বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আর যাতে কখনো কোনো ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিবাদী না হয়ে ওঠে, তার জন্য সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অধীনে নির্বাচন হয়ে ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজিত হবার নজির থাকা।
Published : 22 Dec 2024, 06:00 PM
নতুন বাস্তবতা শুধু ইসলামবাদের রাজনীতি না, সিপিবির মতো বামপন্থার রাজনীতিও এগিয়ে নেবার সুযোগ তৈরি করেছে— আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে। তবে এ বাস্তবতায় রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে চাইলে তিনটি বিষয় মাথায় রেখে সিপিবিকে তার কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে। যদি সিপিবি তা করতে পারে, একমাত্র তখনই তার পক্ষে এ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব হবে।
এগুলো হলো: ক) মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা বিষয়ে আওয়ামী লীগের বয়ানের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র বয়ান দাঁড় করাতে পারা; খ) ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হেজিমনির (প্রাধান্য) বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারা; এবং গ) সেকুল্যারিজম বা ধর্ম সহিষ্ণুতার বিষয়ে বেশিরভাগ গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে সমাজ এবং রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা সিপিবি কীভাবে দেখে তা জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারা।
এর বাইরে বাকশালে যোগদানের বিষয়টি সিপিবির জন্য কেন ভুল ছিল এটিও পরিষ্কার করা জরুরি। মোদ্দা কথা, আওয়ামী রাজনীতির বাইরে সিপিবি যে একটি স্বতন্ত্র ধারা, এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের চেয়ে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন— এটি যদি তারা স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে, তাহলে তাদের রাজনীতিকে তারা জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাস্তবতায় সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
জুলাই বিপ্লবের মূল সুর ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা। সরকারি চাকরিতে কোনো বৈষম্য করা যাবে না, সেখান থেকেই বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের ধারণা সামনে আসে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গুরুবার’সহ যে সমস্ত পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল, সেখানে প্রথম বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে ধারণা বিনিময় হয়।
এসব পাঠচক্রে যে বিষয়টা উঠে আসে সেটা হলো, রাষ্ট্র মানেই ‘ফ্যাসিবাদী’; অর্থাৎ, বলপ্রয়োগ করবার অধিকারী। আর বৈষম্য থেকে ‘ফ্যাসিবাদের’ জন্ম। ফলে, এ ফ্যাসিবাদ মুক্ত করে রাষ্ট্র কাঠামো গঠন জরুরি। তবে পাঠচক্রগুলোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল একটা সুন্দর স্বপ্ন উপস্থাপন করা হলেও সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার ধারণা দিতে না পারা।
রাষ্ট্রের যে বৈশিষ্ট্য যা অন্য কোনো সংগঠনের নেই— তা হলো, বৈধ বা আইনগতভাবে তার নাগরিক বা প্রজাদের ওপর বল প্রয়োগ করতে পারবার অধিকার। এ অধিকারই রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংগঠন থেকে পৃথক করেছে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তক ও দার্শনিক, যেমন হবস, লক ও রুশো যে সামাজিক চুক্তির কল্পনা করেছেন, ওই চুক্তি অনুসারে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রকে ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের ওপর বলপ্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করেছে; অর্থাৎ, পুলিশি ক্ষমতা দিয়েছে। তাই মর্মগতভাবে প্রতিটি রাষ্ট্রই পুলিশি রাষ্ট্র।
পুলিশি ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিলে রাষ্ট্র নামক সংগঠন বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। তবে এটাও উল্লেখ্য যে, প্রতিটি রাষ্ট্রের আইনকে পাশ কাটিয়ে অনায্যভাবে বল প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে।
আইন এবং ন্যায়ের ধারণার বিষয়টি সাবজেক্টিভ এবং ব্যক্তিভেদে বা রাজনৈতিক এবং দার্শনিক বিশ্বাস ভেদে ভিন্ন। ফলে যে ফ্যাসিবাদকে দূর করবার জন্য জুলাই বিপ্লব, রাষ্ট্রকাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে এ ফ্যাসিবাদের মূল কী করে উপড়ে ফেলা যাবে— ওই দার্শনিক প্রশ্নের সমাধান বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানকারীরা এখন পর্যন্ত হাজির করতে পারেনি।
শুধু এ দার্শনিক প্রশ্নের সমাধান নয়, বিপ্লব পরবর্তী সময়ের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, বিপ্লবের পর চার মাস অতিক্রান্ত হলেও রাষ্ট্র এবং সমাজে বিরাজমান বৈষম্যগুলোকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করতে না পারা। ফলে বৈষম্যগুলো নিরসনে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বা কোন কোন বৈষম্য নিরসনে তারা উদোগী হবেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক রূপকল্প জনগণের সামনে হাজির করা হয়নি। এতে জনগণ ঠিক বুঝতে পারছে না, রাষ্ট্র এবং সমাজে বিরাজমান জেন্ডার এবং শ্রেণি বৈষম্য দূরীকরণে বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকার কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা।
