বিশ্বের অন্য যে কোনো জায়গায় যত বিপ্লব হয়েছে, তার সবই হয়েছে রাজনৈতিক ব্যানারে, সুস্পষ্ট একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। তাহলে, বাংলাদেশে কেন দলীয় ব্যানারে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য বা মতাদর্শকে সামনে রেখে সরকারের পতন ঘটানো গেল না?
Published : 20 Dec 2024, 10:23 AM
শুধু বামপন্থী সিপিবিতে নয়, দোদুল্যমানতা ছিল ইসলামবাদী হেফাজতে ইসলামের মাঝেও। ফলশ্রুতিতে একেবারে শুরুতেই তারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করে। হেফাজত বোঝার চেষ্টা করছিল এর গতিধারা কোন দিকে যাবে। যখন তারা নিশ্চিত হয় সরকারের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না, তখন একেবারে শেষমুহূর্তে এসে তারা আন্দোলনে যোগ দেয়।
হেফাজতের মাঝে দোদুল্যমানতা থাকলেও আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর মাঝে কোনো সংশয় ছিল না। খেলাফত মজলিস তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের দলীয় কৌশল অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে যাতে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত হতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করে আন্দোলনে অংশ নেয়।
জামায়াতে ইসলামী তাদের কর্মী, সমর্থকদের যতটা বেশি সংখ্যক সম্ভব এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায় ওই ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তবে বিএনপির তুলনায় ছোট দল হবার কারণে বিএনপির সমতুল্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি; যদিও সরকার পতনের ব্যাপারে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভূমিকা রেখেছে হিযবুত তাহরীরও।
হিযবুত তাহরীরের মিডিয়া সমন্বয়ক ইমতিয়াজ সেলিম সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, “হিযবুত তাহ্রীর একটা ইন্টেলেকচুয়্যাল এবং পলিটিক্যাল লিডিং ফোর্স।” তার ভাষ্য অনুযায়ী, সরকার পতনের আন্দোলনে হিযবুতের কর্মীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির কর্মীরা সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই মাঠে ছিল। এসব দাবির সত্যতা প্রমাণ করা কঠিন হলেও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হিযবুতের নেতাকর্মীরা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে মাঠে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।
তবে শুধু হিযবুত নয়, কোনো দল বা সংগঠনই তাদের ব্যানার নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়নি। এটি বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি নতুন প্রপঞ্চ। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে যত রাজনৈতিক বা সরকার পতনের আন্দোলন হয়েছে এর সবকিছুই হয়েছে রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে।
বিশ্বের অন্য যে কোনো জায়গায় যত বিপ্লব হয়েছে, তার সবই হয়েছে রাজনৈতিক ব্যানারে, সুস্পষ্ট একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। তাহলে, বাংলাদেশে কেন দলীয় ব্যানারে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য বা মতাদর্শকে সামনে রেখে সরকারের পতন ঘটানো গেল না? সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন একটা আপাত ‘অরাজনৈতিক’ চেহারা দিতে হলো?
