Published : 12 Oct 2019, 04:24 PM
সময়টা ১৯৯৭-৯৮। '৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের মোট ১১টি আবাসিক হলের মধ্যে তিনটি হল ছাড়া সবকটিই '৯৬ পর্যন্ত বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে। জগন্নাথ হল আর সলিমুল্লাহ হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে। জহুরুল হক হল বহিস্কৃত ছাত্রলীগ মন্টু গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।
আমি '৯৭ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জহুরুল হক হলে আমার সংযুক্তি। আমাদের ক্লাস শুরু হয় অগাস্টের দিকে। তখনও হলগুলোর আধিপত্যে হেরফের হয়নি। জহুরুল হক হল মন্টু গ্রুপের ক্যাডার মাসুম আহমেদের নিয়ন্ত্রণে।
এবার মন্টু গ্রুপ প্রসঙ্গে একটু কথা বলে নেয়া দরকার। '৯২ সালে শামসুন্নাহার হল আর জগন্নাথ হলের মাঝখানের রাস্তায় ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান বাদল খুন হল। এই খুনের অভিযোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফা মোহসীন মন্টুকে শেখ হাসিনা দল থেকে বের করে দেন। সেই মন্টু তার সমমনাদের ভাগিয়ে নিয়ে ছাত্রলীগ নামে একটা গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই মন্টু শেখ হাসিনার গলাধাক্কা খেয়ে আশ্রয় পেলেন ড. কামাল হোসনের কাছে। সেই আশ্রয়ে মন্টু আজ গণফোরামের নেতা। মন্টুর আশীর্বাদপুষ্ট মাসুম আহমেদ জহুরুল হক হল নিয়ন্ত্রণ করেন। হলের ছাত্র, প্রশাসন, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলে তাকে সমীহ করেন। মাঝে মাঝে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রলীগ গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি করেন। হলের অভ্যর্থনা কক্ষ তার অলিখিত অফিস। সেই কক্ষে সাধারণ কোন ছাত্র ঢোকার সাহস পেত না। এরকম একটি পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি খুন হওয়া আবরার ফাহাদের মত আমিও গ্রাম থেকে এসেছিলাম। পার্থক্য ফাহাদের বাবা একজন চাকরিজীবী। আমার বাবা একজন কৃষক।
ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর কোনো একটা ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। ফিরে এসে শুনি মন্টু গ্রুপকে হটিয়ে ছাত্রলীগের শরীরতপুর গ্রুপ বুড়ো ছাত্রলীগ নেতা বাবুল তালুকদারের ক্যাডার গোষ্ঠী হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বাবুল তালুকদার বড় ক্যাডার। তিনি মাসুম আহমেদের অফিসে বসেন। তার অনুগত ক্যাডাররা হলের গেটের পাহারায় থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বাবুল তালুকদার ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা শরীয়তপুরের এনামুল হক শামীম এবং বাহাদুর বেপারীর ঘনিষ্ঠ।
হলের পরিবেশের কোনো হেরফের নাই। যেই লাউ সেই কদু। আগে যেমন সকলে মাসুম আহমেদকে সমীহ করত। এখন বাবুল তালুকদারকে সমীহ করে। আগে মাসুম আহমেদের সাঙ্গপাঙ্গরা হলের ক্যান্টিনে ফাও খেত, এখন বাবুল তালুকদারের চেলাচামচারা ফাও খায়। হল প্রশাসনও বয়স্ক বাবুল তালুকদারের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলে।
এমতাবস্থায় নানা রুমে অস্থায়ীভাবে থাকার পর ২২২ নম্বর রুমের দুটি সিটের একটি আমার নামে বরাদ্দ হয়। এই রুমে আগে থেকেই ছাত্রদলের এক সময়ের নেতা মাদারগঞ্জ কলেজের ছাত্রসংসদে ছাত্রদল থেকে নির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) রক্তিম দুইজন বহিরাগত পোষেণ। সে বেশিরভাগে সময় বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে আসে। রক্তিমের পোষ্য বহিরাগতদের কারণে আমি ২২২ নম্বর রুমে নির্বিঘ্নে থাকতে পারি না। হল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানানোর পর তারা রক্তিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। বহিরাগতদের আমার রুম ছাড়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি হল কর্তৃপক্ষ রক্তিমকে কারণ দর্শানোর বিজ্ঞপ্তি দেয়। হল প্রাধ্যক্ষ তাকে ডেকে নিয়ে শাসিয়ে দেয়। একই সঙ্গে বলে দেয় এই ঘটনার জের ধরে অনাকাঙ্খিত কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় এবং আমার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। কে শোনে কার কথা!