বাংলাদেশে যারা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু— হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমদীয়া জামাত, শিয়া, বাহাই কমিউনিটি এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী— তাদের মাঝে নিরাপত্তাজনিত একটা সমষ্টিক মানসিক উদ্বেগ রয়েছে। এ উদ্বেগ গত ৫৩ বছরে কোনো সরকারই দূর করতে পারেনি।
এছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নিয়ে আমার সাম্প্রতিক সময়ে মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝতে পেরেছি সেটা হলো, এ জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই মনে করেন যোগ্যতা থাকলেও তাদের কারও পক্ষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। যদিও এ ধরনের কোনো লিখিত নিয়ম ইরান বা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও নেই, তবু তাদের মনোজগতে এ বিষয়টা রয়েছে নানা কারণে।
গত ৫৩ বছর যাবত রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্যের শিকার হবার মনস্তত্ত্ব তারা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। যে কারণসমূহ থেকে এ মনস্তত্ত্বের উৎপত্তি তা দূর করবার কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র নেয়নি বলে তারা মনে করেন।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো জনগণের সকল অংশের মাঝ থেকে বৈষম্যের শিকার হবার যে মনস্তত্ত্ব, তা দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ। এ ধরনের বৈষম্যের মনস্তাত্ত্বিক কারণ দূর করতে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকার কী ভূমিকা পালন করবেন সেটা পরিষ্কার করা জরুরি।
বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক পূর্বশর্ত হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ যার থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা হলো পুঁজিবাদীদের স্বার্থের পাহারাদার হিসেবে কাজ করা। অনেক রাষ্ট্রচিন্তক বিষয়টাকে এভাবে দেখেন।
এখন শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টিকারী এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে থেকে কীভাবে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব— এ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তে জরুরি। শুধু কিছু প্রশাসনিক সংস্কার এবং সংবিধান সংশোধন/পুনর্লিখনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং সমাজে বিরাজমান যে গভীর বৈষম্য, সেটা যে দূর হবে না তা বলাই বাহুল্য।
সংবিধান পুনর্লিখনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত কমিশন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রস্তাব করতে পারে যেখানে অনেক ভালো প্রস্তাবনা থাকতে পারে। যেমন, ক্ষমতা পৃথকীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য তৈরি করা যাতে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়, ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদে আনবার জন্য সমানুপাতিক নির্বাচন ইত্যাদি।
তবে, এসবসহ যত ভালো প্রস্তাবনাই আনা হোক না কেন বা নির্বাচন কমিশনসহ যতরকম সংস্কারই করা হোক না কেন— কোনো গণভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল বা জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ভূমিধস বিজয় নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসতে পারে।
বিজয়ী দল বা জোট ক্ষমতাসীন হবার পর ওই দল বা জোট যদি প্রস্তাবিত সংবিধান বা সংস্কারসমূহ গ্রহণ করতে না চায়, তাহলে পুরানো যে ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী বলা হচ্ছে, তা আবার যে কোনো দল বা জোটের পক্ষেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এখন পর্যন্ত দুনিয়াতে এমন কোনো গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থা বের করা সম্ভব হয়নি যা দিয়ে কোনো দল, জোট বা ব্যক্তির প্রতি জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট থেকেই হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে নাৎসিবাদ এবং মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসিবাদ মূলত একই। তবে নাৎসিবাদ হলো চরমতম ফ্যাসিবাদ। জার্মান নাৎসিরা ইতালির ফ্যাসিস্টদের চেয়ে অধিকতর নিবর্তনমূলক পন্থা অবলম্বন করেছে। এ দুই মতবাদের মধ্যে আরেকটি পার্থক্যের জায়গা হলো, ফ্যাসিস্টদের মূল ফোকাস ছিল জাতীয় গৌরব বা চরম জাতীয়তাবাদ।
