নতুন রাজনৈতিক পরিসর গঠন এবং ক্ষমতা কাঠামোর পালা বদলের আকাঙ্ক্ষা থেকে জুলাই বিপ্লব হলেও, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই সরকার গঠন করা হয়, যেটা বিপ্লবের চরিত্র এবং স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
Published : 17 Dec 2024, 07:59 PM
এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের মধ্য দিয়ে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। বাংলার ইতিহাসে এত বড় জাগরণ ইতিপূর্বে ঘটেনি।
এর পূর্বে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের ফলে সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এ অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছেন বা কাছ থেকে দেখেছেন যেমন বদরুদ্দীন উমর বা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম— তাদের সকলের বয়ান অনুসারে এটা প্রতীয়মান যে, ২০২৪-এর জাগরণ নানাভাবে ঊনসত্তরকে ছাড়িয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়া কভারেজের দিক থেকেও ঊনসত্তর তো বটেই, এমনকি একাত্তরকেও ছাড়িয়ে গেছে চব্বিশের জাগরণ। এর পূর্বে বাংলাদেশের আর কোনো আন্দোলন এত বেশি আন্তর্জাতিক কভারেজ পায়নি।
চব্বিশের আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো শ্রেণি নির্বিশেষে ব্যাপকহারে নারীদের অংশগ্রহণ, যা অতীতে এ মাত্রায় দেখা যায়নি। শুধু নারী নয়, হিন্দুসহ অমুসলিম জনগোষ্ঠীও এ আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে এত বিপুল সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অন্তত নয় জন হিন্দু ধর্মালম্বী এ আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
এটি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি মৌলিক পরিবর্তন ইঙ্গিত করে। এতদিন যাবৎ মনে করা হতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর বড় অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু এটি পরিস্কার যে, গত সাড়ে পনের বছরে আওয়ামী লীগের প্রতি হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশের যে সমর্থন, বহুবিধ কারণে ওই জায়গায় ছেদ পড়েছে।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান অথবা পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনে জেনারেল এরশাদ বা খালেদা জিয়া সরকারের পতন হলেও তাদের কারও দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। ফলে তারা কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। কিন্তু এবার এত বড় জাগরণ ঘটবার কারণে গণআক্রোশের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তড়িৎ গতিতে দেশ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম।
হাসিনা সরকারের পতন, বিপ্লব না গণঅভ্যুত্থান— এ নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ পর্যবেক্ষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বামপন্থীদের একটি অংশ এবং ইসলামবাদীদের একাংশ একে বিপ্লব হিসেবে দেখতে আগ্রহী; কেননা, বিপ্লবের অনেক উপাদান এর মধ্যে রয়েছে। তারা একে জুলাই বিপ্লব বলে অভিহিত করছেন অনেকটা লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে অনুসরণ করে। এ বিপ্লব পুরানো জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে অক্টোবর মাসে সংগঠিত হয়েছিল, যার কারণে তা অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে পরিচিত।
এর বিপরীতে মূল ধারার অর্থাৎ, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি যারা করেন বা সমর্থন করেন তারা একে বিপ্লব নয়, গণঅভ্যুত্থান হিসেবে দেখতে আগ্রহী। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বেশিরভাগ ছাত্রও একে গণঅভ্যুত্থান বলেই মনে করেন বলে তাদের আলাপ এবং লেখালেখি থেকে ধারণা করা যাচ্ছে।
শুধু বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান যে কোনো একটি দ্বারা চিত্রায়িত করা হলে হাসিনা রেজিমকে উৎখাত করবার জন্য বাংলাদেশের গণমানুষের যে জাগরণ, তাকে পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝা যাবে না। কেননা, এ জাগরণে বিপ্লব এবং গণঅভ্যুত্থান— এ দুটোরই উপাদান রয়েছে। তবে দুটোর উপাদান থাকলেও বর্তমান নিবন্ধে একে বিপ্লব হিসেবেই আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বিপ্লবের নানাবিধ বৈশিষ্ট্য এ গণঅভ্যুত্থানে রয়েছে, যা একে ১৯৬৯ এবং ১৯৯০ থেকে পৃথক করেছে।
হানা আরেন্ট ও তালাল আসাদ বিপ্লবের যে বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন; অর্থাৎ, এর লক্ষ্য বা ভিশন হবে পুরাতনকে সরিয়ে একটি নতুন ধারা এবং নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা— এর সবকিছু জুলাই বিপ্লবে রয়েছে। এর বিপরীতে গণঅভ্যুত্থানে লক্ষ্য হচ্ছে, মূলত ক্ষমতাসীন ব্যক্তির অপসারণ, ধারা বা ব্যবস্থার বদল নয়, বরং চলে আসা ব্যবস্থার আলোকেই নতুন ব্যক্তি বা দলকে ক্ষমতায় প্রতিস্থাপন।
বিভিন্ন বক্তব্য অনুসারে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতৃত্বের লক্ষ্য শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন নয়। তাদের লক্ষ্য হলো, রাষ্ট্র এবং সমাজে দীর্ঘসময়ে তাদের ভাষায় যে ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠেছে, তার মূল সমূলে উৎপাটন করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। রাষ্ট্রটি এমনভাবে তারা গড়ে তুলতে চান যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসতে না পারে।
