রামনাথের পৃথিবী পুনরুদ্ধার

রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটায় ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের বিশেষায়িত একটি পাঠাগার এবং বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হোক

রাজীব নূররাজীব নূর
Published : 17 Sept 2022, 01:02 PM
Updated : 17 Sept 2022, 01:02 PM

ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস বানিয়াচং নামের গ্রামটাকেই নাকি তার পৃথিবী বলেছিলেন। তিনি আদৌ তা বলেছিলেন কিনা, এর সত্যাসত্য যাচাইয়ের সুযোগ আর নেই বললেই চলে। আমাকে গল্পটা শুনিয়েছেন এক বৃদ্ধ এবং তিনি যাদের কাছ থেকে শুনেছেন, তারাও ধরাধামে নেই।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি ও আমার তিন সাংবাদিক বন্ধু আক্রান্ত হই। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। ভেতরে জরুরি বিভাগে তখনও রামনাথের বাড়ির দখলদার ওয়াহেদ ও তার ছেলেদের হামলায় আহত আমার সঙ্গী আলমগীর রেজার চিকিৎসা চলছে। বয়স্ক ওই ভদ্রলোক এসে খুব করে দুঃখ প্রকাশ করলেন, তার বাড়ির পাশে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে এলাম বলে। জানালেন, তার বাড়িও বিদ্যাভূষণ গ্রামে, রামনাথ বিশ্বাসের ভিটার খুব একটা দূরে নয়।

নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই ভদ্রলোকের নামটি লিখলাম না। ছোটবেলায় বড়দের কাছে গল্পটা শুনেছিলেন তিনি। রামনাথ বিশ্বাস চীন থেকে ফিরে বানিয়াচংয়ে এসেছিলেন। তখন কমলারাণীর সাগরদীঘির পাড়ের মাঠে তার সম্মানে একটা জমায়েত ডাকা হয়েছিল। ওই জমায়েতে রামনাথ বিশ্বাস বলেছিলেন, “বাইন্নাচুং আমার দুইন্যাই।”

“মানে বানিয়াচং আমার পৃথিবী,” ভদ্রলোক মানেটা বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষ্যান্ত হলেন না। বললেন, রামনাথ নাকি গণেশের বিশ্বভ্রমণের গল্পটা শুনিয়েছিলেন সমবেতজনকে। একবার দেবী দুর্গা তার ছেলে কার্তিক ও গনেশকে ডেকে বললেন, তোমাদের মধ্যে যে আগে পৃথিবী ভ্রমণ করে আমার কাছে ফিরে আসতে পারবে তাকে একটি রত্নহার উপহার দেব। মায়ের কথা শুনে কার্তিক ময়ূরের পিঠে চড়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে গেলেন। গণেশের বাহন ইঁদুর। কার্তিক তো নিজের জয় নিশ্চিত জেনে বেরিয়ে গেলেন। নির্বিকার গণেশ মায়ের চারপাশ ঘুরে বললেন, “মা-ই আমার পৃথিবী।”

বলা হয়ে থাকে বানিয়াচং এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম। প্রায় তিনশ’ বর্গ কিলোমিটারের একটি উপজেলাকে কেন গ্রাম বলা হয়, আমার মনে বহুকাল ধরে এই প্রশ্নটা ছিল। রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটে দেখতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়ে ফিরে এলাম হবিগঞ্জ শহরে। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী বললেন, “রামনাথ গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় চীন ভ্রমণ শেষে বানিয়াচংয়ে এসেছিলেন।”

রামনাথ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের জানা মতে, সেবার জমায়েতটা হয়েছিল, তবে সাগরদীঘি পাড়ের মাঠে নয়, হয়েছিল দীঘির অদূরে এড়ালিয়া মাঠে। সেখানে রামনাথ বানিয়াচংকে এশিয়ার নয়, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাম’ বলে দাবি করেছিলেন।

গত ১১ সেপ্টেম্বরের আগেও আমি বানিয়াচং গেছি। প্রায় প্রত্যেকবারই বানিয়াচং যাওয়া হয়েছিল বন্যার খবর সংগ্রহ করতে। ফলে সেখানকার রাজবাড়ি, সাগরদিঘী এবং জলাবন কিছুই দেখা হয়নি। এবার জলাবন নিয়ে রিপোর্ট করার মতো কিছু তথ্যও ছিল আমার সংগ্রহে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর পরিকল্পনা বদলে যায়। 

