কাহিনিটির মাধ্যমে যে কৃষ্ণ-প্রহসনের অবতারনা ঘটালেন মুরাকামি, সেটি কাফকা’র সঙ্গে তুলনীয়।
Published : 07 May 2024, 08:24 PM
নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে অনেক উটকো গুজবের মতো, একটি কথা আন্তর্জাতিক সাহিত্যের মহলগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। ছোটগল্প নাকি আজকের দিনে এক ‘মৃতপ্রায় শিল্প’ বা ‘ডায়িং আর্ট’, কারণ পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে যে আধুনিককালের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা আর ছোটগল্প লিখছেন না। প্রকাশকেরা যদিও এই ধরনের গুজবকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষাতে ছোটগল্প লেখা হয়ে চলেছে, চলছে ছোটগল্পকে কেন্দ্র করে নিত্যনতুন গবেষণাধর্মী আলোচনা, এবং বড়ো বাজেট নিয়ে একের পর এক ছোটগল্পের বইও প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্বের বাজারে। অন্য সব বিশিষ্টতা বাদ রেখে আলোচনা করলেও, গত কুড়ি বছরে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভক্ষতির হিসেবেই জাপানের হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্প বিশিষ্ট আসন লাভ করেছে। জাপানি-ভাষায় রচিত লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া তাঁর উপন্যাসগুলো ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আজ বেস্টসেলার। সেরকমই মুরাকামি’র ছোটগল্পের অনুবাদও তাঁর উপন্যাসের মতো একইরকম আদরণীয়। মুরাকামি’র ছোটগল্প-সংকলনগুলোর অধিকাংশই আগের শতকের শেষবেলায় প্রকাশিত, কিন্তু ইংরেজি-অনুবাদে বইগুলোর বিশ্বের বাজারে পদার্পণ বেশিদিন আগেকার নয়। জাপানি-ভাষার হালের সবচাইতে জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের ছোটগল্পে কী এমন বিষয়ধর্মীতা রয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের পাঠকের কাছে নিরবচ্ছিন্ন আবেদন রেখে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে? ব্যাপারটিকে আধুনিক এক-সংস্কৃতির বিশ্ব বা বিশ্বায়নের নিরিখে ভাবতে চাইছেন অনেকেই। মুরাকামি’র বিশ্বে পূব আর পশ্চিমের সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে চলা রয়েছে, সংঘাত এবং পরাভব রয়েছে, কিন্তু দুই সংস্কৃতির ‘এক’ হয়ে যাওয়ার কথা কোত্থাও বলা নেই। আপাতত সামনের অনুচ্ছেদগুলোতে বিষয়টিতে আলোকপাত করতে চেষ্টা করব আমরা, যাতে হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্পের বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়তার কারণগুলো আমাদের চোখে স্বচ্ছতর হয়ে ওঠে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখাটা বাঞ্ছণীয়, ছোটগল্প লেখায় যে ভাটা পড়েছে পশ্চিমে, ব্যাপারটিকে প্রথমে সরলিকৃত করে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ইংরেজিসহ অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষার পাঠকসমাজ হয়ত ছোটগল্পের ভেতর দিয়ে বহুচর্চিত সাহিত্যরূপকে নতুন করে আর স্মরণ করতে চাইছেন না। সাহিত্যকীর্তির পুনরাবৃত্তি, নাকি এক বা একাধিক চিন্তাকে বারবার কথিত হতে দেখা যাচ্ছে সাহিত্যে? মুরাকামি’র প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘হাতিটা উধাও’ (১৯৯৩) যখন জাপানি থেকে ইংরেজি অনুবাদে পাঠকসমাজের হাতে এসে পৌছোয়, আন্তর্জাতিক ছোটগল্পের জগতে তখন পূবের ভূমিকাটুকু কী ছিল? সাত এবং আটের দশকের শেষে জনপ্রিয় কথা-সাহিত্যে মূলত দু’টি ট্রেন্ড বা ধারাকে লক্ষ্য করা গিয়েছে। একদল সাহিত্যিক ছোটগল্পকে আধুনিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ভীষণভাবে ইয়োরোপ-কেন্দ্রিক আখ্যানের প্রাচীন ধারাটিকে লালিত করে গিয়েছেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি আখ্যানের সুষমা, দলীয় কি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক বীক্ষা, ইতিহাস বা ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা, এতসব শর্তের নিরিখে ভিন্নমত হয়েও এই ধারার প্রত্যেকেই ছিলেন একশো শতাংশ ইয়োরোপ-কেন্দ্রিক, এবং সেইসঙ্গে আধুনিক আমেরিকা ছিল তাদের সাহিত্যের অন্যতম আলোচ্য। পূব এবং তার ইতিহাস কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে এতটুকুও ভাবিত ছিলেন না তাঁরা। এই ধারার লেখকদের পাশাপাশি দ্বিতীয় যে সর্বজনীন ধারাটি ধীরে চলতে শুরু করেছিল, সেটি অচিরে এমনই পরিসংখ্যানগত জনপ্রিয়তা লাভ করে যা পূব আর পশ্চিম উভয়ের নিরিখে ‘বেস্টসেলার’ তালিকার শীর্ষের বইগুলোকে নির্দেশিত করতে থাকে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা রেখে দ্বিতীয় ধারাটির চলন এবং অভিক্ষেপগুলোকে আপাত চোখে