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে বিদ্যমান কোনো একক রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি ওই পরিমাণ জনসমর্থন নেই যার মাধ্যমে বেশিরভাগ জনগণকে একটি সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন সংগঠিত করা যায়। এ জনসমর্থনহীনতার কারণেই অরাজনৈতিক ব্যানারে আন্দোলন দাঁড় করাতে হয়েছে, যাতে আওয়ামী লীগ বাদে সমস্ত মতাদর্শ সমর্থনকারীরা এ আন্দোলনে শরিক হতে পারে।
অরাজনৈতিক ব্যানারে হলেও জুলাই বিপ্লবের একটি রাজনীতি আছে, একটি রাজনৈতিক বার্তা আছে, আছে রাজনৈতিক লক্ষ্যও। সব বিপ্লবেরই সেটা থাকে। রুশ বিপ্লবে সেটা ছিল বলশেভিকদের (কমিউনিস্ট পার্টি) নেতৃত্বে সামন্ততান্ত্রিক রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর। ইরানের বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল পাহলভি রাজবংশের উৎখাত করে ইরানকে শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। রুশ, চীন বা ইরানের বিপ্লবের মতো স্পষ্ট এবং ঘোষিত লক্ষ্য না থাকলেও জুলাই আন্দোলনেরও নির্দিষ্ট বার্তা এবং লক্ষ্য ছিল, যা গণমানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের উচ্ছেদের লড়াইয়ে সামিল করেছে।
গণহত্যার প্রতিবাদে শুধু আবেগের বশবর্তী হয়েই মানুষ এ লড়াইয়ে সামিল হয়নি। লড়াইয়ে যারা ভ্যানগার্ড ছিলেন তারা আবেগের পাশাপাশি একটা স্বপ্ন মানুষের সামনে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তারা যদি এ লড়াইয়ে সফল হয়, তাহলে নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গঠন করা হবে, সেটি হবে বৈষম্যহীন এবং সেখানে মানুষের ‘জান এবং জবানের’ পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
গণজাগরণের সময় এ বিষয়টাও স্পষ্ট হয়েছিল, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র কাঠামোটি মননগতভাবে হবে সেক্যুলার, তবে সেটি আওয়ামী বা ইউরোপীয় ধাঁচের সেক্যুলারিজম না হয়ে হবে দেশীয় বাস্তবতাকে ধারণ করে। নয়া বন্দোবস্তে রাষ্ট্র হবে ভূমিজাত, সত্যিকার অর্থে সেক্যুলার বা ধর্মসহিষ্ণু। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থাও হবে ধর্মসহিষ্ণু। কেননা সমাজ ধর্মসহিষ্ণু না হলে ধর্মসহিষ্ণু রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়।
আন্দোলন চলাকালীন তাদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন গান, কবিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এ আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়েছে। বস্তুত রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের এ ধরনের রূপান্তরের স্বপ্ন জনসম্মুখে হাজির করতে পারবার ফলেই জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশকে এ গণ-অভ্যুত্থানে সম্পৃক্ত করা গেছে।
অভ্যুত্থানে যারা ছিলেন ভ্যানগার্ড, ওই সমন্বয়কদের কেউ কেউ রাষ্ট্র এবং সমাজ অধ্যয়নে ইসলামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ ধরে বিশ্লেষণে আগ্রহী। ইসলামের ভূমিকাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ বলে তারা মনে করেন। ইসলাম তাদের কাছে ইতিহাস, রাষ্ট্র এবং সমাজ অধ্যয়নের মৌলিক একক (basic unit of analysis)। হিন্দুত্ববাদীদের কাছে যেমন হিন্দু ধর্ম, যায়নবাদীদের কাছে যেমন ইহুদী ধর্ম, মার্ক্সবাদীদের কাছে শ্রেণি এবং জাতীয়তাবাদীদের কাছে যেমন জাতি, তেমনি তাদের কাছে ইসলাম।
গত সাড়ে পনের বছরের আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশে ইসলামবাদের একটা শক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবার জন্য একটি শক্তিশালী বিকল্প রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলবার প্রয়োজনীয়তা তরুণ সমাজ অনুভব করে। এতদিন ধরে চলে আসা ব্যবস্থার আমূল বদলের আকাঙ্ক্ষা থেকেই আওয়ামী মতাদর্শকে কার্যকরভাবে বিরোধিতা করতে পারবে এমন রাজনৈতিক মতাদর্শের সন্ধান করা হয়।
তারা এটা উপলব্ধি করে, যে তাত্ত্বিক প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তার বিকল্প তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক প্রকল্প দাঁড় করাতে না পারলে— শুধু আবেগের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন দাঁড় করানো যাবে না। এ উপলব্ধি থেকে তরুণরা রাষ্ট্র, সমাজ, ইতিহাসের ব্যাখ্যায় আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে একটি ভিন্ন বয়ান দাঁড় করাতে চেষ্টা করে।
একটি ভিন্ন বয়ান দাঁড় করানো গেলেই শুধু ব্যক্তি বা দলের পরিবর্তন নয় বরং একটি বিকল্প ব্যবস্থা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা যায়। আর এর জন্য তারা একটি তাত্ত্বিক লেন্সের অনুসন্ধান করছিল, যে লেন্সের আলোকে আওয়ামী বয়ানের বিপরীতে একটি ভিন্ন বয়ান দাঁড় করানো যায়।
বিভিন্ন ঘরানার বামপন্থী মতাদর্শকে তারা আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কার্যকরী উপাদান মনে করেনি মূলতঃ দুটি কারণে। এর একটি হলো, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন পরবর্তী আজকের যে বিশ্বব্যবস্থা, ওই ব্যবস্থাকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা এবং চ্যালেঞ্জ করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার তাত্ত্বিক প্রকল্প বর্তমান কালের মার্কসবাদীদের এখন পর্যন্ত দাঁড় করাতে না পারা। অপরটি হলো, পশ্চিমবঙ্গের বিপরীতে ঐতিহাসিকভাবেই বামপন্থার চিন্তাচেতনা নানাবিধ কারণে বাংলাদেশে ওই অর্থে খুব গভীরে শিকড় গাড়তে না পারা।
এর বাইরে বাংলাদেশের মূলধারার বামপন্থীদের সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সাংস্কৃতিক চর্চা এবং মূল্যবোধের অনেক জায়গায় মিলও তারা খুঁজে পায়। বস্তুত এ সমস্ত কিছুর ফলে তারা এটা মনে করে যে, বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী বয়ানকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ফলে এ তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে কোনো গণসম্পৃক্ত কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠবে না।
এ উপলব্ধি থেকেই নেতৃত্বদানকারী তরুণরা সরকার পতনের আন্দোলনে ইসলামবাদকে একটা কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় আনে। যার ফলে ইসলামবাদের সঙ্গে নতুনভাবে বোঝাপড়া এবং এর সঙ্গে একটা কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলবার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়টাও উঠে আসে, ইসলামপন্থার রাজনীতির পুরানো ধারার ওপর নির্ভর করে বর্তমান রাজনীতির যে সঙ্কট এবং চ্যালেঞ্জ, সেগুলোকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না।
ইসলাম নিয়ে পশ্চিমে যে পঠন-পাঠন; যে পঠনে উত্তর-আধুনিকতাবাদ, উত্তর ঔপনিবেশিক তত্ত্ব, প্রাকৃতজন অধ্যয়ন— ইত্যাদি নানা একাডেমিক ডিসকোর্সের গবেষণা পদ্ধতি এবং প্রত্যয়সমূহ ব্যবহার করে বহুত্ববাদী ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ, রাজনীতি এবং ইতিহাসের যে সমস্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পশ্চিমা নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন চিন্তাবিদরা দাঁড় করিয়েছেন— তার প্রতি জুলাই বিপ্লবে ভূমিকা পালনকারী অনেক তরুণই আকৃষ্ট হন।
আকৃষ্ট হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও, যাদের অনেকেই জুলাই বিপ্লবে ভূমিকা পালন করেছেন। তারা নানাভাবে ইসলামকে বিশ্লেষণের একক ধরে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি এবং ইতিহাসে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন— যদিও পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাবিদদের মতো এখনো কোনো মৌলিক কাজ তারা দাঁড় করাতে পারেননি। কিছু একাডেমিক কাজের বাইরে তারা মূলত সক্রিয় থেকেছেন অ্যাক্টিভিজম সংক্রান্ত কাজে, ফেইসবুকের পোস্টে।
(চলবে)
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ১– গণঅভ্যুত্থান, প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব, নাকি বিপ্লব
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ২— প্রতিক্রিয়াশীলতার শঙ্কা বনাম ছাত্র-জনতার জাগরণ