হবিগঞ্জ শহর থেকে সেখানকার ‘সমাচার’ পত্রিকার রিপোর্টার তৌহিদ মিয়ার সঙ্গে মোটর সাইকেলে রওয়ানা দিয়েছিলাম। আমাদের জন্য ওখানে অপেক্ষা করছিলেন বানিয়াচং প্রেসক্লাবের সভাপতি ও ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার প্রতিনিধি মোশাহেদ মিয়া। উনার একটি ফটোকপি ও শিক্ষা সামগ্রীর দোকান আছে। তার দোকানটা খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড। লেখা আছে ‘ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস স্মৃতি ফাউন্ডেশন’।

আমার মনে পড়ল, আরে! এখানেই তো রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি। হাওরাঞ্চলের তিন বিশ্বাস; দেবব্রত, হেমাঙ্গ আর রামনাথ আমাকে সংগীতে এবং ভ্রমণে বিশ্বস্ত হতে শিখিয়েছেন। আমি যদি নির্বাসনে বাধ্য হই, বাধ্যবাধকতা থাকে নির্বাসনদণ্ডে শুধু একজন শিল্পীকেই শুনতে হবে আমার, তবে দেবব্রত বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে যাব। ১০ জন হলে নিশ্চয় হেমাঙ্গ বিশ্বাসও থাকবেন সঙ্গে।

লেখক হিসেবে আমার কাছে রামনাথ বিশ্বাস অত অনিবার্য নন। তার গোটা ত্রিশেক ভ্রমণকাহিনি আছে, পড়েছিও বেশ কিছু। সেই কবে মনে নেই, যখন জেনেছিলাম, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে রামনাথ বিশ্বাস বাইসাইকেলে করে পৃথিবী ঘুরে এসেছিলেন, তখন ভেবেছিলাম আমি হেঁটে হেঁটে দেশটা ঘুরে দেখব। হেঁটে না হলেও আমি তো ঘুরছি দেশজুড়ে। এক বানিয়াচংয়েই অন্তত পাঁচবার গেছি। আবারও যাব নিশ্চয়। যেতে হবে, আমি তো এখন রামনাথের পক্ষভুক্ত হয়ে গেছি।

স্কুলে পড়ার সময়ই আমার পড়া হয়েছিল রামনাথের লেখা ‘লাল চীন’। এক চীন নিয়েই তার তিনটি বই আছে, বাকি দুটো ‘মরণ বিজয়ী চীন’ আর ‘মুক্ত মহাচীন’। মাও জেদংয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। মানুষ হিসেবে আমাদের হাওরের ব্রাহ্মণ সন্তান রামনাথ ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক। আফ্রিকা ভ্রমণের গল্পে আফ্রিকানদের তিনি নিগ্রো লিখলেও নিগ্রোদের প্রতি ভালোবাসার গল্প আমরা পাই। তখন পর্যন্ত শব্দটি ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ বলে পরিত্যাজ্য হয়নি। ‘নিগ্রোদের’ সঙ্গে থাকার কারণে ভারতীয় হিন্দুদের আশ্রম থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, ‘কে সভ্য কে বর্বর’ বলে গেছেন রামনাথ বিশ্বাস। কলকাতার দাঙ্গায় একাই রামনাথ ৩৯ জন মুসলিমকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়ে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন বলে জানালেন রামনাথ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী।

১৮৯৪ সালে বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় তার জন্ম। বানিয়াচংয়ের লোকজন এখনও তাদের গ্রামগুলোকে পাড়া বলে ডাকেন। ইউনিয়নগুলো নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেন। পুরো বানিয়াচং একটা গ্রাম, সেই দাবির যৌক্তিকতা ধরে রাখার জন্যই এমনটা করেন বলে আমার ধারণা, যে ধারণার জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস।

বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রামনাথ। এরপর তার বাবা বিরজানাথ বিশ্বাসের মৃত্যু হলে পড়াশোনার ইতি ঘটে। মা গুণময়ী দেবীরও অকাল মৃত্যু হয়েছি। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রামনাথ হবিগঞ্জে ভাণ্ডার সমিতি বলে একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার পদে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি বাইসাইকেল ও মোটর গাড়ি চালানো শিখেছিলেন।

ওই সময় তিনি অনুশীলন সমিতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের সঙ্গে তার যোগ প্রকাশ হয়ে গেলে চাকরি হারান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে চলে যান মেসোপটেমিয়ায়। সেটা ১৯১৪ সালের কথা। সৈনিক জীবনে ঘুরে বেড়াবার যে সুযোগ পেয়েছিলেন সেই অনুপ্রেরণায় ১৯৩১ সালের একদিন সাইকেল নিয়ে পথে নামলেন।

