Published : 11 May 2024, 10:16 PM
বাঙালির নানান কিছুতে অরুচি থাকলেও, ভালো খাবারে বাঙালির অরুচি নৈব নৈব চ। ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ বাঙালির কাছে খাবার কেবল জৈবিক উদরপূর্তির চাহিদা নয়, আটপৌরে জীবনের চিরচলমান নিত্যকার উদযাপন। দিনমান ভালো ভালো খাবারের কল্পনা করে ‘সজিভ’ বোধ করে সজীব থাকে যে বাঙালি, সেই আমরা জন্মের আনন্দসংবাদে খাই, মৃত্যুর বিষাদ ভুলতে খাই, বিয়েবাড়িতে আমরা নবদম্পতিকে শুভাশিস জানাতে নয় বরং ‘খেতেই’ যাই। ‘ভজন’-এর চেয়ে ‘ভোজন’-এই বেশি আগ্রহ বাঙালির, তাই আমরা হাসপাতালে রোগী দেখতে খাবার নিয়ে যাই; আমরা পরীক্ষার্থীকে আগাম শুভকামনা জানাতে খাবার নিয়ে যাই; পরিবারের নতুন সদস্য বা পাড়ায় নতুন প্রতিবেশীকে স্বাগত জানাই খাবার দিয়ে। আর এখানে বাঙালির অনন্য অসাধারণত্ব। আর এই বাঙালির উৎসব, আকিকা থেকে বিয়ে বাড়ির আনন্দ কিংবা কুলখানি বা চেহলাম সবখানেই সুগন্ধি ঝরঝরে চাল, নরম তুলুতুলে মাংস আর সুবাসিত মসলার মিশেলে যেই নবাবি খাবারের অবিসংবাদিত প্রাধান্য, তার নাম বিরিয়ানি। বাঙালি রসিক জিহবার রসদের যোগান দিতে যুগে যুগে নানান প্রজন্মে প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের হেঁসেল থেকে নানান বাহারি খানাদানা নিজেদের রসুইঘরে নিয়ে এসেছে। এতোসব কিছুর মাঝে বাঙালির অন্যতম বড় আপনজন হয়ে উঠেছে বিরিয়ানি কালক্রমে।
এই যে বাঙালির অতিপ্রিয় বিরিয়ানি যে কিনা সুখ থেকে শোক, যাপন থেকে উদযাপন, দিন কিংবা রাত সবখানে মানানসই, সব সময় চলে, তার সাথে আমি ভৈরবী রাগের খুব মিল খুঁজে পাই। অবাক হচ্ছেন এই ভেবে কোথায় সুস্বাদু সুবাসিত বিরিয়ানি আর কোথায় ভৈরবী রাগ!! শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগের মতো অমন কাঠখোট্টা ব্যাপারের সাথে ঝরঝরে চালের সাথে তুলতুলে মাংসের, ভুরভুরে গন্ধের কেওড়া জাফরানের মন চাঙানো, প্রাণ রাঙানো বিরিয়ানির কী করে তুলনা চলতে পারে? পারে বৈকি! ভৈরবীর সুরে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে আনন্দালোকিত আশার স্বরূপ, অন্যদিকে তার আরেক রূপে প্রকাশিত হয় বেদনা বিধুর বিষণ্নতার ছবি। ঠিক যেন বিরিয়ানির মতো – আনন্দ উদযাপনেও এর সাথে মিতালি চলে আবার শোক যাপনেও এর সঙ্গ মেলে। এর সুরে আর স্বরসঙ্গতিতে ভক্তিও আছে, শৃঙ্গারও আছে। আছে নাতিচঞ্চল শান্ত গম্ভীর রূপ কিন্তু আমাকে আরও বেশি করে এই রাগের মাঝে বিরিয়ানির সমাপতন দেখে। বিরিয়ানির মতো এক গুরুপাক খাবার ঠিক ভৈরবীর মতোই গম্ভীর, ওজনদার – আর যাই হোক এদের সাথে চঞ্চলতা চলেনা, বরং জমিয়ে খেতে হয় বা গাইতে হয়। আর দেখুন রাগ মানেই তো আর কঠিন কঠোর কোন বিষয় নয়। “রঞ্জয়দি ইতি রাগ”- স্বরের বিন্যাসে গাঁথা সুরের লহরী মনকে রঞ্জিত করে বলেই এর নাম ‘রাগ’- যা এসেছে রঞ্জক শব্দ থেকে। ভৈরবী রাগে বাঁধা নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’, কিংবা