কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই অন্য দেশের জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরিস্থিতি শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তৈরি হয়।
Published : 18 Dec 2024, 07:32 PM
কেউ কেউ জুলাই বিপ্লবকে বিপ্লব না বলে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে আগ্রহী। যারা একে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে চান তাদের মধ্যে আবার দুটি পক্ষ রয়েছে। তারাও আবার দুটি ভিন্ন অবস্থান থেকে এ গণজাগরণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ফলে বর্তমান যে পরিবর্তন তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে আগ্রহী।
প্রতিক্রিয়াশীলতা বলতে বোঝায় পুরাতন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজে পুনঃস্থাপন করা। এ আকাঙ্ক্ষার অনুসারীরা মনে করেন, পুরাতন ব্যবস্থার মাঝে ইতিবাচক গুণাবলি রয়েছে, যা কিনা বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। যারা এ বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে চাচ্ছেন তাদের বক্তব্য হলো, এ বিপ্লবের মাধ্যমে পুরাতন রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্দোবস্ত ইন্তেজাম করবার পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে চাওয়া একটি পক্ষ হচ্ছে সদ্য ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং তাদের দল থেকে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্তরা। এদের আগ্রহ তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বর্তমান বন্দোবস্তের সমালোচনা নয়— ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, প্রভাব হারাবার বেদনার জায়গা থেকে সমালোচনা করা। ফলে তাদের সমালোচনার মূল লক্ষ্য হলো, সাবেকি বন্দোবস্ত ভেঙ্গে যাবার ফলে রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রাধান্যবিস্তারী ভূমিকা থেকে উৎখাত হয়ে যাবার কারণে তারা যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব হারিয়েছেন তা পুনরুদ্ধার।
রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার চেয়ে তাদের মূল আগ্রহ রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিপত্তি; এবং তার সূত্র ধরে তাদের আমলে লুটপাটের ওপর ভিত্তি করে যে মাফিয়া পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে, ওই পুঁজিবাদ পরিচালনার কর্ণধার হয়ে আবার ফিরে আসা। এ ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লবের রাজনৈতিক তত্ত্ব তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি পক্ষ জুলাই বিপ্লবকে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলে মনে করছেন। এরা আওয়ামী লীগের শাসনকে ফ্যাসিবাদী শাসন বলে মনে করেন। সাড়ে পনের বছর এরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, জুলাই বিপ্লবেও অংশ নিয়েছেন।
বিপ্লব সফল হওয়ার পর এদের অনেকে মনে করছেন— বিপ্লব পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, মধ্যযুগে ইউরোপে যে ধর্মতাত্ত্বিক-ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল— ওরকম ধাঁচের একটি রাষ্ট্র, এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গঠনের একটি নতুন রাজনৈতিক পরিসর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তৈরি হয়েছে। বস্তুত এ জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে তারা একে প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব বলতে চান।
বিপ্লবকে এভাবে যারা মূল্যায়ন করছেন তাদের বড় অংশটি হচ্ছে ইউরোপজাত সেক্যুলার রাজনৈতিক চিন্তাধারার অধিকারী, বামপন্থীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এবং আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক হলেও অন্ধ সমর্থক নয়। এরা নানাভাবে বিল্পবে সক্রিয় থেকেছেন। অবশ্য এদের আরেকটি অংশ মনে করেন, বিপ্লবের চরিত্র মূল্যায়ন করবার সময় এখনো আসেনি। এর জন্য জাতিকে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
এর বাইরে আরেকটি অংশ রয়েছে যারা ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন। তারা এ আন্দোলন গড়ে ওঠা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার ভূমিকা দেখেন না বা দেখতে চান না। তারা মনে করেন এ আন্দোলন গড়ে উঠেছে বাইরের দেশ; বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ এবং প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী।
এরা কল্পনা করতে পছন্দ করেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিতে ঈশ্বরসম। তারা চাইলে তাদের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো স্থানে যে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এমনকি গণআন্দোলন, বিল্পবও তারা গড়ে তুলতে পারে।
যদিও বাস্তবতা হলো কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই অন্য দেশের জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরিস্থিতি শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তৈরি হয়। বাইরে থেকে কোনো কিছু করে সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব নয়।