দেখলে সন্দেহ জাগতে পারে, এটি হয়ত বিশ্বায়ন কিংবা এক-বিশ্বের কোনও সাংস্কৃতিক ফলাফল। কিন্তু আদৌ যে এটি কোনও এক বা একাধিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর অর্থনৈতিক বিবর্তন কি পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল নয়, তার কারণ হল পূবের লেখকদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপস্থিতি। ছ’য়ের দশক থেকেই পূবের সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভার নিয়মিত ইংরেজি ও অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষাতে অনুবাদ শুরু হয়। যে ধারায় বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পেতে শুরু করেন জাপানের কাওয়াবাতা, মিশিমা, মিশরের নাগিব মাহফুজ, রবীন্দ্রনাথ। বলা বাহুল্য, এঁরা প্রত্যেকে ‘নোবেল-পুরষ্কার’ বিজয়ী সাহিত্যিক। এভাবে অনুবাদের মাধ্যমে পশ্চিমের পাশে বৃহত্তর পূবেও পৌঁছোতে থাকে নিজস্ব আখ্যানভঙ্গিতে লিখিত পূবের সাহিত্য। কিন্তু ধারাটি ছিল বহুলাংশে শীর্ণ। পূবের অধিকাংশ লেখক আজও হয়ত সাংস্কৃতিক অন্ধকারে রয়ে যেতেন, যদি না মার্কিন বা ইয়োরোপের অভিবাসী পূবদেশের লেখকেরা ইংরেজিসহ অন্যান্য ইয়োরোপীয় ভাষাতে সাহিত্য রচনায় আগ্রহী না হতেন। পুরোধা ছিলেন ত্রিনিদাদ থেকে ইংল্যান্ডে পড়তে আসা ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাহিত্যিক ভি এস নাইপল। তাঁর ‘এ হাউজ ফর মিঃ বিশ্বাস’ (১৯৬৪) উপন্যাসটি ছিল বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে সেরকমই কীর্তিস্তম্ভ, যে বইটি পশ্চিমের আপামর পাঠককে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত তথা বৃহত্তর পূবের দিকে ঘুরে তাকাতে বাধ্য করেছিল। পরের দু’টি দশকের সবরকম সাংস্কৃতিক ওঠানামাকে মাথায় রেখে গত সহস্রাব্দের একেবারে শেষে এসে দেখা গিয়েছে, আধুনিক সাহিত্যের বিশেষ এই ধারাটি রীতিমতো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ধারাটিকে সুদৃঢ় করেছেন সালমান রুশদি, গাও সিংজিয়াং, রোহিন্টন মিস্ট্রি, অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম শেঠ, অমিত চৌধুরি, কাজুও ইশিগুরো, হারুকি মুরাকামি, মো ইয়ান, ঝুম্পা লাহিড়ি, খালেদ হোসেইনি’র মতো লেখকেরা। সকলেই যে ইংরেজিতে লিখেছেন, এমন নয়। চাইনিজ লেখক গাও সিংজিয়াং-এর মাতৃভাষায় লেখা উপন্যাস ‘আত্মার পাহাড়’ নোবেল-পুরষ্কারে সম্মানিত, সেই বৃহৎ উপন্যাসটি ইংরেজি-অনুবাদের মাধ্যমে পঠিত হয়েছে পশ্চিমের পাশাপাশি পূবের দেশগুলোতেও। আফ্রিকা’র চিনুয়া আচিবে বা ইংল্যান্ড-অভিবাসী জাপানের কাজুও ইশিগুরো ইংরেজিতে লিখেছেন, সেরকমই আমেরিকা-অভিবাসী ভারতীয় লেখক ঝুম্পা লাহিড়ি তাঁর পূর্বসুরী রুশদি ও অমিতাভ ঘোষের মতোই ইংরেজি সাহিত্যকে মণিরত্ন উপহার দিয়ে চলেছেন। আমেরিকা-অভিবাসী আফগান লেখক খালেদ হোসেইনি ইংরেজিতে লিখে চলেছেন সোভিয়েত-যুদ্ধের পর আমেরিকা’তে চলে আসা আফগানিস্তানের মানুষের কথা, যদিও বিশ্বজুড়ে তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ যুদ্ধপীড়িত ও দেশচ্যুত মানুষের জীবনের সরল ও বাহুল্যহীন বর্ণনা। ঝুম্পা লাহিড়ি তাঁর কাহিনিতে দেশচ্যুত মানুষের কথাই লিখছেন, কিন্তু তাঁর আখ্যানে বাংলার সঙ্গে বৃহত্তর ভারত এবং অবশ্যই পশ্চিম ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত হয়ে চলেছে। আবার জাপানের হারুকি মুরাকামি তাঁর পূর্বসুরী মিশিমা ও কাওয়াবাতা’কে অনুসরণ করে মাতৃভাষাতে লিখে চলেছেন একের পর এক উপন্যাস। তাঁর লেখনিতে জাপানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের পুরনো সম্পর্কগুলো নতুন করে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষিত হচ্ছে। এঁদের সকলকে সম্মিলিতভাবে ভাবলে দেখা যাবে, বিশ্বযুদ্ধ-পরেকার পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে এঁদের উপস্থিতির কারণেই পূবের অস্তিত্বটি গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে। যদিও অভিবাসী পূবের সাহিত্যিকেরা আধুনিক পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য ‘জনজাতির সরণ’ বা ডায়াসপোরা’কে এযাবৎ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। নাইপল, রুশদি, অমিতাভ ঘোষ হয়ে ঝুম্পা লাহিড়ি’র মতো সাহিত্যিকেরা অভিবাসী-ভারতীয় তথা স্থানান্তরিত মানুষের আমেরিকা-ইয়োরোপের মাটিতে সাংস্কৃতিকভাবে টিকে থাকার প্রচেষ্টা, সেইসঙ্গে পূবের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়ন করে চলেছেন। উপনিবেশোত্তর পূবকে যেমন নতুন করে চিনতে শিখছে পশ্চিম, সেইসঙ্গে পূব ও তার স্থানান্তরিত প্রজন্মের চোখে পশ্চিমেরও একটি নতুন রূপ অবলোকিত হচ্ছে, যা হয়ত খোদ পশ্চিমের চোখে অদেখা। সাম্প্রতিক, এবং একইসঙ্গে ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে আলোকপাতের কারণে পূব-পশ্চিম উভয় গোলকের পাঠকের জন্যেই এই ধারার সাহিত্যসম্ভার হয়ে উঠছে আধুনিক পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি।