তখন তিনি সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন, যে দেশে গিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের শেষের দিকে। রামনাথের জীবনীকার শ্যামসুন্দর বসুর লেখা থেকে জানা যায়, সঙ্গে এক জোড়া চটি, দুটি চাদর নিয়েছিলেন। বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে একটি বাক্সে ছিল সাইকেল মেরামতের সরঞ্জাম। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে যখন যাত্রা শুরু করেন, তখন সেখানকার বাঙালি মসজিদের সামনে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ উপচে পড়েছিল তাকে বিদায় জানাতে। সমবেতজনের বেশিরভাগই ছিলেন সিলেটি। তারা বন্দে মাতরমের পাশাপাশি আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে কুইন স্ট্রিট মুখরিত করে তুলেছিল বলে রামনাথের জীবনীকার লিখেছেন। 

সেবার তিনি সাইকেলে করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান হয়ে কানাডায় পৌঁছান। কানাডায় তাকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২৯ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা হয়ে ১৯৩৪ সালে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। সেবার বানিয়াচংয়ের সাগরদীঘির পাড়ের মাঠে, মতান্তরে সাগরদীঘি পাড়ের অদূরে এড়ালিয়া মাঠে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই সভার গল্প ঘুরেফিরে শুনতে পাবেন বানিয়াচংয়ের লোকজনের কাছে। আমাকে বানিয়াচং হাসপাতালের সামনে এক বৃদ্ধ এবং হবিগঞ্জ শহরে রামনাথ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী শুনিয়েছেন গল্পটি।

১৯৩৪ সালে রামনাথ দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন। সেবার তিনি আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ব্রিটেন পৌঁছান। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডও তিনি সাইকেলে পরিভ্রমণ করেন।

সেই যাত্রায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি লন্ডন থেকে জাহাজে মুম্বাই ফিরে আসেন। সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। ততদিনে রামনাথের লেখা ছাপা হচ্ছে ‘দেশ’ সাময়িকীতেও। কবিগুরু তার ভ্রমণকাহিনি পড়েছেন এ কথা জেনে খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন রামনাথ।

তৃতীয়বারের যাত্রা শুরু করেন ১৯৩৮ সালে। সেবার রামনাথ বিশ্বাস আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। মুম্বাই থেকে তিনি জাহাজে মোম্বাসায় পৌঁছে সেখান থেকে সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভালো লাগেনি বলে লিখেছিলেন। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে চলে আসেন বানিয়াচংয়ে। ততদিনে ভ্রমণ সাহিত্য রচনায় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।

কলকাতা আর বানিয়াচংয়ে যাতায়াতের মধ্যে থাকলেও অকৃতদার রামনাথ বিশ্বাস নিজ ভিটাতে থিতু হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পুরোপুরি কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই ১৯৫৫ সালের নভেম্বর মাসে মারা যান।

কলকাতায় রামনাথ বিশ্বাসের নামে একটা রাস্তা আছে। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরের আগে আগে মোশাহেদ মিয়ার সঙ্গে গল্পে জানতে পেলাম, রামনাথের জন্মস্থান বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণে তার ভিটাটাও বেদখল হয়ে গেছে। জলাবনে যাওয়ার পরিকল্পনাটা তখনই বাতিল করে দিলাম।

আমার সঙ্গে তো তৌহিদ মিয়া ছিলেন মোটর সাইকেলসহ। মোশাহেদ ডেকে আনলেন আলমগীর রেজাকে। ‘দেশসেবা’ পত্রিকার বানিয়াচং উপজেলা প্রতিনিধি তিনি। তবে প্রথম পরিচয়ে আমাকে বলেছিলেন, তিনি একজন আর্টিস্ট। টুকটাক আঁকাআঁকি এবং কম্পিউটার গ্রাফিকস করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সততার সঙ্গে জীবনযাপন করতে চাইলে বেশিরভাগ উপজেলা প্রতিনিধিরই শুধু সাংবাদিকতায় জীবন চলে না।

মোশাহেদ মিয়ারও একটা দোকান আছে। ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার বানিয়াচং প্রতিনিধি মোশাহেদ এর আগে ছিলেন ‘প্রথম আলো’তে। আমিও তখন ‘প্রথম আলো’য় কাজ করতাম। পুরোনো সহকর্মীকে পেয়ে মোশাহেদ ছিলেন উৎফুল্ল। বানিয়াচংয়ের রাজবাড়ি আর সাগরদীঘি ঘুরে রামনাথের বাড়িতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল আমাদের। যাওয়ার পথে মোশাহেদ একবার সঙ্গে পুলিশ নিয়ে যাবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন।

