সাদা পোশাক উইম্বলডনের ঐতিহ্য; কিন্তু মাসিকের দিনে ওই সাদা পোশাকই যে একজন টেনিস খেলোয়াড়কে বাড়তি মানসিক চাপে ফেলে দেয়, তা আর চেপে না রেখে অকপটে প্রকাশ করলেন অলিম্পিক জয়ী সাবেক টেনিস তারকা মনিকা পুইগ।
Published : 12 Jul 2022, 12:30 PM
তিনি যখন টুইটে বিষয়টি নিয়ে লিখলেন, তাতে কল্পনাতীত সাড়া মিললো। কারণ মনিকা পুইগ কী বলতে চাইছেন, অনেকেই তা উপলব্ধি করেছেন নিজের জীবনে।
বিবিসি লিখেছে, ব্যথা-বেদনা, ক্লান্তি তো আছেই সেই সঙ্গে ‘ওহ, দাগ লেগে গেল না তো?’- এমন তাড়া করে ফেরা অস্বস্তি নিয়ে আসে পিরিয়ড; সে কথা বুঝেই মনিকা পুইগকে সমর্থন জানিয়েছেন অনেকে।
শুধু এই টেনিস খেলোয়াড়ের মন্তব্য নিয়েই আলোচনা চলেনি; বরং টেনিসের ড্রেস কোড এবং মাসিক নিয়ে বিশদ আলাপে অংশ নিয়েছেন অনেকে।
কেউ কেউ স্বীকারও করে নিয়েছেন, এটা যে একটা সমস্যা, তা গত মাসে পুয়ের্তো রিকোর মনিকা পুইগ বলার আগ পর্যন্ত তারা উপলব্ধি করতে পারেননি।
গত ৩১ মে টুইট করে মনিকা পুইগ বলেন, ”কিছু একটা তো রয়েছে যা নারী খেলোয়াড়দের খেলায় বাজে প্রভাব ফেলে। সবার নজরে আনছি সে কথা।
“উইম্বলডনে সাদা পরে খেলার সেই মানসিক চাপ বলাই বাহুল্য, যখন প্রার্থনা করতে হয়, এই দুই সপ্তাহ যেন পিরিয়ড না হয় কোনোভাবে।”
রিও দে জেনেইরোর ২০১৬ আসরে টেনিস কোর্ট থেকে পুয়ের্তো রিকোকে প্রথম অলিম্পিক সোনা এনে দিয়েছিলেন মনিকা পুইগ।
Definitely something that affects female athletes! Finally bringing it to everyone’s attention! Not to mention the mental stress of having to wear all white at Wimbledon and praying not to have your period during those two weeks. https://t.co/PzyHnPlSJk
— Monica Puig (@MonicaAce93) May 31, 2022
মেয়েদের টেনিসে সাবেক ‘ব্রিটিশ নম্বর ওয়ান’ হিদার ওয়াটসন বিবিসি স্পোর্টকে বলেন, “সব কিছুকে সাদা করার কারণেই এটা নিয়ে উইম্বলডনে খেলোয়াড়রা কথা বলেন।
“আমার মনে হয় লোকে এসব নিয়ে প্রচুর কথা বলে, হয়ত সংবাদমাধ্যমের সামনে বলে না, কিন্তু নিজেদের মধ্যে যে বলাবলি করে, এটা নিশ্চিত।”
উইম্বলডনে সাদা রঙের পরম্পরা
গোড়া থেকেই উইম্বলডনে সাদা রঙকে খেলার সব উপকরণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ রঙিন কাপড়ে ঘামের দাগ সহজেই দেখা যায়; সাদা কাপড়ে তা বোঝা যায় না।
উইম্বলডনে সাদা রঙের এই নিয়ম বেশ কঠোর। শর্টস, স্কার্ট, ট্র্যাকস্যুট সবই ধবধবে সাদা হতে হবে। ব্যতিক্রম বলতে কাপড় সেলাই অংশে এক রঙ দেওয়া যাবে; তবে তা এক সেন্টিমিটারের বেশি চওড়া হতে পারবে না।
সাদা পোশাকে খেলা ওয়াটসনের কাছে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, “আমার আসলে সাদার এই ঐতিহ্য বেশ লাগে। আমি একে বদলাতে চাই না।
“আমার একটাই চিন্তা থাকে, যদি ওই সময় পিরিয়ড হয়! এসবের মধ্যেই আমাকে মাসিক সামলাতে হয়।”
টুর্নামেন্টের মধ্যে মাসিক বন্ধ রাখার জন্য খেলোয়াড়দের অনেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করেন। কিন্তু তাতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বন্ধ হয় না, আর সেটা খেলায় সময় বিরূপ প্রভাব ফেলে।
“আমি ঢেকুর তুলতে থাকি, আমার পেট কামড়াতে থাকে এবং ক্লান্ত লাগে অনেক,” বলছিলেন ওয়াটসন।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডে হেরে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ এই টেনিস তারকা। সেদিন পিরিয়ড ছিল তার; যা ছাপ পড়েছিল খেলায়।
হিদার ওয়াটসন সেই টেনিস খেলোয়াড়দের একজন, যারা মাসিকের বিষয়টি নিয়ে প্রথম কথা বলতে শুরু করেছিল।
কিন্তু কোর্টে নামার দিনই তার পিরিয়ড শুরু হয়। প্রতিবার মাসিকের কয়েকটা দিন খুব বাজে কাটে তার, সব শক্তি যেন ফুরিয়ে আসে। ৬-৪, ৬-০ সেটে সেদিন ম্যাচ হারতে হয়েছিল ওয়াটসনকে।
এরপর নিজের দেশের গ্র্যান্ড স্লাম উইম্বলডনের টুর্নামেন্টের মধ্যে যখন মাসিকের দিনটা এল, ওয়াটসন এর সমাধান না খুঁজে পারলেন না।
“কিছুদিন আগেই আমি সত্যি সত্যি বিষয়টা নিয়ে কথা বলছিলাম ডারিয়ার ( ডারিয়া স্যাভিলে, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়) সঙ্গে; আমরা একসঙ্গে উইম্বলডনে প্র্যাকটিস করতে গিয়েছিলাম।
“তো, সেদিন যখন আমার পিরিয়ড শুরু হল, আর উইম্বলডনে যেহেতু সারা বছরই সাদা পোশাক পরতে হয়, আমার মনে হল, ‘উফ, এত বড্ড বিরক্তিকর!’