রক্তিম বাবুল তালুকদারের ক্যাডারদের সঙ্গে তলে তলে ষড়যন্ত্র করে। আমি আমার সমস্যা তাদেরকে না জানিয়ে হল কর্তৃপক্ষকে কেন জানিয়েছি। আমি তখন বলি, আমার ভুলটা কোথায়? তার জবাবে তারা আমাকে রাত বারোটার পরে তিনতলার একটি কক্ষে যেতে বলে। এই ঘটনায় আমি ভয় পেয়ে যাই। ততদিনে আমি জেনে গেছি রাত বারোটার পরে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার পরিণতি কী হতে পারে। আমাদের ব্লকে সংশ্লিষ্ট আবাসিক শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করব, সে সময় আর সুযোগ কোনোটাই নাই। আর যোগাযোগ করলে বিপদ আরো বাড়তেও পারে। সে ভয়ও কাজ করছে। ক্যাডাররা আরো ক্ষেপে যাবে। কোনো উপায়ান্তর না দেখে টিনশেড ব্লকের আবাসিক শিক্ষক সামাদ স্যারের বাসায় গেলাম, যিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য। তাকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, ভয় পাইও না। দেখি কী করা যায়। তারপর তিনি বললেন, তুমি মাদারগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য মির্জা আযমকে টেলিফোন করে ঘটনাটা জানাও এবং তার পরামর্শ নাও। বাকিটা আমি দেখছি।
যে সময়ের কথা বলছি ঐ সময়ে মোবাইল ফোন সহজলভ্য নয়। আবাসিক হলে তখনও কয়েন দিয়ে টেলিফোন করার ব্যবস্থা রয়েছে। সামাদ স্যার আমাকে মির্জা আযমের টেলিফোন নম্বরটাও সংগ্রহ করে দিয়ে তার নিজের টেলিফোন থেকে ফোন করতে বললেন।
মির্জা আযম টেলিফোনে সবকিছু শুনে খুব অবাক হলেন। পরে শুনেছি ছাত্রদলে এই রক্তিম ব্যারিস্টার সালাম তালুকদারের নিকট আত্মীয়। এই সূত্র ধরে মাদারগঞ্জের আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ এমনকি খোদ মির্জা আযমকেও খুব হয়রানি করেছে।
সবকিছুশুনে মির্জা আযম বললেন, তুমি ভয় পাইও না।তুমি বাবুল তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে বল যে, মির্জাআযম ভাই আপনাকে অনতিবিলম্বে ফোন করতে বলেছেন। আমি যথারীতি বাবুল তালুকদারকে খবরটা দিলাম। তালুকদার সাহেব খুব অবাক হলেন, তুমি আযম ভাইকে কোথায় পেলে? আমি বললাম, টেলিফোন করেছিলাম।
– তুমি তাকে চিনো?