রবিঠাকুরের ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’ শুনলে অজান্তেই যেমন মনে দোলা লাগে, প্রাণ উতলা হয়; ঠিক তেমনি সুবাসিত বিরিয়ানির ঘ্রাণে ‘সজিভ’ হৃদয় উতলা হয়না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভারি দুষ্কর। বিরিয়ানির সুবাসিত ঝরঝরে চাল যেন ঠিক ভৈরবীর স্বরসঙ্গতির গভীর স্বচ্ছতা আর ব্যাপ্তির কথা মনে করায়। এই রাগের ঝরঝরে সুর আর স্বরের বিন্যাসে এর কোমল ঋষভ , কোমল গান্ধার, কোমল ধৈবত আর কোমল নিখাদ ঠিক যেন মুখে দিলেই গলে যাবার মতো তুলতুলে নরম বিরিয়ানির মাংস। ঋষভ আর ধৈবতের মধ্যেকার স্বরসঙ্গতির আন্দোলন, অবরোহে ঋষভ আর পঞ্চমে খানিক দীর্ঘ অবস্থান এই সবই যেন নানান সুগন্ধি দামী মসলার কাজ করে ভৈরবীকে মনকাড়া করে তোলে- ঠিক যেন বিরিয়ানির গরম মসলা, জায়ফল, জয়িত্রী ইত্যকার নানান মসলার মতো। আর এই রাগের বাদী স্বর মধ্যম যেন এতে ঠিক জাফরান আর কেওড়ার সুবাস আনে। এর চলন বিরিয়ানিতে ব্যবহৃত মোলায়েম শুদ্ধ সুগন্ধি ঘিয়ের মতো – এতে সরলতা যেমন আছে, বক্রতাও আছে আর এই সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য বুঝে নিতে হয়, তা মিশে থাকে, ভেসে থাকেনা।
ভৈরবী এক অফুরান সম্ভাবনার রাগ। এর সুর আর স্বরের সঙ্গতিতে অতি আহ্লাদে কপট ভর্ৎসনা করে যেমন প্রেমিক প্রবর ‘নাইয়া’ কে বলা যায় ‘যৌবন-নদী টলমল নারি রোধিতে/ ঐ ব্যাকুল বাতাস হরি’ নিল লাজ বাস/ তায় চঞ্চল-চিত যে তুমি চাহ বধিতে/ পায়ে ধরি ছাড়, বঁধু আমি পরের ঘরের ঘরণী’ ; আবার ঠিক তেমনি অপেক্ষমাণ বিরহকাতর প্রিয়া গাইতে পারে ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/ পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরি টিপ/ জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ/ মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই’। ভৈরবীতে মানব প্রেম আর ঈশ্বর প্রেম মিলে মিশে যায়, বাঙালির বিরিয়ানিও ঠিক যেমন তার ভোজন আর ভজনের দোসর। ভৈরবীর সব কোমল স্বরে আর সুরে এক নরম মোলায়েম আবেশ ঘিরে থাকে, ঠিক যেমন করে অতি যত্নে দমে রান্না করা বিরিয়ানীর তুলতুলে মাংস মুখের মধ্যে মিলিয়ে যায় কিন্তু তার ভালোলাগার রেশটুকু থেকেই যায়। সুরের রাণী ভৈরবীর চলনের ‘খাটকা’, ‘ঝাটকা’ আর ‘মুড়কি’ যেমন করে শ্রোতার কানে সুধা বর্ষণ করে, তেমনি বিরিয়ানির নানান সুবাসিত মসলায় জারিত ঝরঝরে চাল, তুলতুলে মাংস আর জাফরানি রাঙা আলু ভোজনরসিক সজিভ বাঙালির রসনা বিলাসের পরম আর চরম আশ্রয়। একটিতে উদরপূর্তির আনন্দে মন রঞ্জিত হয়, অন্যটিতে শ্রবণস্ফূর্তির উল্লাসে হৃদয় পূর্ণ হয়। সেই আদিকাল থেকেই গানের জলসার অন্তে ভৈরবী গাওয়া হয়। সঙ্গীতগুরুরা বলেন, একবার ভৈরবীর হাত ধরে কোমল ঋষভ, কোমল গান্ধার, কোমল ধৈবত, কোমল নিখাদ জলসায়প্রবেশ করলে তাদের সুরের মূর্ছনাকে ম্লান করবার সাধ্য কারও নাই। প্রয়োজনে শুদ্ধ, কড়ি, কোমল বারোটি সুরকে নিয়ে