এর মধ্য দিয়ে এ বিষয়টা পরিস্কার যে, আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে চাচ্ছেন। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়বার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো পুরানো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলা।
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব, বিপ্লবের ইতিহাসে একটা ক্লাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, গণচীন এবং কিউবার বিপ্লব— বিপ্লবের যে ধারা তৈরি করেছে তার বাইরে গিয়ে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় তরুণ প্রজন্ম বা স্পষ্ট করে বললে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে এ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে।
অন্যান্য বিপ্লবের সঙ্গে এ বিপ্লবের মূল পার্থক্য হলো, জুলাই বিপ্লবীরা সেনাবাহিনী বাদে অন্যসব রাষ্ট্রযন্ত্রকে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রের দখল নিয়েছে। রাষ্ট্রের দখল নেবার জন্য তাদের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন বা সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়নি বা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়নি।
গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের সমর্থনে সামরিক-বেসামরিক আমলারা এগিয়ে আসেন। ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর থেকে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করেন, ফলে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশের ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এরকম একটি উদাহরণ। অবশ্য বিপ্লবের ক্ষেত্রেও অনেক সময় এটা দেখা যায়।
রুশ বিপ্লবে বলশেভিকদের পক্ষে সেনাবাহিনীর সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সম্পূর্ণ গণশক্তির ওপর ভিত্তি করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ।
নতুন রাজনৈতিক পরিসর গঠন এবং ক্ষমতা কাঠামোর পালা বদলের আকাঙ্ক্ষা থেকে জুলাই বিপ্লব হলেও, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে পুরানো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অধীনেই সরকার গঠন করা হয়, যেটা বিপ্লবের চরিত্র এবং স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলবার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও ছাত্রদের সমর্থন নিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তা বিদ্যমান সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামো বজায় রেখেই করা হয়েছে। এ সরকার আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার শপথ নিয়েছে।
বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত আগের সংবিধানের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে। এ বিষয়গুলোর ফলে অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবী সরকার না হয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত একটা নিয়মতান্ত্রিক সরকারে পরিণত হয়েছে। বস্তুত এ বিষয়টা মাথায় রেখেই অনেকে ছাত্র-জনতার এ গণজাগরণকে বিপ্লব না বলে গণঅভ্যুত্থান বলতে আগ্রহী।
চব্বিশ বা জুলাই বিপ্লবের দুর্বলতাও এ জায়গাটিতে। আজপর্যন্ত আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যত বিপ্লব ঘটেছে, এর সব কয়টিতেই যারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।
কিন্তু, বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিপ্লব হলেও তারা নিজেদের বয়স বা অন্য আরও কিছু চিন্তা করে তাদের বাছাইকৃত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন— সরকারে তাদের নিজেদের মাত্র তিনজন ছাত্রপ্রতিনিধি রেখে। তারা এমন ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া কারোরই বিপ্লবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা নেই।
এটি গণঅভ্যুত্থান এবং বিপবের ইতিহাসে একটি নতুন ডাইমেনশন। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের হিস্যা বা রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও হারিয়েছেন কিনা, সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুটা সময়।
মানবজাতির ইতিহাসে ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়, তারা হস্তান্তরকারীদের তুলনায় সময়ের পরিক্রমায় শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। কেননা রাষ্ট্রের শক্তির উৎসসমূহ; অর্থাৎ বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্র, তার ওপর একপ্রকার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের হাতেই চলে আসা।
সামরিক-বেসামরিক আমলাদের সঙ্গে তাদের নানারকম যোগাযোগ তৈরি হয়, যা ক্ষমতা হস্তান্তরকারীদের চেয়ে ক্ষমতা পরিচালনাকারীদের শক্তিশালী করে তোলে। ফলে আস্তে আস্তে ক্ষমতা হস্তান্তরকারীরা এক পর্যায়ে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ধরনের বন্দোবস্তের ফলে বিপ্লব তার মূল চরিত্র হারায়।
(চলবে)