পূবকে নতুন করে পশ্চিমকে দেখানো, কিংবা পূবের চোখে পশ্চিমকে দেখা, এই ধারার সাহিত্যিকদের বৃহত্তর বিশ্বের শরিক হয়েও জাপানের হারুকি মুরাকামি স্বতন্ত্র। তাঁর স্বতন্ত্রতার যে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খোলা চোখে ধরা পড়ে, তার মধ্যে রয়েছে কাহিনিকার হারুকি মুরাকামি’র পূবের চেতনায় গড়ে তোলা নিজস্ব একটি কথনের বিশ্ব, যেখানে তিনি মুহূর্তের জন্যেও পূব বা জাপানের সহজাত আধ্যাত্মিক হৃদয়ের সঙ্গে পশ্চিমের যুক্তিবাদ ও তার সহযোগী চিহ্নধর্মী কথনকে একাকার হতে দেননি। আবার ঘুরিয়ে বললে, তাঁর কথনে পূব এবং পশ্চিমের দু’টি সাংস্কৃতিক অধিক্ষেত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে, বিশ্লেষণাত্মক কোনও আলোচনায় যে দু’টিকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। তাঁর এই আশ্চর্য কথনশিল্প একান্তভাবে আধুনিক, এমন কি অধুনান্তিক আলোচকেরা পর্যন্ত তাঁর কথনকে আজকের দিনের উপযোগী এমনই এক ‘কথন’ বলে আখ্যায়িত করছেন, যা একইসঙ্গে পূব এবং পশ্চিমের মধ্যেকার এক ‘সাংস্কৃতিক সেতু’ হিসেবে দিনের পর দিন দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। সেই কথন-কে এই প্রথম বাংলাভাষায় আস্বাদনের সুযোগ ঘটল। জাপানি-ভাষার অধ্যাপক ও জাপান-বিশেষজ্ঞ অভিজিৎ মুখার্জি’র মূল জাপানি থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদে হারুকি মুরাকামি’র বারোটি ছোটগল্প সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ব্লার্বে মুরাকামি’র যে ‘অনাস্বাদিতপূর্ব ন্যারেটিভ’-এর কথা উল্লেখ রয়েছে, অধ্যাপক মুখার্জি’র অনুবাদের মুনশিয়ানায় সেই ন্যারেটিভের সৌন্দর্য বাংলাভাষায় যেভাবে স্ফুটিত হয়েছে, তা শুধুই নিছক প্রশংসার নয়, রীতিমতো চমৎকারিত্বের দাবি রাখে।
‘...রাস্তার উল্টোদিকের একটা ফ্ল্যাটের বারান্দায় একগুচ্ছ শার্ট কাপড় শুকোতে দেওয়ার ভিনাইলের দড়িটাকে এমনভাবে ঘিরে, জড়িয়ে, জাপটে ধরে আছে পাগলের মতো যেন পরিত্যক্ত, অনাথ কতগুলো শিশু।
সত্যি একটা প্রবল ঝড় উঠছে, আমি ভাবলাম।
খবরের কাগজ খুলে, মানচিত্র জুড়ে আবহাওয়া সম্বন্ধে খবরাখবর খুঁটিয়ে দেখে কোথাও টাইফুনের চিহ্নমাত্র পেলাম না। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ---লেখা রয়েছে জিরো পার্সেন্ট। রোম সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর মতোই শান্ত রোববারের বিকেল একটা, এরকমই হওয়ার কথাও।’ (রোম সাম্রাজ্যের পতন, ১৮৮১-র ইন্ডিয়ান অভ্যুত্থান, হিটলারের পোল্যান্ড আগ্রাসন, এবং প্রবল ঝোড়ো বাতাসের জগৎ)
কোনও রোববারের বিকেলের তুলনা করতে ‘রোম সাম্রাজ্য’ বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোনও ঘটনার কথা উঠে আসতে পারে কী? মুরাকামি’র গল্প-উপন্যাসে ইতিহাস কিংবা দূর অতীতের সরাসরি প্রক্ষেপ দেখা না গেলেও, এই কাহিনিটিতে মুরাকামি তাঁর নিজের অখন্ড চেতনাকে সেই বিশিষ্ট চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাইছেন, যেটিকে এককথায় মানবসভ্যতার একদেহী সত্তা বা স্মৃতি বলা যেতে পারে। ‘জেন’ তথা বৌদ্ধ দর্শনে স্মৃতি ও সত্তার যে সামগ্রিক ক্ষয়হীনতার (T. W. Rhys Davids, 1896, The History and Literature of Buddhism) কথা রয়েছে, স্মৃতির পুনরাবির্ভাব ও পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনার সূত্র রয়েছে, তার আলোকে মুরাকামি’র এই গল্পের শিরোনামে বিশ্বের ইতিহাসের তিনটি বিশিষ্ট ঘটনা ---অর্থাৎ রোম সাম্রাজ্যের পতন (স্যাকসন’দের উত্থান এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর সংস্থাপন), ১৮৮১ সালের ইন্ডিয়ান’দের গণ-অভ্যুত্থান (আমেরিকা’র রাজনৈতিকভাবে দেশের মাটিতে নিষ্কন্টক হওয়া, বৃহত্তর আমেরিকা’র সূচনা), এবং হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা), এই তিনটি ‘বিশেষ’ ঘটনা না ঘটলে আজকের পৃথিবী ঠিক কীরকম হত? কল্পনা করাটাও বোধহয় সম্ভবপর নয়, কারণ কল্পনার বীজেও রয়ে গিয়েছে ওই তিনটি ঘটনা ও তার সংশ্লিষ্ট সুবিশাল সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের প্রভাব সারা পৃথিবীর মতো কমবেশি এসে পড়েছে জাপানেও, এমন কি আজও তার প্রভাব রয়ে গিয়েছে। আজকের জাপানের কোনও যুবকের জীবনে বিশ্বকে ওলটপালট করে দেওয়া ওই তিনটি ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে কী?