ছাত্ররা জুলাই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হলেও এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শ্রেণি নির্বিশেষে কমবেশি সব পেশা, ধর্ম এবং কট্টর আওয়ামী সমর্থক বাদে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী জনগণ সরকার পতনের এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, যেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এভাবে ইতিপূর্বে ঘটেনি।
আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথমে ছাত্রলীগের হামলা এবং পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ঢাকার আশপাশসহ কমবেশি সারা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপক হারে এতে সামিল হয়— যা আন্দোলনকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়।
এটা অনেকটাই অনুমেয় যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শরিক হবে এটা সরকারি নীতিনির্ধারকদের ধারণার বাইরে ছিল। তারা যে কোনো কারণেই হোক ধরে নিয়েছিল, কোটাবিরোধী আন্দোলন বড়জোর ঢাকা এবং দেশের কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অতি আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে সরকার মনে করেছিল, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ দিয়ে বলপ্রয়োগ করে তারা এ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে।
এ চিন্তা থেকেই মূলত তারা আদালতের ঘাড়ে ভর করে কোটাব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এটাই যে তাদের জন্য কাল হয়ে উঠবে, বর্তমান প্রজন্ম থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে পড়া, তাদের পালস এবং মনন বুঝতে অক্ষম, চাটুকার পরিবেষ্টিত সরকারপ্রধানের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব হয়নি।
আর এ না বুঝতে পারা থেকেই ছাত্রদের ওপর পুলিশ বাহিনীকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিণতিতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলে সর্বস্তরের গণমানুষ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
যে কোনো বিপ্লব, গণযুদ্ধ, গণআন্দোলন সফল হওয়ার পর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনকে এসব সংগঠিত করবার কৃতিত্ব দাবি করতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরও এটা দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের বাইরেও ষাটের দশক থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে মুক্তিসংগ্রাম সংগঠনের দিকে জাতিকে এগিয়ে নিয়েছেন— এরকম অনেকে দাবি করেছেন বা ভূমিকা রেখেছেন।
জুলাই বিপ্লব সফল হবার পর বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এবং রাজনৈতিক দল বিপ্লবে তাদের কৃতিত্ব দাবি করেছে। তারা এর জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে, এ বিপ্লব গড়ে তুলবার পেছনে তাদের কী ভূমিকা, ইত্যাদি জনগণের সামনে তুলে ধরছে।
জুলাই বিপ্লব যেহেতু কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে হয়নি তাই কোনো দল বা সংগঠনের কী ভূমিকা ছিল তা সঠিকভাবে যাচাই করা মুশকিল। তাদের ভূমিকা বুঝবার জন্য বর্তমান নিবন্ধে নির্ভর করতে হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া তাদের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত নানাবিধ আলোচনা এবং বিপ্লব পরবর্তী রাজনৈতিক বন্দোবস্তে রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনসমূহের কার্যক্রম।
এটা নিঃসন্দেহ যে, জুলাই বিপ্লব গড়ে তুলতে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমন্বয়কদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছিলেন এ সংগঠনের। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি থেকে আগত সমন্বয়কদের আর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা এটা যেহেতু এখনো জানা যায়নি বা থেকে থাকলেও তারা যেহেতু এটা প্রকাশ করেননি, সেক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে তাদের অন্য রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অনুমান বা কল্পনা, বিপ্লব সম্পর্কে সঠিক বিশ্লেষণে সহায়ক নয়।
নানাবিধ পর্যালোচনা থেকে এটাও উঠে এসেছে যে, মাঠের রাজনৈতিক অংশগ্রহণসহ নানা পর্যায়ে ছাত্রশক্তির পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবির আন্দোলন সংগঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় দল হিসেবে সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ছিল বিএনপির। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে তাদের শতাধিক কর্মী এ আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ছাত্রশিবিরের বড় অংশগ্রহণ থাকলেও এ বিপ্লবে তাদের কতজন জীবন দিয়েছেন এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তারা এখনো গণমাধ্যমকে জানায়নি। শুধু ডানপন্থীরা নয়, সরকার পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে বাম ছাত্র সংগঠনসমূহও।
বিপ্লবে সিপিবির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের অন্তত দুজন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। সেই ২০০৯ থেকে সিপিবি শেখ হাসিনাবিরোধী অবস্থানে থাকলেও, সরকার পতন প্রশ্নে দলটিতে দুটি মত দেখা যায়। একটি অংশ মনে করেছে, যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো জরুরি। অপর অংশটি পতন পরবর্তী বন্দোবস্ত ইসলামবাদী রাজনীতির জন্য জনপরিসর উন্মুক্ত করবে কিনা, এ প্রশ্নে ছিল দোদুল্যমান।
(চলবে)
আরও পড়ুন
শেখ হাসিনা সরকারের পতন: ১– গণঅভ্যুত্থান, প্রতিক্রিয়াশীল বিপ্লব, নাকি বিপ্লব