আওয়ামী নেতৃত্ব এবং আওয়ামী ব্যানারে সুবিধাপ্রাপ্তদের একটাই লক্ষ্য ছিল, যে মতাদর্শকে ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেটাকেও ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করে অর্থনৈতিক লুটপাট, টাকা পাচার এবং ঋণ খেলাপি হওয়া।
Published : 21 Dec 2024, 06:07 PM
আন্দোলনে ভূমিকা রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা বিভিন্ন পাঠচক্রে বিদেশী এবং দেশী চিন্তকদের চিন্তাভাবনা আলোচনা, পড়াশোনা করেছেন। কিছু পাঠচক্র গড়ে তুলবার নেপথ্যে ‘ইন্টেলেকচুয়াল ফোর্স’ হিসেবে হিযবুত তাহরীরের ছাত্র কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে।
একসময় যেখানে পাঠচক্র গড়ে উঠত মার্কসবাদী চিন্তাধারাকে জানা-বোঝার জন্য, ওই জায়গাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইসলামকে ভিত্তি ধরে সমাজ, রাজনীতি এবং ইতিহাসের অধ্যয়নে। এই তরুণরা চেয়েছেন বাংলা-ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জনপরিসর আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে, তার বিপরীতে ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে একটা কাউন্টার জনপরিসর তৈরি করতে।
এরকম একটি জনপরিসর গঠন ছাড়া আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করা যাবে না বলে তারা মনে করেছেন। এ জনপরিসরের ধারণা যে একেবারে নতুন তাও নয়। ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই এ জনপরিসর বাংলায় তৈরি হয়েছিল। তরুণ শিক্ষক এবং ছাত্রবৃন্দ চেষ্টা করছেন ওই জনপরিসরকে তাত্ত্বিকভাবে আধুনিক করে তুলতে।
এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব যে জনপরিসর সেটাকে বর্তমান সময়ের যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের যে রাজনৈতিক ভাবনা, তার উপযোগী করে আধুনিকায়ন করতে পারেনি। বস্তুত এর প্রয়োজনীয়তাও তারা বোধ করেনি।
আওয়ামী নেতৃত্ব এবং আওয়ামী ব্যানারে সুবিধাপ্রাপ্তদের একটাই লক্ষ্য ছিল, যে মতাদর্শকে ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেটাকেও ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করে অর্থনৈতিক লুটপাট, টাকা পাচার এবং ঋণ খেলাপি হওয়া। মতাদর্শের তাত্ত্বিক উন্নয়ন নয় বরং ১৯৭১-এর রাজনৈতিক মতাদর্শকে তাদের অবৈধ, অনৈতিক কার্যকলাপের ঢাল বা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা।
সাধারণত মতাদর্শের জন্ম হয় সে সময়কার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবার জন্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ওই মতাদর্শের তাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে তা স্থবির হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফলে নতুন যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয় তাত্ত্বিকভাবে তার পক্ষে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। আর এ মোকাবেলা করতে পারবার ব্যর্থতার কারণে আমরা দেখেছি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন।
তেমনিভাবে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক দর্শন সেটি ১৯৭১ সালের বাস্তবতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। সেটির তাত্ত্বিক উন্নয়ন ছাড়া, ২০২৪ সালের যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ— জনগণ বিশেষত তরুণ সমাজের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে ওইসমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে কিনা— এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক বোধ আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল এবং এখনো রয়েছে।
জনগণ টেক্সট পড়ে কোনো মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তারা আকৃষ্ট হয় ওই মতাদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জীবনাচরণ দেখে। পাশাপাশি যে বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয় তা হলো, এই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারছেন কিনা। জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছেন কিনা।
উন্নয়নের ন্যারেটিভ তো দূরের কথা, এমনকি উন্নয়নের কোনো রেটোরিকও আওয়ামী লীগ দাঁড় করাতে পারেনি। তারা শুধু পেরেছিল ‘উন্নয়নের’ স্লোগান দাঁড় করাতে। কিন্তু এ স্লোগান জনগণ গ্রহণ করছে বা এর সঙ্গে একাত্মবোধ করছে কিনা সেটি নিয়ে তারা মোটেই ভাবেনি। আওয়ামী লীগের একটা বড় ব্যর্থতা ছিল গণতন্ত্রের বিপরীতে ‘উন্নয়নের’ স্লোগান যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে কোনো আবেদন তৈরি করছে না, তা বুঝতে না পারা বা বোঝার চেষ্টা না করা।
এটি আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার দিকেই ইঙ্গিত করে। তারা যেটা করেছে সেটা হলো উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে তাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু শুধু এ স্লোগানের ওপর নির্ভর করে জনগণের সঙ্গে নিজেদের যে যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে না, এ বিষয়ে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। গত এক বছরে আমাকে তিনবার বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এ সময়কালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের কর্মী, সমর্থক বা দল কর্তৃক নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত, এর বাইরে উচ্চ শ্রেণি থেকে তৃণমূলের জনগোষ্ঠীর কাউকেই ‘উন্নয়নের’ স্লোগানের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে দেখিনি।
আওয়ামী লীগের মূল নির্ভরতা ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী সমাজ এবং দলের ওপর। শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন অভ্যন্তরীণভাবে শুধু এদের সমর্থন থাকলেই অংশগ্রহনমূলক নির্বাচন না করেও দীর্ঘমেয়াদে (পড়ুন অনন্তকাল) ক্ষমতায় থাকা যাবে।