ভৈরবী কর্ণকুহরে যে সুর তরঙ্গ তোলে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই শ্রোতার প্রাণে ‘আমি যে আর সইতে পারিনা’ অবস্থা হয়। আর বিরিয়ানি একবার পাতে পড়লে, এমনকী বিরিয়ানির সুঘ্রাণ একবার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করলে মন আইঢাই করবেই। ভৈরবীর সুরেই তাই আত্মমগ্ন হয়েই গাওয়া চলে ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’, এই যেমন চরম পেটরোগা বাঙালিও অম্বলের ওষুধ খেয়ে, হজমি গুলি খেয়ে হলেও বিরিয়ানি সুখে বঞ্চিত হবেনা – ‘বিরিয়ানি তুঁহু মম সুখ সমান’!
এই বিরিয়ানির উৎস কোথায়, কীভাবে এই নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত, আছে নানান মতবিরোধ। তবে এই লোকপ্রিয় খাবারটির উল্লেখ পাওয়া যায় নানান কালে, নানান প্রেক্ষিতে। এমনকী মহাভারতেও ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে 'পলান্ন' খাবার কথা বলছেন এমন প্রমাণ মেলে আবার দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরাও এই ‘পলান্ন’ খেতেন বলে জানা যায়। এই ‘পলান্ন’ আসলে কি? সংস্কৃত ভাষায় ‘পল’ শব্দের অর্থ মাংস এবং ‘অন্ন’ শব্দের অর্থ ভাত। তাহলে ‘পলান্ন’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় মাংস মিশ্রিত ভাত। ইতিহাসবেত্তারা অনেকেই বলেন মহাভারতে উদ্ধৃত সেই পলান্নই হয়তো আজকের বিরিয়ানি। আবার দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের তামিল সঙ্গম সাহিত্যে 'অন্ন সুরু' নামে ভাতের সঙ্গে মাংস রান্নার উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু 'অন্ন সুরু' রান্নায় বিশেষ কোনো মশলার প্রচলন না থাকায়, বিরিয়ানির এই পূর্বসূরি কেবল রান্নার সুবিধার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলের খাবার হিসেবেই রয়ে গেল, এর বাইরে আর খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি বলেই জানা যায়। এর পর আবার ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন দুর্ধর্ষ পরাক্রমশালী মঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং সুবিশাল বাহিনি নিয়ে হিন্দকুশ পর্বত অতিক্রম করে দিল্লি আক্রমণ করতে এলেন, সেই ইতিহাস ঘাঁটলে বিরিয়ানিসদৃশ খাবারের উল্লেখ মেলে। বলা হয় তৈমুরের বিশাল বাহিনিতে অজস্র সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়া তো ছিলোই, আর সঙ্গে না কি ছিলো মাটির তৈরি বিশাল বিশাল সব রান্নার পাত্র। যেখানে তৈমুরের সেনাদল ঘাঁটি গাড়তো, সেখানেই না কি মাটি কেটে তৈরি হতো বড় বড় সব উনুন আরে সেই উনুনে বিশাল সব মাটির পাত্রে একসঙ্গে চাল আর মাংস নুন মাখিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হতো। যখন দিনের বেলার সৈন্যরা যেতো সমরাঙ্গনে, তখন সারা দিন ধরে হালকা আঁচে সেদ্ধ হতে থাকতো মাটির পাত্রে চাল আর মাংসের সেই মিশ্রণ যেন রাতে ফিরে ক্ষুধার্ত সৈন্যরা