অন্যদিকে এর সঙ্গে নাৎসিবাদে যুক্ত হয় জাতি এবং ইহুদী ধর্ম বিদ্বেষ। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের নেতৃত্বে জন্ম নেয় চরম নিবর্তনমূলক কমিউনিস্ট ব্যবস্থা, যা সর্বাত্মকবাদী বা টোটালিটেরিয়ান ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বামপন্থীরা অতি ডান এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে ফ্যাসিবাদী দল হিসবে আখ্যায়িত করা শুরু করে। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক চরমধারার ইসলামবাদী দল এবং গোষ্ঠীগুলোকে ইসলামোফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যা দেন। পরবর্তীতে কোনো কোনো বিশ্লেষক মূলধারার ইসলামবাদী দলগুলোকেও ইসলামোফ্যাসিস্ট বলা শুরু করেন।
ভারতে বিজেপিসহ হিন্দুত্ববাদী দলগুলোকে সিপিআইসহ (মার্ক্সবাদী) অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো ফ্যাসিবাদী দল মনে করে। এভাবে আখ্যায়িত করবার প্রবণতা শুধু ভারতে নয়; ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য জায়গাতেও রয়েছে। এসব দেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতাধারী অতি ডান এবং দক্ষিণপন্থী দলগুলোকে বাম এবং মধ্যপন্থীরা ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
উল্লেখ্য যে, স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা শুধু ডান এবং দক্ষিণপন্থী দলসমূহের মাঝেই নয়, অতি বাম ধারার দলগুলোর মাঝেও রয়েছে। তবে যেহেতু স্তালিনের শাসনকে সর্বাত্মকবাদী বলা হতো, ওই ধারা মেনে বাম ধারার দলগুলোকে ফ্যাসিবাদী বলার চল নেই।
ক্ষমতার বাইরেও নানা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রয়েছে যাদের ঘোষণাপত্র, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা। এদের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মাঝে ফ্যাসিবাদী মনন এবং আচরণ সুস্পষ্ট। এমনকি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতেও এ ধরনের দল এবং মানসিকতার রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টরা রয়েছেন।
এ সমস্ত দলের লক্ষ্য বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা হটিয়ে নিজেদের ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করা। তাদের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদ কায়েম হলেও তারা তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে থাকে গণতান্ত্রিক স্লোগান, রেটরিক এবং বক্তব্যের আড়ালে। অর্থাৎ, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সামনে তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচয় দেয়। ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে নিজেদের আড়াল করে রাখে রাজনৈতিক কৌশলের সমীকরণ থেকে।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেখা গেছে, গণতন্ত্র যে সমস্ত রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে ওই সমস্ত রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী প্রবণ দল থাকলেও তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করতে পারে না বা গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় না। তাই বাংলাদেশে ভবিষ্যতে আর যাতে কখনো কোনো ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিবাদী প্রবণ না হয়ে ওঠে, তার জন্য সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অধীনে নির্বাচন হয়ে ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজিত হবার নজির থাকা। সমস্ত প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এমন নজির রয়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার ম্যাচিউরিটি দেখাতে পারেনি। অথচ এর বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা সরলীকৃতভাবে বললে ভোট দেবার অধিকারের জন্য বারবার এত বিপুল পরিমাণ রক্ত দিয়েছে যার দ্বিতীয় কোনো নজির বিশ্বে নেই।
আধুনিক ইতিহাসে দেখা গেছে, কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব, সশস্ত্র সংগ্রাম, গেরিলা যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে যারা ক্ষমতা দখল করেছেন পরবর্তীতে তারা কেউই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। ক্ষমতা দখলের পর তারা তাদের পূর্ববর্তী শাসকদের চেয়েও বেশি স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিস্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবীদের সামনে বিশ্বে নতুন ইতিহাস তৈরি করবার বিরল সুযোগ রয়েছে। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা যদি দায় ও দরদের জায়গা থেকে বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিনির্মাণ করতে পারেন, তাহলে তাদের অবদান শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বের বিপ্লবের ইতিহাসেও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তারা ওই অবদান রাখতে পারবেন কিনা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ।
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ১– গণঅভ্যুত্থান, প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব, নাকি বিপ্লব
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ২— প্রতিক্রিয়াশীলতার শঙ্কা বনাম ছাত্র-জনতার জাগরণ
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ৩— সেক্যুলারিজম এবং ইসলামবাদের ভূমিকা
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ৪— আওয়ামী লীগের মতাদর্শিক দুর্বলতা