মুরাকামি’র বিশ্বটি এরকমই। যার চেতনাতে বড়ো ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে আসছে ছোট ইতিহাসের নানান ঘটনা, আবার বড়ো ইতিহাস সরাসরি কিভাবে ছোট ইতিহাসের নির্মাণে অংশ নিচ্ছে, কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা তার চিন্তার মধ্যে কীভাবে বিশ্বজগতকে ধারণ করে রেখে দিতে পারে, বা তাকেও বিপরীত অভিমুখে দেখতে চাইলে দেখা যাবে যে, প্রতিনিয়ত তার স্মৃতির ভেতর নিত্যনতুন অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ সব সত্তার জন্ম এবং একইসঙ্গে মৃত্যুও ঘটছে। একটি মানুষ আসলে অতি-বৃহৎ একটি মানুষ, যে কিনা একসঙ্গে মানব-ইতিহাসের অনেকটা ধারণ করে রেখেছে তার সত্তার ভেতরে। তার প্রকাশ কখনো সরাসরি সত্তার প্রকাশে, কখনো বা বহিরঙ্গে সাদৃশ্যহীন এক পৃথিবী, জীবনযাপন, কিংবা বিসদৃশতায়। কদর্য, রূপহীন, বা কুরূপ নয়। আকারহীন বা সম্পূর্ণ নিরাকারও নয়। একটি জীবন, বা একটি মানুষ যেন বিসদৃশ। ফ্রানৎস কাফকা উত্তরাধুনিক সাহিত্যকালের যত লেখককে কমবেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাফকা’র চরিত্রদের মতোই অসংখ্য বিসদৃশ চরিত্রের আনাগোনা তাঁর উপন্যাস আর ছোটগল্প জুড়ে। ‘একটি জানলা’ গল্পের সেই প্রোটাগনিস্ট, কোনও এক সংস্থার তরফে যে চিঠি লিখে বিষাদগ্রস্ত বা প্রেমে আঘাতপ্রাপ্ত একলা মহিলাদের কাউনসেলিং করত, বা ‘অঘটন পথচারী’ গল্পের সেই নিঃসঙ্গ পিয়ানো টিউন-করা ভদ্রলোক, কিংবা ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পের সেই নারী, যে অবিকল কাফকা’র এক নারী-চরিত্রের মতোই চিরকালের নীরব। নিঃসঙ্গ মানুষ নয় তারা কেউই, কিন্তু প্রত্যেকে পৃথিবীর সামনে একটু যেন বিসদৃশ। বৌদ্ধ-শাস্ত্রে যে চরম বিসদৃশতার কথা উল্লেখ রয়েছে, অসম-আকার এবং অতিকায়তার কথা উল্লেখ রয়েছে, কোথাও কিছুমাত্র তত্ত্বের প্রস্তাবনা না করে মুরাকামি আমাদেরকে দেখিয়ে চলেছেন এই দৃশ্যমান এবং চোখে সয়ে যাওয়া জগতটার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের ছোট্ট উপাংশ অচেনা এক বিশ্বের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে। একটি ‘লেডার-হাওজেন’ বা ইয়োরোপের মহিলাদের জন্য নির্মিত একরকম লেদারে প্রস্তুত গরম মোজা, যেটি দেহের মাপে মিলে যাওয়া মাত্র এক নারী জীবনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে ফেলে, অথচ এতকাল সেই সাহসটুকু তার কাছাকাছি এসেও কীভাবে যেন অধরা রয়ে যাচ্ছিল। কিংবা অত্যন্ত পছন্দের এক পুরুষকে খুঁজে পেয়ে এক নারী জানতে পারে যে সে আসলে ‘গে’, কিন্তু কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করার মতো জোর খুঁজে পায় না। কিংবা, ‘এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে’ একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘আমি যে সারা জীবন তোমাকেই খুঁজছি। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু তুমিই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।’
সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এই গল্পের কথন আর ‘সময়’ নিয়ে মুরাকামি’র নিজস্ব ভাষ্যে। বুদ্ধের বাণী, যা হিরকসূত্রের (A K G Warder, 1970, Indian Buddhism) অবতারণায় কথিত রয়েছে, ক্ষণিকের প্রাপ্তিতে সৌন্দর্যের চরম বিকাশ, অবলোকন করছেন যিনি, তার তৃপ্তিটি তখনই সম্পূর্ণ হয়, নতুবা এই জীবন ক্রমেই পিপাসা বাড়িয়ে তোলে। সপ্তম শতকের বৌদ্ধ দার্শনিক ও টিকাকার ধর্মকীর্তি উদাহরণ দিয়েছেন, ‘একঝাঁক জোনাকি যত না সুন্দর, তার চাইতেও সুন্দর ঝোড়ো বাতাসের সামনে এলোমেলোভাবে উড়তে থাকা বিচ্ছিন্ন এক জোনাকি। স্রোতস্বিনী ঝর্ণা যত না সুন্দর, তার চাইতেও ঢের বেশি সৌন্দর্য ধারণ করতে পারে সেই ঝর্ণার গতির কারণে পাথরের বুকে ক্ষণিকের জন্য জন্মানো জলের বুদবুদ, যে কিনা রামধণুর সব ক’টি রঙ ধরতে পারে।’ ক্ষণিকের জন্য সৌন্দর্যের চূড়ান্ত প্রকাশ, তার উপলব্ধি, এবং সৌন্দর্যের অবলুপ্তির পরেকার বিষণ্নতা, এটি একটি চক্রাকারে আবর্তিত ‘প্রথা’ যেন। যেখানে ‘সময়’ মোটেও বৃত্তাকার নয়, ‘সময়’ রৈখিক। কিন্তু সৌন্দর্যের জন্ম, সুন্দর বা মুরাকামি’র ভাষ্যে ‘১০০ ভাগ মনের মতো’ সেই সুন্দরকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা, এবং সুন্দরের অন্তরে বিলীন হয়ে যাওয়া, এই প্রথায় ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। সময়ের দেহ বরাবর এগোতে এগোতে কাহিনির সেই ছেলেটি আর মেয়েটি বারবার পরস্পরকে খুঁজে পাচ্ছে, আবার পরক্ষণেই হারিয়ে ফেলছে।
‘এপ্রিল মাসের এক সুন্দর সকালে, দিনটা শুরু করার আগে এককাপ কফির খোঁজে বেরিয়ে, ছেলেটা হাঁটছিল পশ্চিম থেকে পূবে আর মেয়েটা, একটা স্পেশাল-ডেলিভারি চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে, যাচ্ছিল পূব থেকে পশ্চিমে, দুজনেই তোকিওর হারাজুকু অঞ্চলে একটা সরু রাস্তা ধরে। ফুটপাথের ঠিক মাঝখান দিয়ে দুজনে দুজনকে অতিক্রম করে গেল। হারানো স্মৃতির একটা ম্লান রশ্মি, ক্ষুদ্রতম এক লহমার জন্য যেন হৃদয়ে মৃদু ঝলক দিয়ে উঠল ওদের। বুকে দুজনেরই একটা গুরুগুরু শব্দ। ওরা বুঝতে পারলঃ
এই মেয়েটাই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।