– আমি তাকে চিনি। তিনিও আমাকে চিনেন।
– ঠিক আছে যাও।
তারপরও ভয় আমার কাটে না। আমি রাতে আর নিজের রুমে ঘুমাই না। রাতে গিয়ে ঘুমাই নিচতলার আমার কলেজের বয়োজ্যেষ্ঠ রফিকুল ইসলাম মুকুল ভাইয়ের রুমে। এভাবে কয়েকদিন যাবার পর গেটে একদিন বাবুল তালুকদারের সামনে পড়েছি। সে আমাকে ডেকে বললেন, শোনো, আযম ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাইও।
তখন যেমন বুঝেছিলাম হল প্রশাসন, সামাদ স্যার আর আযম ভাই আমার পক্ষে না দাঁড়ালে আবরার ফাহাদের মত বড় দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি আমিও হতে পারতাম। এরকম আবরার ফাহাদের সংখ্যা সবসময় ছিল, এখনও আছে। আমাদের আবরার ফাহাদদের লাইন বড় দীর্ঘ; যখন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির একাকার।
বিষয়টা আরো একটু বিশদ করে বলি। শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি হলই ছাত্রদল আর ছাত্রদলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের দখলে ছিল। দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া সেই হলগুলোর ক্যাডাররা দলেদলে বোল পাল্টিয়ে ছাত্রলীগ হয়ে গেল। সবগুলো হল ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে এল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যেন নতুন বোতলে পুরানো মদ। অথবা নতুন দিনে পুরনো ভূত। হলগুলোতে একই তাণ্ডব, একই ফাও খাওয়া, একই জিম্মিদশা। এই পরস্থিতি দেখে ঐ বয়সে বুঝেছি জ্ঞানপাপী শব্দটা কি। জাতিকে ছবক দেওয়া অনেক অধ্যাপক, উপাচার্য, বুদ্ধিজীবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কতটা সমজে চলেন।
আরও একটি ঘটনার কথা বলি। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্বের শেষার্ধে এসে গেছি। তখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আমি দুই সিটের রুম থেকে এক সিটের রুম বরাদ্দ পেয়েছি। রুম নম্বর ২০৩। বাস্তবতা এরকম ছিল মেধা অনুসারে এক সিটের রুম বরাদ্দ পেলেও, রুমগুলো ক্যাডাররা দখলে রাখত। আর বরাদ্দপ্রাপ্ত ছাত্রদের ক্যাডাররা অন্য রুমে থাকতে বাধ্য করত।
আমার নামে ২০৩ নম্বর রুম বরাদ্দ হল। ঐ ব্লকের আবাসিক শিক্ষক রব্বানী স্যার। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একে এম গোলাম রব্বানী। তিনি বললেন, রুমে উঠে যাও। কোনো সমস্যা হলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবে।
রব্বানী স্যারের সাহসে ২০৩ নম্বর রুমে উঠে গেছি। সপ্তাহখানেক পরে একদিন বিকেলের দিকে ক্লাস করে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে হলে ফিরে দেখি আমার রুমে অন্য একটি তালা ঝুলানো। আমি সঙ্গে সঙ্গে রব্বানী স্যারের বাসায় গেলাম। স্যারও ক্লাস করিয়ে এসে কেবল এক পায়ের জুতা খুলেছেন। ঐ অবস্থায় তিনি আমার সঙ্গে আমার রুমের সামনে এলেন। রুমেরসামনে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এই রুমে কেতালা ঝুলিয়েছে। এই তালা অবিলম্বেনা খুললে আমি সবকটাকে পুলিশে দেব। দেখে নেব কে কত বড়ক্যাডার।
এরপর স্যার বললেন, তুমি আমার সঙ্গে এসো। তারপর তার বাসায় নিয়ে আমাকে বললেন, আজকের রাতটা অন্য কোথাও থাক। আজকের রাতের মধ্যে তালা না খুললে ওদেরকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা আমি করব। সাবধানে থেক, ভয় পাইও না। এরপর ওরা আমার রুমের তালা খুলে নিয়েছে। এর বছরখানেক পরে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় চলে এল। দিন কয়েকের মধ্যে আমার রুমটি সন্ত্রাসীরা দখলে নিল। আমার সবকিছু খোয়া গেল। আমি আর হলে ফিরতে সাহস পেলাম না। ততদিনে অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী উপাচার্য হয়েছেন। আমি অফিসে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করলাম। সবকিছু শুনে উনি জিজ্ঞেস করলেন; তুমি কি হলে ফিরতে চাও। আমি বললাম; না। তারপর উনি বললেন তাহলে আমার বরাবর একটা দরখাস্ত দিয়ে যাও। আমি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করব। দরখাস্ত দিয়ে চলে এলাম। ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম।
এরকম খোয়া যাওয়া ঘটনা যেমন বিস্তর, তেমনি বেঁচে যাওয়া, মরে যাওয়া, আহত পঙ্গু হয়ে যাওয়া আবরার ফাহাদদের দীর্ঘ লাইন। আমার একটা কবিতার কয়েকটি চরণের উদ্বৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি–
সিসি টিভি ধরে এগার জনকে বহিস্কার করে,
ওরা নয় জনকে গ্রেফতার করে,
আরো কত সিসি'র ভেতরে বাইরে-
কত এগার জন কত নয় জন-
দেশজমিনে নগরে অলিগলি কানাগলি ধরে,
ছাত্রাবাসের করিডোরে এডিস মশার মত
খুনি আর খুনির প্রেতাত্মারা খবরদারি করে।
এডিস মশার খপ্পরে আমিই শুরু না,
আমিই শেষ আবরার ফাহাদ না।