একটি সরকার বা রেজিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সমর্থন ভিত্তি, অর্থাৎ তার রাজনৈতিক দল, ওই দল ও তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ের বেশিরভাগ পদও টাকার বিনিময়ে বেচাকেনা করার সংস্কৃতি শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার আমল থেকে শুরু হয়।
দল এবং সংগঠনগুলোতে কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নানা উপকমিটি তৈরি করে অনেক অপ্রয়োজনীয় পদ তৈরি করা হয়, যাতে বেশিমাত্রায় পদ বাণিজ্য করে অধিক মাত্রায় অর্থ বাগিয়ে নেওয়া যায়। ফলে এক সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিকে দলের সভানেত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষেই পরিণত করা হয় টাকা বানাবার মেশিন হিসেবে।
এ সমস্ত নেতৃত্বের কাছে পদ কেনা ছিল বাণিজ্যে বিনিয়োগের মতো, যার ব্যবহার তাদেরকে সমাজে বিত্ত-বৈভবের মালিক হতে সাহায্য করেছে। ফলে এ সমস্ত নেতৃত্বের কাছে চব্বিশের চ্যালেঞ্জ ছিল শুধু তাদের বিত্ত-বৈভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখবার চ্যালেঞ্জ।
অর্থের বিনিময়ে কেনা নেতৃত্ব স্বাভাবিক কারণেই মতাদর্শিক আনুগত্য এবং চর্চা তৈরি করেনি। ফলে এ নেতৃত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ধরন বোঝা সম্ভব হয়নি। এদের ওপর নির্ভর করে জুলাই পরবর্তী যে নয়া বন্দোবস্তের জন্ম নিচ্ছে, ওই বন্দোবস্তে দল পুনর্গঠন করে আওয়ামী লীগের পক্ষে তার রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে কিনা— সেটিও প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সময়ের সঙ্গে কোনো মতাদর্শকে যদি আধুনিক করা না যায় বা বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ এবং সঙ্কটগুলো যদি গ্রহণযোগ্যভাবে কোনো মতাদর্শ ব্যাখ্যা করতে না পারে, জনগণের একটা বড় অংশের কাছে ওই মতাদর্শ তার আবেদন হারায়। ফলে ওই মতাদর্শের ওপর নির্ভর করে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে একনায়কতান্ত্রিক শাসন অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন (রেজিম) এবং পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভোটের রাজনীতিতে ক্রমাগত ব্যর্থতা হলো এর উদাহারণ।
এরকম উদাহারণ আরও রয়েছে। এ ধরনের মতাদর্শিক সঙ্কটের সময় নতুন রাজনৈতিক শক্তি বা ব্লকের আবির্ভাব হতে দেখা যায় নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে।
ইতিহাসে দেখা যায়, যে রাজনৈতিক দল এবং মতাদর্শ সবচেয়ে চাপের মধ্যে থাকে এবং ওই দল যদি সে চাপ মোকাবেলা করে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তারা সে রেজিমের পতনের পর শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্লক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
জার আমলে রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা জারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সফলভাবে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে তাদের নেতৃত্বে জারের পতন ঘটে এবং শক্তিশালী পাওয়ার ব্লক হিসেবে রুশ রাজনীতিতে তাদের আবির্ভাব ঘটে জার শাসনের অবসানের পর।
ইরানে খোমেনির নেতৃত্বে শিয়া ইসলামবাদীরা তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিকভাবে শাহ-এর বিরুদ্ধে সফলভাবে দাঁড়াতে পারবার ফলেই শাহ পরবর্তী ইরানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে তারা চলে আসে। রাশিয়া, ইরান ইত্যাদি দেশের মতো জুলাই বিপ্লবও বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে।
গত সাড়ে পনের বছর ইসলামবাদের রাজনীতির ক্ষুদ্র অংশটিকে (মূলত যারা ওহাবী/সালাফি বা মওদুদীর চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত নয়) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মূলধারার ইসলামবাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে আইনি এবং প্রশাসনিক চাপে রাখবার কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। এর বিরুদ্ধে ইসলামবাদী দলগুলো রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি মতাদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ জারি রাখে। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ ধরে নেয় শুধু আইনি এবং প্রশাসনিক পন্থায় ইসলামবাদের রাজনীতিকে তারা প্রান্তীয় অবস্থানে ঠেলে দিতে পারবে।
শুধু রাষ্ট্রশক্তির ওপর নির্ভর করে কোনো মতাদর্শকে যে কোণঠাসা করে রাখা যায় না, এটা তারা বুঝতে পারেনি। ইসলামবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াই চালাবার জন্য যে মেধাবী লোকের দরকার তা দুর্নীতি এবং অপরাজনীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, মতাদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াই অব্যাহতভাবে জারি রাখতে পারবার ফলে গত সাড়ে পনের বছরে ইসলামবাদের রাজনীতির একটা বড় জনপরিসর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তৈরি করতে পেরেছে। ফলে শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী যে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিনির্মাণ হচ্ছে, সেখানে ইসলামবাদী দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছে। এ বিষয়টি ইসলামবাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেটা স্বাধীন বাংলাদেশে এর পূর্বে এভাবে আর কখনো হয়নি।
(চলবে)
আরও পড়ুন:
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ১– গণঅভ্যুত্থান, প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব, নাকি বিপ্লব
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ২— প্রতিক্রিয়াশীলতার শঙ্কা বনাম ছাত্র-জনতার জাগরণ
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ৩— সেক্যুলারিজম এবং ইসলামবাদের ভূমিকা