এই ছেলেটাই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো ছেলে।’ (এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে)
‘হারানো স্মৃতির একটা ম্লান রশ্মি’ ---যা বিশাল স্মৃতিভান্ডারকে পুনরুদ্ধার করতে পারে, মানবস্মৃতিকে জাগ্রত করে তোলার ক্ষমতা ধরে। মুরাকামি’র স্মৃতির বিশ্বে কোনও বিচ্ছিন্ন একটি ক্ষণ বা ঘটনা, একটি বড়ো ঝড় বা ইতিহাসের বাঁকবদল, রাজনীতি কি অর্থনীতি, শিল্পের সঙ্গে মানুষের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক, সর্বোপরি সময়ের সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তন, সব কিছুই যেন একটিমাত্র বিন্দুতে সমাহিত হয়ে রয়েছে, যা স্ফারিত হলে দৃশ্যমান জগতের চাইতেও কোনও বড়ো জগতকে চোখের সামনে ফুটে ওঠে। বিন্দুবৎ চেতনা ও সময় বরাবর তার স্থিতিকে বৌদ্ধ-দর্শন বলছে ‘অলয়বিজ্ঞান’। পঞ্চম শতকের মহা-পন্ডিত অসঙ্গ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ‘অলয়চেতনা’কে ব্যাখ্যা করেছেন। যেন অনুগত এক শিষ্য শাক্যমুণী বুদ্ধের পদতলে বসে একের পর প্রশ্ন রেখে চলেছেন, আর বুদ্ধ যথাসম্ভব সরল ভাষায় সেগুলোর জবাব দিচ্ছেন। সেই প্রশ্নোত্তর পর্বকে বৌদ্ধশাস্ত্রে বলা হয়, অভিধৰ্ম্মসমুচ্চয়। ‘অলয়চেতনা’ বা ‘অলয়বিজ্ঞান’ সম্বন্ধে পণ্ডিত অসঙ্গ বলছেনঃ
‘চেতনার ধারকটি তখনই থেকে যায়, যখন চেতনাটিতে বস্তুসার থাকে। রেখাপাত আর অসাম্য থাকে। এগুলো মিলিয়ে গেলে পর, আরেকটি অলয়চেতনার জন্ম হয়। কিন্তু সেই পুরনো ধারকটির ওপরেই। কখনো-সখনো, চেতনার অন্যান্য স্তরগুলোর চাইতেও অলয়চেতনা অধিকতর স্থায়িত্ব পেতে পারে। মনে রেখো, অলয়চেতনা ক্ষণস্থায়ী। সমস্তরকম স্থায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও। প্রতি মুহূর্তে আমাদের দেহের কোষগুলো মারা যায়, পরক্ষণেই নতুন কোষ দ্বারা সেই ধারকটি পূর্ণ হয়ে যায় আবার, এর কারণ সেই ধারকটি আর কেউ নয়, সেই ‘তুমি’ই। ‘তুমি’ই বেঁচে থাকো যতদিন না ‘তোমার’ মৃত্যু না ঘটে। ব্যাপারটা সেরকমই, আমাদের চিন্তার পদ্ধতিটি যেমন। যার একটি নিয়ম রয়েছে, অনেকরকম ছবি আর ঘটনাবলির আসা-যাওয়া রয়েছে, রয়েছে একাধিক চেতনার সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ। কিন্তু সব কিছুর পরেও চেতনার ধারকটি অধিকতর গুরুত্ব পায়, কারণ সেটি নশ্বর, সেটি অল্পক্ষণের জন্য পৃথিবীতে এসেছে।’ (Ven. Traleg Kyabgon, Ringpoche, 1983, The Abhidharmasamuccaya)
ভিক্ষু অসঙ্গ তাঁর ‘যোগাচার’-পদ্ধতির মুখবন্ধে বলেছিলেনঃ ‘হিন্দুরা মনে করেন বেঁচে থাকার পথটিই হল ধর্ম, ভালোভাবে বেঁচে থাকা, সৎপথে চলা, স্বামী হিসেবে তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সদাচরণ করা, এগুলোই হচ্ছে ধর্ম, যা কিনা অনেকটাই প্রকৃতিকে মান্যতা রেখেই মেনে চলা হয়। আবার বৌদ্ধরা বলেন, ধর্ম হল আইন, কিংবা বেঁচে থাকার নিয়মাবলি। কিন্তু আমি বলতে চাই, ধর্ম হল মানুষের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, যা মানুষ জীবন থেকেই লাভ করে। যা বাইরের জগত থেকে তোমার ভেতরে প্রবেশ করে ধীরে তোমার জীবনটাকে বদলে দিতে পারে, বা তোমার মনের বিশেষ এক অবস্থাও হতে পারে। আমাদের প্রায়ই দাঁতব্যথা, মাথাব্যথা হয়, এগুলোর কোনোটাই ধর্মের বাইরে গিয়ে নয়। যোগাচারতত্ত্ব বলছে, বিষয়মুখিনতা আর বস্তুমুখিনতা, এই দু’টো হল তোমার আসল চেতনা। আমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করি, বা অন্যেকে অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে সহায়তা করি, এসবই হল চেতনার রূপান্তর। এক চেতনা হতে আরেক চেতনাতে পৌঁছে যাওয়া। এর বাইরে আর কোনও চলাচল নেই।’
‘রেখাপাত আর অসাম্য’ এই দু’টি মাত্রার সর্বত্র উপস্থিতি মুরাকামি’র ছোটগল্প জুড়ে। বলে রাখা ভালো, ‘রেখাপাত’ ঘটানোটি যেমন নিছক বিপ্লব কিংবা প্রতিবাদ নয়, তেমনি ‘অসাম্য’টিকেও আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক আলোকে দেখতে চাওয়াটা নিতান্ত অযৌক্তিক। বিশেষ করে মানুষের জটিল মনোজগতকে ঘিরেই তাঁর ইতিহাস পরিক্রমা, মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, এবং সামাজিক সমস্তরকম সদৃশ্যতা আর সুদৃশ্যতাকে পার করে বিসদৃশটির মধ্যে দিয়ে অলয়চেতনা’র আধার বা ধারকের সন্ধান করা। সেই বিসদৃশতা, যা ‘জেন’ তথা বৌদ্ধ-দর্শনে বিশেষভাবে আলোচিত, সেই বিসদৃশতা কখনো তাঁর কাহিনিতে নিতান্ত প্রতীকি এবং রূপকধর্মী, প্রচলিত পশ্চিমী রূপকধর্মীতার অনুসারী না হয়েও একান্তভাবে পূবেরই কোনও সংবেদনশীল চিহ্নক, বা কোনও প্রাচীন পৌরাণিক চিহ্ন, বা এমনই এক সংস্কার ---যেটি পশ্চিমের মানুষের চেতনাতেও বহুকাল যাবৎ রয়ে গিয়েছে, অথচ কোনো কারণে আজ তার আবেদন হয়ত পূবের তুলনায় ততটা সংবেদনশীল নয়। যেমন ধরা যাক, বিশ্বের যে কোনও সমাজে কি গৃহস্থের দোরে একটি বেড়াল যদি দু’বেলা করে দু’টি খেতে পায়, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে পরিবারটি শ্রীযুক্ত, অশুভ ছায়ামুক্ত, সচ্ছল। হারুকি মুরাকামি’র কাহিনিতে বেড়ালের বারবার উপস্থিতি এবং তাদের আকস্মিক অন্তর্ধান গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠকদের। একটি লক্ষীমন্ত গৃহ ছেড়ে কখন পোষা বেড়ালেরা দূরে চলে যায়?