“কেন মারবে নাকি ওরা?” আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “না। গালি-গালাজ করবে।”

গালিগালাজে কী যায় আসে— এই রকম ভেবে তাকে নিরুৎসাহিত করি।

বাড়িটা আলমগীরের খুবই চেনা। তবু আমি পথের ধারে দেখা হয়ে যাওয়া দুটি বাচ্চার কাছে ওই বাড়িটা কার জানতে চাইলে ওরা কোনো দ্বিধা না করেই বলল, রামনাথ বিশ্বাসের।

রাস্তা থেকেই ছবি তুলছিলাম আমি। চার একর ৪৮ শতাংশ জায়গায় নিয়ে ওই বাড়ির সামনের দিকটায় একটি পুকুর রয়েছে। অনেক বড় বড় গাছপালা দেখে এবং গাছে বসা পাখির ডাক শুনতে শুনতে মনে হয়েছে একেই ‘ছায়াঢাকা পাখিডাকা’ গ্রাম বলা হয়।

বাড়িতে বসতঘরের সঙ্গে একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির ছিল বলে জানিয়েছিলেন বানিয়াচংয়ের দুই সাংবাদিক মোশাহেদ ও আলমগীর। বাড়ির পুরোনো সব ভবন ভেঙে ফেলেছেন দখলদার ওয়াহেদ। শুধু মন্দিরের একাংশ এখনও রয়ে গেছে। সেটিও একটু একটু করে ভাঙা হচ্ছে। আমি মন্দিরটিরও বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলেছিলাম। তবে আলোর কারণে ছবি ভালো হয়নি বুঝতে পারছিলাম। তাই সামনে গিয়ে আরো একটা ছবি তুলে ফেললাম। ততক্ষণে মোশাহেদ সালাম দিয়ে ওয়াহেদ মিয়াকে ডাকলেন। তিনি এসে সৌজন্যের ধারে-কাছে না গিয়ে ছবি তোলা হলো কেন, সেই কৈফিয়ত দাবি করলেন। আমি বলি, এটা তো রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি ছিল, তাই।

“রামনাথ বিশ্বাস কে? এটা মণি বিশ্বাসের বাড়ি। আমরা তার কাছ থেকে এই বাড়ি কিনেছি।”

ততক্ষণে দস্যুর মতো তেড়েফুঁড়ে আসতে শুরু করেছেন ওয়াহেদের ছেলেরা। তারা আমার মোবাইল কেড়ে নিলেন। আমার মোবাইল কেড়ে নিতে গিয়ে হাত মচকে দিলেন। আমাকে বাধ্য করলেন প্যাটার্ন লক জানাতে।

আমার ওপর হামলার প্রতিবাদ করায় অন্যদের ওপর হামলে পড়েন ওরা। আলমগীর রেজা পাশের গ্রামের ছেলে। তাই বোধহয় তিনি আমাকে রক্ষা করার দায় বেশি অনুভব করেছিলেন। তার প্রতিবাদ ছিল জোরালো। ওকেই মেরেছে বেশি ওয়াহেদ ও তার ছেলেপেলেরা। ইট দিয়ে ওয়াহেদের ছেলে ওয়ালিদ যে আঘাতটা আলমগীরকে করতে চেয়েছিল, মোশাহেদ পেছন থেকে টেনে ধরতে না পারলে সেদিন খুন হয়ে যেতে পারত একটা। এই রকম আক্রমণকে বোধ হয় আইনের ভাষায় ‘হত্যাচেষ্টা’ বলা চলে। হবিগঞ্জ থেকে আমার আইনজ্ঞ বন্ধুরা বলছেন, মামলা ‘শক্ত হয়নি’, তাই আসামিরা জামিন পেয়ে গেছেন।

কারো মাথায় ইট মারার চেষ্টা। লাঠিসোঁটা নিয়ে শোরগোল তুলে আতঙ্ক তৈরি করা, তা-ও কি কম অপরাধ? আমার তখন মনে হয়েছিল, প্রাণসংশয় হতে পারে আজ। ওই আতঙ্কঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। এখনও পুরোপুরি স্বস্তি বোধ করতে পারছি না।

রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা প্রথমে যাই ২ নম্বর বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়ার বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধে হাওরাঞ্চলে দাশ পার্টির ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দাশ পার্টি নামে পরিচিত ওই গেরিলা দলটির অধিনায়ক বীরউত্তম শহীদ জগৎজ্যোতি দাশের সহযোদ্ধা ধন মিয়া বললেন, “ওয়াহেদ একজন দখলদার। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি অনেকবার চেষ্টা করেও আমরা দখলমুক্ত করতে পারিনি। কিছুদিন পরপরই নিজের নামে নামজারি করে ফেলে ওয়াহেদ। কিন্তু আমরা সেটা বাতিল করি। ওয়াহেদের বড়ভাই আবু ছালেক এই এলাকার চিহ্নিত আলবদর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছে ছালেক।”

হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া তখন বলেননি যে আল-বদর বাহিনীর চিহ্নিত ছালেক মিয়ার ভাই ওয়াহেদ তারই দলের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি। অথচ বড় ভাইয়ের রাজনীতিতে দীক্ষিত ওয়াহেদ জামায়াত ইসলামী থেকে বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগে এসে নেতা বনে গেছেন। পরে যখন সব জেনে তাকে ফোন করলাম, তিনি বললেন, “ওকে দল থেকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

অবশেষে ওয়াহেদ বহিষ্কৃত হয়েছেন। তবে শুনতে পাই, আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে হম্বিতম্বি করতে শুরু করে দিয়েছেন। শুনলাম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ওয়াহেদের পক্ষে হবিগঞ্জের আদালতে মামলা লড়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী।

আমি আলমগীর চৌধুরীর কাছে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, যে লোকটাকে দুদিন আগে আপনারা দল থেকে বহিষ্কার করলেন, যিনি রামনাথ বিশ্বাসের মতো বিখ্যাত মানুষের বাড়ি দখল করে রেখেছেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগে আসামি হলেন, তার পক্ষে আপনি আদালতে দাঁড়ালেন কেমন করে? আর এমন একটা লোক এত বছর আপনাদের দল করলেন কীভাবে? তৃণমূলের শুরু যেখানে, সেই রকম একটি ইউনিটে একজন চিহ্নিত রাজাকার, যিনি একাত্তরের পরে জামায়াতে ইসলামী করতেন, তিনি বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগে এলেন কেমন করে? শুধু আওয়ামী লীগে আসা নয়, দলের শীর্ষ পদ দখল করে ছিলেন এতদিন!

আলমগীর চৌধুরীর দাবি, তিনি নন, আদালতে ওয়াহেদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তার বন্ধু। ওয়াহেদ মিয়া ২৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করছেন। কিন্তু তার পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে, আমরা আক্রান্ত হওয়ার পর।

আমি কথা বাড়াইনি। কারণ আলমগীর চৌধুরী কথা দিয়েছেন রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধারের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যা করা দরকার, তার সবকিছুই করবেন। এমন কী হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং পর্যন্ত ‘বাইসাইকেলে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ির পথে’ যে শোভাযাত্রা হবে, সেখানেও থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আমাদের ওপর ওয়াহেদ ও তার ছেলেরা যে হামলা করেছে, তার বিচার চেয়ে অনেক মানুষ মাঠে নেমেছেন দেখতে পাচ্ছি। আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। আমিও বিচার চাই আমাদের ওপর হামলার। আইন অনুযায়ী যতটা শাস্তি ওয়াহেদ ও তার ছেলেদের পাওনা হয়, তার চেয়ে একটু যেন কম না হয় বিচারটা। সেই সঙ্গে চাই, সবাই যেন রামনাথ বিশ্বাসের দখল হয়ে যাওয়া বাড়িটি উদ্ধার করে সংরক্ষণের দাবি জানান।

এরই মধ্যে আমার বন্ধু, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল একটা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তারই উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ‘ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি'। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসে হবিগঞ্জ থেকে সাইকেল চালিয়ে বানিয়াচংয়ে রামনাথের বাড়ি পর্যন্ত যাবেন তিনি।

‘আমাদের প্রজন্মের রামনাথ বিশ্বাস’ বলে পরিচিত আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল বাইসাইকেলে করে এ পর্যন্ত ৬০টিরও বেশি দেশ ঘুরে এসেছেন। তার সঙ্গে সাইক্লিস্টরা আরও অনেকেই অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

আমি উজ্জ্বলকে অনুরোধ করেছি, রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটায় ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের বিশেষায়িত একটি পাঠাগার এবং বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হোক। আমার মনে হয়, এটা করা গেলেই রামনাথের ‘পৃথিবী বানিয়াচং’ রামনাথকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।