”তারপর আমি তারিখ হিসাব করে দেখলাম, টুর্নামেন্টের মধ্যেই আমার আবার পিরিয়ড শুরু হতে পারে। তখন ঠিক করলাম আমি জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল নেব, যাতে উইম্বলডনের মধ্যে পিরিয়ড এড়ানো যায়। আসলে এরকম পরিস্থিতিতে মেয়েরা এভাবেই চিন্তা করে, আর এভাবেই কথা বলে।”
ফিনল্যান্ডের হেনরি কনটিনেনকে সঙ্গী করে এই উইম্বলডনেই ২০১৬ সালে মিক্সড ডাবলস শিরোপা জেতেন হিদার ওয়াটসন।
পিরিয়ড আর খেলার ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে নানাভাবে আলোচনা হলেও খেলার সময় মেয়েদের সাদা পোশাকের অস্বস্তির বিষয়টি খেলোয়াড়রা অনেকটা নিজেদের মধ্যে আলাপেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
মাসিক এড়াতে সব নারী খেলোয়াড়ই যে পিল নিতে চান, তা নয়। খেলার ওপর মাসিক যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি পিল নিলেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে।
২০২০ সালে বিবিসির উইমেনস স্পোর্ট সার্ভেতে ৬০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই বলেছিলেন, পিরিয়ডের কারণে তাদের খেলায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আর ৪০ শতাংশ বলেছেন, পিরিয়ড নিয়ে কোচের সঙ্গে কথা বলতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
আরও অনেক নারী ক্রীড়াবিদ পিরিয়ড নিয়ে কথা বলেছেন। এ বছর ফ্রেঞ্চ ওপেনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা ইগা সোয়াইয়াটেককে কেবল একজনই একটি সেটে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছিলেন; তিনি ঝেং কিনওয়েন।
শেষের দুই সেটে তার জয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ ওই সময় তার পেট কামড়ানো শুরু হয়েছিল।
পরে তিনি বলেছিলেন, ঝামেলা যেটা করেছে, সেটা একদমই ‘মেয়েলি বিষয়’। আমাকে খেলতে হবে, কিন্তু আমার মাসিকের প্রথম দিনটা সবসময়ই প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে আসে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে তো আমি কিছু করতে পারি না।”
পেট্রা কিটোভা ২০১৫ সালে উইম্বলডন শুরুর আগে মাসিক নিয়ে কথা বলেছিলেন। সাদা পোশাক নিয়ে আপত্তি না থাকলেও তিনি বলেছিলেন, “এটা এমন এক কঠিন বিষয়, যার সাথে পেরে ওঠা সহজ নয় মোটেও। যদি আমাদের খেলতে হয়, প্রশিক্ষণ নিতে হয়, বা অন্য কিছু করতে হয়, এটা সত্যিই কঠিন হয়ে ওঠে।”
উইম্বলডনে খেলোয়াড়দের জন্য একটি রিলেশন টিম আর একটি মেডিকেল টিম রয়েছে; যারা তাদের সঙ্গে যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করেন, এর মধ্যে পিরিয়ডও রয়েছে।
উইম্বলডনের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা নারীস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিতে চাই সবার আগে। প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুসারে যা দরকার হয় তাই দিতে চাই।
”তিনি কেমন বোধ করছেন, কারো সঙ্গে কথা বলতে চান কি না- সবরকম ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে এই টিম সহায়তা দিয়ে থাকে।”
তবে মাসিক নিয়ে কথা বলতে অনেক খেলোয়াড়ের মধ্যে অন্য ভয়ও কাজ করতে পারে; অনেকেই মনে করতে পারেন, খারাপ খেলার ছুতো হিসেবে মাসিকের কথা বলছেন তারা।
টয়লেট বিরতি
গ্রিসের টেনিস খেলোয়াড় স্তোফানোস সিসিপাস ২০২১ সালে ইউএস ওপেনে যে টয়লেট বিরতি নিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল; অনেকেই বলছিলেন এটা ছিল টাইমআউট হওয়ার একটা কৌশল।
নারী ও পুরুষ উভয়ের বেলাতেই গ্র্যান্ড স্লামে টয়লেট বিরতি দেখা গেছে।
ধরা যাক, একজন নারী খেলোয়াড় তার স্যানিটারি প্যাড অথবা ট্যাম্পুন বদলে নিতে টয়লেট বিরতি চাইছেন। তিন ম্যাচের মধ্যে শুধু একবারই তিনি এই আবেদন করতে পারবেন।
তাকে তিন মিনিট সময় দেওয়া হবে; যদি পোশাক বদলাতে চান, তবে পাঁচ মিনিট সময় পাবেন।
গ্র্যান্ড স্লামের বিধিতে বলা আছে, নির্ধারিত সময়ের বেশি নিলে ওই খেলোয়াড়কে সময় নিয়ে নিয়ম ভঙ্গের কারণে জরিমানা করা হবে বা শাস্তি দেওয়া হবে।
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নারী খেলোয়াড়কে টয়লেটে যেতে হবে, প্যাড অথবা ট্যাম্পুন বদলাতে হবে, ব্যবহার করা প্যাড বা ট্যাম্পুন ডাস্টবিনে ফেলতে হবে, নিশ্চিত হতে হবে নতুন স্যানিটারি প্যাড লিক করছে না এবং তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করছেন না। জরুরি হলে পোশাকও পাল্টাতে হবে এবং সবশেষে খেলার মাঠে ফিরতে হবে সময়ের মধ্যেই।
টয়লেট বিরতি কতক্ষণের হবে সেই সিদ্ধান্ত সাধারণত আম্পায়রই নিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে বাড়তি সময়ের জন্য আবেদন করা যায়। যদিও আম্পায়ায়ের কাছে সেই আবেদন করতে হয় মাইক্রোফোনে ও ক্যামেরার সামনে। আর অনেক খেলোয়াড়ই এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
বেশ কিছু কোম্পানি পিরিয়ড-প্রুফ পোশাক নিয়ে আসার কথাও বলছে। অ্যাডিডাস বিবিসি স্পোর্টকে বলেছে, নারী খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত পোশাকেও এ ধরনের প্রযুক্তি তারা আনবে।
উইম্বলডন কর্তৃপক্ষও তাদের সাদা পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি নারী খেলোয়াড়দের সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন নিরীক্ষা করছে।
একজন মুখপাত্র বলেন, “২০১৯ সালে আমাদের পোশাক বিধিতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যেন খেলোয়াড়রা অনুমোদিত লেগিংস এবং উরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত শর্টস পরতে পারেন। যদি সাদা পোশাকের নিচে কেউ কিছু পরতে চান, তাতে কোনো রকম আপত্তি নেই।
২০২১ সালের অ্যাডিডাসের এক জরিপ বলছে, প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে বয়ঃসন্ধি বেলায় এসে খেলার মাঠ থেকে হারিয়ে যায়; তাদের মূল ভয় মাসিকের দিনে খেলতে গিয়ে কাপড়ে দাগ লেগে যাবে।
সেই প্রসঙ্গ ধরে হিদার ওয়াটসন বলছেন, এজন্যই মাসিকের বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। মাসিক যদি কারো খেলা ছাড়ার কারণ হয়, তাহলে এই আলোচনা থেকে তারা হয়ত বুঝবে।
“মানুষ জীবনের অনেক কিছু নিয়ে বলতে চায় না, আর আমি বুঝি না কেন এমন হবে। এটা তো প্রকৃতির নিয়মেরই অংশ, তাই না? প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে একে সামলায়।”
উইম্বলডনেই যে শুধু সাদা পোশাকের রীতি রয়েছে তা নয়, টেস্ট ক্রিকেটাররাও খেলার সময় রক্তপাত হওয়ার অস্বস্তি নিয়ে কথা বলেছেন।
সাদার এই পরম্পরা শুরু হয়েছিল উনিশ শতক থেকে, আর সেসময় পিরিয়ড নিয়ে এত খোলামেলা কথা বলত না কেউ।
১৮ বার গ্র্যান্ড স্লাম জয়ী বিশ্বের সাবেক এক নম্বর টেনিস তারকা ক্রিস এভার্ট সম্প্রতি বলেছেন. “পিরিয়ড আমার পেশাগত জীবনে কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে যদি আমি আগে কথা বলতে পারতাম!”
সময় এখন পাল্টাচ্ছে, সেই সব কথা এখন সবাই বলা শুরু করেছেন।