‘আমার ছোটোবেলায় একবার আমাদের বেড়াল হারিয়ে গেছিল।' দীর্ঘ নীরবতার পর উনি এটুকু যোগান। ‘তবে কিনা, একটা বেড়াল বেপাত্তা হওয়া আর একটা হাতির নিরুদ্দেশ হওয়া, একেবারেই আলাদা ব্যাপার।’ (হাতিটা উধাও)
প্রথমে বেড়ালের মতোই খুব সামান্য কিছু একটার হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেই লক্ষণ নিতান্ত অশুভ। তারপর হয়ত স্বামী আর স্ত্রী’র মধ্যে বিচ্ছেদ নেমে আসা। তারপর আরও বড়ো কিছু। মানুষের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, বহু বছরের পুরনো সংস্কার আর বিশ্বাসের মতো বিরাট কিছুর হারিয়ে যাওয়া। একটি প্রাচীন রাজত্ব, দেশ, এমন কি তার চাইতেও অনেক বড়ো কিছুর। সব বিশালকায়তার প্রতীকি একটি হাতিকে নিয়ে মুরাকামি’র গল্প ‘হাতিটা উধাও’। তোকিয়ো শহরের এক প্রান্তে একটি খাঁচায় বন্দী থাকা বিরাট এক হাতি তার মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে গেল। মুরাকামি এই গল্পের কথনে টানটান সাসপেন্সের ভাব রেখেছেন, যাতে পাঠককূল আর যাই বিশ্বাস করুন না কেন, বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে যাওয়া হাতি ও তার মাহুতের উধাও হয়ে যাওয়াটাকে কোনোমতেই বিশ্বাস করবেন না। সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে যাতে প্রতীকি এবং অলৌকিক বলে মনে হয়, সেই কারণে হয়ত এমন কথনের অবতারণা। কিন্তু সত্যিই একদিন উধাও হল হাতিটি। যার অভ্যন্তরে সাধারণ জীবনের চাইতেও বড়ো জীবন সমাহিত ছিল। সাধারণ চেতনার চাইতে বড়ো কোনও চেতনা, রাজসিক জাপানের সুপ্রাচীন অহং আর সৌন্দর্যচেতনা, কিংবা সমাজ ও ধর্মচেতনা, সব ওই একটি হাতির ভেতর জমেছিল যেন। হাতিটিকে কোনোভাবে বিন্দুবৎ চেতনা বা ‘অলয়চেতনা’র প্রতীক বলে ভাবা যেতে পারে কী? তবে তো পন্ডিত অসঙ্গের কথামতো ধরে নিতে হয়, উপযুক্ত ‘আধার’ বা ‘ধারক’ না পেয়েই হাতিটি এই দৃশ্যমান পৃথিবীর থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সেই চেতনাটুকু না থাকলে মানুষের জীবনে কী এমন শুভ কিংবা অশুভ ব্যাপার-স্যাপার ঘটতে পারে? এত বড়ো একটি ঘটনা ঘটে গেলে মানুষ কি আদৌ অনুভব করতে পারে যে, কিছু একটা ঘটেছে, বা কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছে?
‘হাতি নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে বহুবার আমার এরকম হয়েছে। কিছু একটা করতে চাই বলে মনে হয় কিন্তু তারপরেই আর বুঝে উঠতে পারি না ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে ফলের পার্থক্যটা কী। চারপাশের সব কিছুর সঠিক ভারসাম্যটা যেন আর নেই বলে প্রায়ই একটা অনুভূতি হয়, যদিও হয়তো আমার বোধবুদ্ধিই আমাকে এরকম একটা বিপদের মধ্যে ফেলে। হাতির ঘটনাটায় আমার নিজের মধ্যেই কোনো একটা ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে যার কারণে বাইরের ঘটনাগুলোও আমার চোখে আশ্চর্য ঠেকে। আমার মধ্যেই কোনো ব্যাপার এটা।’ (হাতিটা উধাও)
অর্থাৎ, একজন তার জীবনের সবরকম বিষয়মুখিনতা আর বস্তুমুখিনতা হারিয়েছে। পন্ডিত অসঙ্গের মতে, সেই ব্যক্তি এখন ধর্মহীন৷ ‘ধর্মহীন’ শব্দটির বৈদিক ও বৌদ্ধ অর্থে, বা ব্যুৎপত্তিগতভাবে ভাবলেও, সেই ব্যক্তি এমনই এক সত্তা যার কোনও ‘আধার’ বা ‘ধারক’ নেই। এই ‘মুক্ত’ সত্তাটির জন্য কোনও চেতনার রূপান্তর বা চেতনা হতে চেতনায় পৌঁছে যাওয়া, বা ‘চেতনান্তর’ ঘটবে না। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী আর তার অন্তর্জগতের মধ্যে কোনোরকম সাম্যতা লক্ষিত নাও হতে পারে। তাই তার দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে, কার্য-কারণের সাধারণ হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে। সে যেন আজকের পৃথিবীর বহুল পরিচিত সেই মানুষ, যার সব থাকা সত্ত্বেও সে অন্তর থেকে অসুখী এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কেউ একজন। এমন মানুষের পরিচয় ইতিপূর্বে পশ্চিমের সাহিত্যে আমরা হয়ত অনেকবারই পেয়েছি। কিন্তু এই নিরিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত। মুরাকামি’র নিরিক্ষা একান্তভাবেই পূবদেশীয়, যা পশ্চিমের অধিকাংশ আলোচকদের চোখে ‘এ সাটল টাচ অফ জেন! ইস্টার্ন ম্যানিফেসটেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গ্লোবালাইজেশন!’ ভিন্ন আর কিছু নয়।
মুরাকামি’র কথনে মানুষের চেতনার সব ক’টি স্তরে পর্যায়ক্রমে আলোকসম্পাত ঘটে। সুদীর্ঘ এই মানবসভ্যতা, তার স্মৃতির ‘ধারক’ এই মানবসমাজ ছাড়া আর কেউ নয়। সেই মানুষের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল এক শিল্পী তার উপাখ্যানের মধ্যে দিয়ে তাকে ক্রমাগত পরিচর্যা করে চলেছেন। মানুষেরই বিস্মরণে চলে যাওয়া স্মৃতির পুনরুদ্ধারে নিমগ্ন রয়েছেন। মানুষকে মনে করাতে চাইছেন, সাম্যের থেকে সরে আসাটুকুই সব নয়, সাম্যে ফিরে আসাটাও অত্যন্ত কঠিন ক্রিয়া, যা যোগকলার পর্যায়ে পড়ে। বাইরের পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত বিভ্রমে ভুগতে থাকা আজকের আধুনিক মানুষের কী করা উচিত? আধুনিক বিশ্বের এই দার্শনিক তাঁর জাপান তথা সমগ্র বিশ্বকে একটি মেলবন্ধনে দেখাতে চাইছেন। তাঁর পূর্বসুরী, জাপানি-সাহিত্যের দুই মহীরুহ য়ুকিও মিশিমা ও ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা’র মতো তিনিও ‘অলয়বিজ্ঞান’ বা ‘অলয়চেতনা’র দ্বারা মানবসভ্যতার সৃষ্টি আর স্থিতিকে ব্যাখ্যায়িত করতে চাইছেন। ফলশ্রুতি হিসেবে এটুকু প্রত্যাশিত, তাঁরই ভাষ্য অনুসারে ‘বস্তুত বাস্তববুদ্ধি উদ্ভূত’ ও ‘বাস্তববুদ্ধি উদ্ভূত বস্তু’ এই দু’য়ের মধ্যেও একদিন ক্ষীণ সাম্যতা দেখা দিতে পারে। বৌদ্ধ দর্শনের বিশেষ এক মতবাদ, যা গভীরভাবে জেন-দর্শনের গোড়ার কথাগুলোকে মনে করায়, সেই মত অনুসারে জগত জুড়ে ঘটবে আশ্চর্য ‘চেতনার রূপান্তর’ (A K G Warder, 1970, Indian Buddhism)। তখন ‘প্রবেশ’ হয়ে উঠবে ‘ক্ষেত্র’। ‘মূল’ আর ‘ধাতু’ একাকার হয়ে যাবে। ‘প্রকৃতি’ পরিণত হবে বিশেষ ‘ভাব’-এ। ‘অস্তিত্ব’কে তখন ‘ভূত’ বলা চলবে। ‘প্রশান্তি’ কথাটা ‘নিরাপত্তা’র মতো জোরালো শুনতে লাগবে। ‘আবেগ’ তখন বিশেষ এক ‘জোর’। ‘অনুভূতি’ পরিণত হবে ‘অভিজ্ঞতা’য়। ‘অন্তর্দৃষ্টি’কে নির্দ্বিধায় বলা যাবে ‘নিশ্চয়তা’। ‘চেতনা’র সম্পূর্ণটাকে বলা চলবে ‘সচেতনতা’। ‘বিসমতা’ হয়ে উঠবে ‘আকারযুক্ত’ বা ‘সদৃশতাযুক্ত’।
মুরাকামি’র উপাখ্যানে বাস্তব জগতে যে ‘বিসদৃশতা’ লক্ষ্য করা যায়, পশ্চিমের আলোচকেরা সেটিকে কাফকা’র কাহিনিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো বিচিত্র সব মানব-চরিত্র বা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ততোধিক বিচিত্র ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করলেও, এই বিসদৃশতা-কে একান্তভাবে পশ্চিমের উত্তরাধিকার-ভাবনা বলা চলে না। যদিও হারুকি মুরাকামি’র কথনশৈলি কি চরিত্র-বুননে কাফকা’র প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে। কিন্তু কাফকা’র ‘আমেরিকাঃ দ্য বয় ওয়াজ ডিজ্যাপিয়ার্ড’ উপন্যাসের সেই কুদর্শন নারী মুরাকামি’র কাহিনিতে জন্ম নেন না কখনোই। তাঁর কাহিনির নারীরা তাদের ‘অন্তর্গত বিসদৃশতা’-র মতোই জটিল অস্তিত্বসম্পন্না। এই প্রসঙ্গে বরং কাওয়াবাতা’র সেই নারীকে মনে করা যেতে পারে, যে সর্বাঙ্গসুন্দর নারীর স্তনে দীর্ঘ একটি কালো চুল জন্মেছিল, যেটি তাকে সার্বিকভাবে পৃথিবীর চোখে সাদৃশ্যহীনতায় আনত করতে চেয়েছিল। মুরাকামি তাঁর কাহিনিতেও এহেন জটিল বিসদৃশতার অবতারণা ঘটিয়ে থাকেন। ‘ছোট্ট একটা সবুজ রাক্ষস’ কাহিনিতেও দেখা যায় কুদর্শন এবং জটিল দেহরূপের অধিকারি অজানা একটি জীব আচমকাই এক নারীর মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। যে নারী অত্যন্ত সুন্দরী, কিন্তু তার অন্তরে সেই রাক্ষসটিকে দেখা মাত্র যতরকমের বিচিত্র অথচ ‘বিসদৃশ’ ভাবের উদ্ভব ঘটছে, সেগুলো কিভাবে যেন রাক্ষসটির দেহের মধ্যে ধীরে ধীরে বিকারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই নারীর অচেনা প্রাণীটিকে দেখে প্রথমে ঘৃণা ও সঙ্কোচবোধ, ভয়, তারপর রাগ, একসময়ে প্রাণীটির সঙ্গে সংলাপের শুরু, তারপর প্রাণীটিকে শুধুমাত্র মানসিক হিংসার দ্বারা তিলেতিলে হত্যা করা, হিংস্রতা আর বিভ্রান্ত চেতনার পারস্পরিক ধাপগুলোতে যে চরম ‘বিসদৃশতা’র নির্মাণ ঘটান মুরাকামি, সেই জগতে তাঁর স্নেহাস্পদ মানবসমাজের সমস্তরকম মূল্যবোধ, সংস্কার, এবং ধার্মিক হৃদয়টির আরও একবার যাচাই হয়ে যায়। কাহিনিটির মাধ্যমে যে কৃষ্ণ-প্রহসনের অবতারনা ঘটালেন মুরাকামি, সেটি কাফকা’র সঙ্গে তুলনীয়। এক ইংরেজ সাহিত্য-আলোচক মুরাকামি সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘উনি কলম না ধরলে আমরা জানতেও পারতাম না কাফকার প্রহসনগুলো আজও কত অন্ধকারে রয়ে গিয়েছে আমাদের চোখে।’
সাহিত্যের ইতিহাস মাথায় রেখে বিচার করতে বসলে, মুরাকামি’কে নিশ্চিত করে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানা বা গোলার্ধের লেখক বলে আখ্যায়িত করে ফেলাটা অন্যায়। তাঁর লেখনিতে যেমন রয়েছেন জাপানের মিশিমা-কাওয়াবাতা, তেমনি রয়েছেন দস্তয়ফস্কি, ফিটজারেল্ড, চেকোফ, ডিকেন্স, এবং কাফকা। ধ্রুপদী জাপানি সঙ্গীতের পাশাপাশি তাঁর সহচর ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত এবং জ্যাজ। তাঁর প্রায় সব কাহিনিতেই কমবেশি জ্যাজের ব্যবহার জ্যাজ-সঙ্গীতের সমধর্মী ‘নীরব-প্রায়’ স্নিগ্ধ জগতের নির্মাণ ঘটায়। যার সার্থকতা একমাত্র সম্ভব মুরাকামি’র অতি আশ্চর্যকর এক ন্যারেটিভের কারণে, অন্যথায় সাহিত্যের পাতায় উঠে আসা জ্যাজের স্নিগ্ধতর বিভাব অচিরে উচ্চকিত লাউঞ্জ-সঙ্গীতে পরিণত হতে পারত। চার-পাঁচের দশকের বিশ্বখ্যাত জ্যাজ টেনর-বাদক চার্লি পার্কারের একটি কম্পোজিশনের নামে একটি গল্পও রয়েছে তাঁর। কম্পোজিশন’টির নামে মূল গল্পটিরও তাই ইংরেজি নাম, এ স্লো বোট টু চায়না। যা একটি পুরনো মার্কিন-প্রবচন, যার ভাবগত অর্থ আমাদের বাংলায় প্রচলিত ‘আঠেরো মাসে বছর’ প্রবচনকে মনে করায়। এমনই এক কাহিনি, যার ভেতর থেকে উঠে আসছে জাপানের সাংস্কৃতিক হৃদয়টির সাথেসাথে ধ্রুপদী জাপানের ধার্মিক ও অহংযুক্ত সত্তার কোনও এক প্রলম্বিত অংশ। জানান দিচ্ছে, জাপানের ধ্রুপদী সংস্কৃতির পুরোধা কিন্তু চায়না, অপরপক্ষে আধুনিক জাপানে বিরাজ করছে আমেরিকা। আজকের হ্যামবার্গার স্টেক, বেসবল, রাগবি’তে মেতে থাকা তরুণ জাপানি প্রজন্ম কী জানে, চায়না’র সঙ্গে আসলে কতকালের পুরনো সম্পর্ক জাপানের?
তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে যদি কোনও নান্দনিক কি বৌদ্ধিক সম্পৃক্ততা এসে গিয়ে থাকে, তার দায় শুধুই কিন্তু পশ্চিমের। পূব, অর্থাৎ ভারত বা জাপানের নয় কোনোভাবেই। পূবের সাহিত্যিকদের জন্য পূবকে যথার্থ ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে লিখে ফেলা ছাড়াও পশ্চিম ও তার সভ্যতার সার্বিক মূল্যায়ন এখনও অনেকটাই বাকি রয়ে গিয়েছে। মুরাকামি’ও তাঁর ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পে নিজের দেশ জাপান’কে লিখতে বসে আমেরিকা, এবং আমেরিকা’র এক বিপরীত-সংস্কৃতি হিসেবে চায়না’কে নতুন করে মেলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। এক নিঃসঙ্গ চাইনিজ ভদ্রলোক, যিনি টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তোকিয়ো শহরে বসবাসকারি চাইনিজ’দের ফোন নম্বর বের করেন, এবং তাদের বাড়ি গিয়ে ‘চাইনিজ এনসাইক্লোপেডিয়া’ বিক্রি করেন। এটিই তার পেশা। তার সঙ্গে একসময়ে যখন কাহিনির প্রোটাগনিস্টের দেখা হয়, তার মনে পড়ে যায়, ভদ্রলোক আসলে ছিলেন তার উচ্চতর ক্লাশের সহপাঠী। আজ তিনি শহরের চাইনিজ’দের বাড়িতে ঘুরে এনসাইক্লোপেডিয়া বিক্রি করেন। মুরাকামি একথাটি একবারও লেখেননি কোথাও, কিন্তু পাঠক নিজের থেকে উপলব্ধি করবেন, স্বদেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রাণ যে ‘চাইনিজ’ ছেলেটি এককালে তার সহপাঠী ছিল, সে আজও একইরকম ‘চাইনিজ’ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাহিনির প্রোটাগনিস্ট অর্থাৎ জাপানি ছেলেটি কীভাবে যেন নিঃশব্দে ‘আমেরিকান’ হয়ে গিয়েছে। এক অভূতপূর্ব প্যাসিভ ন্যারেটিভ হচ্ছে সুদীর্ঘ এই উপাখ্যানের প্রাণস্পন্দন, যা অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জি’র অনবদ্য অনুবাদে বাংলাভাষাতে চরম উপভোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছেঃ
‘তোকিওর দিকে চেয়ে থাকি আর চায়নার কথা ভাবি। এভাবেই আমি চায়নার আমার অংশটুকু পেয়েছি। ডজন ডজন বই পড়েছি চায়নার ওপর, অ্যানালস্ থেকে শুরু করে রেড স্টার ওভার চায়না অবধি। দেশটা সম্বন্ধে যতটা জানা সম্ভব চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা নেহাতই আমার চায়না। বইতে যে চিনের কথা পড়া যায় সেটা নয়, এই চায়না থেকে কখনো বার্তা আসে শুধু আমার কাছে। গ্লোবের ওপর হলুদ রঙের ধ্যাবড়া ছোপটুকু নয়, এ অন্য চায়না। অন্য এক কল্পনা। এক অর্থে এটা আমার সত্তারই একটা অংশ ‘চায়না’ নাম দিয়ে যেটাকে পৃথক করা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে আমার থেকে। …
...তোকিও ---একদিন এই ইয়ামানোতে লুপ লাইনে যেতে হঠাৎ করেই এই শহর উধাও হতে শুরু করবে। এক ঝটকায় বাড়িগুলো ধসে পড়বে। আমার হাতে ধরা টিকিট, সব দেখছি তখন। তোকিও-র রাস্তাঘাট জুড়ে সর্বত্র ছেয়ে যাবে আমার ‘চায়না’তে, ছাইয়ের মতো, যেন সবকিছুর সাথে মিশে যাচ্ছে ছোঁয়া লাগলেই। ধীরে, একটু করে যতক্ষণ না সব মিলিয়ে যায়। না, এরকম জায়গা কিছুতেই আমার জন্য নয়, এভাবেই আমাদের মুখের কথা হাতছাড়া হয়ে যাবে, স্বপ্ন পরিণত হবে কুজ্ঝটিকায়। ঠিক যেভাবে আমাদের বয়ঃসন্ধিকাল, যা একসময়ে মনে হয়েছিল এতটাই দীর্ঘ যে কোনোদিনই হয়ত কাটবে না, একসময়ে উবে গিয়েছিল।’ (চীনে যাওয়ার স্লো বোট)
গ্রন্থ: এক ডজন মুরাকামি
মূল লেখক: হারুকি মুরাকামি
জাপানি থেকে অনুবাদ: অভিজিৎ মুখার্জি
প্রকাশক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা