত সমঝোতার জের হিসেবে দুই শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াবার জন্য।
প্রথম দফায় নির্বাচন ভোটের হার কম থাকলেও দ্বিতীয় দফায় ব্যাপকহারে জনগণ ভোট দিতে এগিয়ে আসে। ভোটের হার বৃদ্ধি, অলিখিত নির্বাচনী সমঝোতা, এসব কিছুর পরেও পেনের সমর্থকরা ধরে নিয়েছিলেন তারাই এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে।
পশ্চিমের কাছে ‘পুতিনপন্থী’ হিসেবে পরিচিত পেনের জোট বিজয়ী হলে রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি এবং ফ্রান্সের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্কের স্বরূপ— এসব প্রশ্নে হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়া বাদে বাকি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো উদ্বিগ্ন ছিল। অতি ডান বা বামপন্থিরা না জিতে ম্যাক্রোঁ সরকারের মধ্যপন্থীরা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাক, এটা ছিল তাদের চাওয়া। কিন্তু দ্বিতীয় দফাতেও এনএফপি সবাইকে পিছনে ফেলে বেশি আসন লাভ করে। দুই দফার নির্বাচনে তাদের সমন্বিত আসন দাঁড়ায় ১৮০।
বেশি আসন পেলেও ৫৭৭ আসনে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যে ২৮৯টি আসন দরকার তার ধারেকাছেও এ বামপন্থি জোটসহ কোনো দল বা জোটই যেতে পারেনি। প্রথম দফায় এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় দফায় এসে এনআর মোট ১৪২টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে আসে। আসন কম পেলেও প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুই দফার নির্বাচনেই প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে পেনের জোট সবচেয়ে বেশি ভোট লাভ করে। সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে এনএফপি যেখানে পেয়েছে ২৬.৩ শতাংশ ভোট, সেখানে আরএন পেয়েছে ৩৭.১ শতাংশ ভোট। ফলে নির্বাচন পরবর্তী পেনের মন্তব্য ছিল, “আমরা আস্তে আস্তে ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি”— নির্বাচনি ফলাফল যেন তারই প্রতিধ্বনি করে।
পেনের চিন্তাধারার আলোকেই মূলত ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত আরএন পরিচালিত হচ্ছে। তিনিসহ তার দলের সমর্থকেরা উদারনৈতিকতার বিপরীতে ক্যাথলিক মূল্যবোধ-নির্ভর রুক্ষণশীল রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা দেখতে চান। এর অংশ হিসেবে তারা সমকামী সম্পর্ক এবং অপ্রয়োজনীয় গর্ভপাতের বিরোধী। ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা হলেও তারা আবার সেটা ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনতে চান।
পেনের সমর্থকরা মুক্তবাজার-নির্ভর পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিপক্ষে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকার পক্ষপাতি। পেন বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বিরোধী এবং এরই সূত্র ধরে মুসলমানদের কোরবানি প্রথারও বিরোধী। তার দল অভিবাসনকে খুবই সীমিত করে নিয়ে আসার পক্ষপাতী। কেননা তারা মনে করেন, অবাধ অভিবাসন এবং মুসলিম সংস্কৃতির ফলে ফ্রান্স তার নিজস্ব আত্মপরিচয় এবং সংস্কৃতি হারাতে বসেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে পেনের দল ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থক, ন্যাটোর ভূমিকার সমালোচক এবং রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার অনুসারী।
পেনের পাশাপাশি পশ্চিমা দুনিয়া এনএফপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা, ফ্রান্স আনবয়েডের প্রধান, লিওন ট্রটস্কির চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত জাঁ-লুক মেলেনশোনকে নিয়েও উদ্বিগ্ন। নারীবাদ, অভিবাসী এবং মুসলিম অভিবাসীদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণকারী মেলেনশোন নিউ লিবারেল অর্থনীতির কঠোর সমালোচক। তিনি ধনিক শ্রেণির উপর কর বৃদ্ধিসহ সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক অর্থনীতির সমর্থক। বস্তুত, এর মধ্য দিয়ে আর্থ-সামাজিক যে শ্রেণি বৈষম্য, সেটি দূর হয়ে ক্রমান্বয়ে ফ্রান্সে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটবে বলে তার ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কট্টর সমালোচক মেলেনশোন ন্যাটো জোটেরও কঠোর সমালোচক। তিনি মনে করেন, ফ্রান্সের ন্যাটো থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ; কেননা এ জোট ফ্রান্সের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সমর্থক মেলেনশোন মনে করেন গাজাতে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে। পশ্চিমা ধারণার বাইরে গিয়ে মেলেনশোন মনে করেন ইসরায়েল একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র।
মেলেনশোন এবং পেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রায় সবকিছুতে ভিন্ন মেরুতে অবস্থনা করলেও রাশিয়া প্রশ্নে তাদের অবস্থান অনেকটাই কাছাকাছি। বস্তুত এটাই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর জন্য অস্বস্তির কারণ। এ দুই পক্ষের কেউ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার জন্য ২৮৯টি আসন না পাওয়াতে ফ্রান্সে ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হয়েছে। মধ্য এবং বামপন্থিরা অলিখিত নির্বাচনী সমঝোতা করলেও তাদের কেউই সমঝোতা করে সরকার গঠন করতে আগ্রহী নয়। যদি সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে এক বছরের মধ্যে আবার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন দিতে হবে।
সব পক্ষের অনড় অবস্থান ফ্রান্সের রাজনীতিতে বিভাজনের মাত্রা তীব্র করেছে। এর সবকিছুই পেনের নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থিদের রাজনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবং এর ধারবাহিকতায় আগামী দিনগুলোতে যদি দক্ষিণপন্থিরা ক্ষমতাসীন হতে পারেন, তাহলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাম এবং দক্ষিণপন্থিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়েও সংঘাতের মত পরিস্থিতি আমরা দেখতে পারি, যার কিছুটা নমুনা আমরা প্রথম দফা নির্বাচনের পর দেখেছি। অপরদিকে, ‘পুতিনের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত পেন যদি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যান, তাহলে সেটা ইউরোপের রাজনীতিতে রাশিয়াকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে এবং মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করবে।