সেই খাবার খেতে পারে। ইতিহাসবেত্তারা মনে করেন দমে রান্না করার ধারণা কার্যত এভাবে, এখান থেকেই সূত্রপাত। দমে বিরিয়ানিসদৃশ এই রান্নার ব্যাপারটার একটা ভীষণ যৌক্তিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাও আছে। এতো বিশাল সৈন্য বাহিনির খাবারের যোগান, এর রান্না তখন দিনেরটা দিনেই করতে হতো, কারণ তখন তো আর খাবার সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা ছিলোনা, আর যুদ্ধক্ষেত্রে তো নয়ই। আর শিকার করে মাংসের যোগান মিলতো, ভাঁড়ারে ছিলো চাল। আর বলদায়ক এই খাবারের পরিমাণে কখনোই টান পড়তো না। কেননা প্রতিদিনই যে পরিমাণ সৈন্য-সামন্ত যুদ্ধাঙ্গনে যেতো, ফিরতো সংখ্যাতে তার চেয়ে কম। ফলত, বেঁচেবর্তে যারা ফিরতো, তাদের পাতে বেশি বৈ কম পড়তোনা কখনোই।
তবে অনেকের মতে আজকের যে বিরিয়ানি, যা কেবল চাল আর মাংসের মিশ্রণ নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, সেই বিরিয়ানির জন্য মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রাণপ্রিয় বেগম মমতাজ মহলকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। প্রেমের অমর প্রতীক তাজমহলের সাথে জড়িয়ে সচরাচর আমরা মমতাজকে চিনতে শিখি, মনে রাখি; কিন্তু ভোজনরসিক হিসেবে আমাদের রসনাবিলাসের পরম প্রতীক মুগলাই বিরিয়ানির আদি প্রবর্তক হিসেবে মমতাজ মহলকে তার চেয়েও বেশি করে মনে রাখতে হবে। ইতিহাস বলছে সময়টা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ আর মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লীর মসনদে তখন রাজত্ব করছেন সম্রাট শাহজাহান। সেই সময় বেগম মমতাজ মহল মুঘল সেনাদের ছাউনি দেখতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন যে সেখানে সৈন্যদের অবস্থা নিতান্তই করুণ, এদের স্বাস্থ্য দুর্বল আর ভগ্ন। তাই সম্রাজ্ঞী সঙ্গে সঙ্গে মুঘল সেনা ছাউনির খানসামাদের ডেকে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন যা সৈনিকদের ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে দিতে পারবে। মুঘল রাঁধুনিরা মশলা ব্যবহারের জাদুকর ছিলেন। আর সেই সময় পারস্যসহ মধ্যপ্রাচ্য আর চিনসহ অন্যান্য জায়গা থেকে প্রচুর মশলা ভারতে আসছে। এইসব অনুকূল পরিস্থিতিতে বেগমের নির্দেশ অনুযায়ী চাল, মাংস আর বিভিন্ন রকমের মশলার সহযোগে তৈরি হলো এক অতি সুস্বাদু, উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাদ্য। সেনা ছাউনিতে অতি সাধারণ সৈন্যদের জন্য তৈরি এই খাবার মুঘল শাহী হেঁসেলে ঢুকে আরও মূল্যবান, অত্যুত্তম, দুষ্প্রাপ্য সব মসলা আর উপকরণের সহযোগে অভিজাত এক খাবার হয়ে উঠলো। আর মুঘল শাসকের খানসামাদের হাত ধরে এই অতিসুস্বাদু এই সুখাদ্য ছড়িয়ে পড়লো ভারতবর্ষের নানান প্রান্তে। সাধারণের জন্য সর্বজনীন ভাবে রান্নার জন্য উদ্ভাবিত এই সুখাদ্যটির অভিজাত হেঁসেলে পদার্পণ ঘটেছে বরং পরে। বিরিয়ানি তাই আভিজাত্য না হারিয়ে, আভিজাত্য অর্জন করেছে। আর বোধ করি বিরিয়ানির মতো করে আর কোন খাবারই স্থানীয় সংবেদনশীলতা এবং ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে না। আর একারণেই বিরিয়ানি জনপ্রিয়তার ইন্দ্রজাল ছড়াতে পেরেছে বিশ্বময় আর এখানেই সে অতি সাধারণের অসাধারণ এক পরম রসনাবিলাস।
বিরিয়ানির মতো ভৈরবীরও রয়েছে এক গভীর সংবেদনশীলতা। একই সঙ্গে এ এক বিপুল সম্ভাবনার রাগ। এর রয়েছে আত্তীকরণ আর অভিযোজনের এক অসীম ক্ষমতা। হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের ভৈরবী রাগের রূপ তাই দাক্ষিণাত্য পেরিয়ে কর্ণাটকী মার্গ সঙ্গীতে পৌঁছুলে এর নাম, রস, চলন বদলে যায় বৈকি। ঠিক যেমন দিল্লির মুঘল হেঁসেল পেরিয়ে বিরিয়ানি হায়দরাবাদের নিজামের হেঁসেলে পৌঁছে স্থানীয় মশলা আর রন্ধন প্রণালীর সংযোগে একেবারে অনন্যমাত্রিক হয়ে উঠলো। সেখান থেকে অন্ধ্রতে পৌঁছে যোগ হলো আরও মসলা, কারিপাতা আর বিরিয়ানি নিলো অন্ধ্রের নিজস্ব রূপ। এমনকি দিল্লির বিরিয়ানি রান্নার পদ্ধতিতে মসলা চোখেও দৃশ্যমান আবার মুখেও পড়ে। সেই বিরিয়ানি কিন্তু লখনৌ পৌঁছুলো আবার সেই দিনমজুর সাধারণ মানুষের তুষ্টির সাথে পুষ্টির যোগান দিতে। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বড়া ইমামবড়া তৈরিতে প্রায় হাজার কুড়ি নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর ভরপেট খাবার তো চাই! তাই এরকম একটি খাবারের পরিকল্পনা করা হল, যেখানে চাল মাংস ইত্যাদি সব একসঙ্গে দমে রান্না হবে। ততোদিনে ভারতীয় পাচকরা রান্নায় খুশবুদার নানান স্থানীয় মসলা আর উপকরণ ব্যবহারে পক্ক হয়ে উঠেছেন। সর্বজনীন এই ঢালাও সাধারণ রান্নার সুঘ্রাণ মন কেড়ে নিলো আওয়াধের নবাব আসফ-উদ-দৌলার। নবাবের তত্ত্বতালাসের সঙ্গেসঙ্গেই বিরিয়ানি ঢুকে গেল আওয়াধের নবাবী হেঁসেলে। দুর্দান্ত ভোজনরসিক আর আরামপ্রিয় নবাব মসলার সুবাস চান, তার রসে বসে মজতে চান কিন্তু চোখে আর জিহ্বায় তার উপস্থিতি ‘কদাচ নয়’। তাই আওয়াধের বিরিয়ানি একেবারে কোমল, পেলব, বাহুল্যবর্জিত। তাই বলছি বিরিয়ানি সত্যিকার অর্থেই একেবারে ভৈরবীর দোসর। কখনও কেবল কোমল স্বর, কখনও প্রয়োজনে শুদ্ধ, কড়ি, কোমল বারোটি সুরের সকলকে সঙ্গে নিয়ে তার রসের ইন্দ্রজাল তৈরি করে। তাই ভৈরবীতে বাঁধা হিন্দুস্তানি ঠুমরী ‘বাজুবান্দ খুল খুল যায়’ শুনে যেমন ঝাড়বাতির আলোর রোশনিতে উজ্জ্বল নবাবের দরবারের জাঁকজমক আবহের ছবি মনে আসে। অন্যদিকে সেই ভৈরবীতেই বাঁধা নজরুলের ‘এখনো কবরীমূলে কুসুম পড়েনি ঢূলে/ এখনো পড়েনি খুলে মালা খোঁপায়’ শুনলে রাত্রিশেষের নিভু নিভু দীপের আলোয় নিরাভরণ কাতর প্রেমিকার আর্তির রূপকল্প তৈরি হয় মনের পর্দা জুড়ে।
লখনৌ আর বাংলার যোগসূত্রের মাঝে যে নামখানা আসবে, তিনি আর কেউ নন আওয়াধের নবাব অপুত্রক আসফ-উদ-দৌলার পালক পুত্র ওয়াজিদ আলি শাহ। আপাদমস্তক শিল্পী আওয়াধের শেষ এই নবাব ছিলেন যেমন খাদ্যরসিক, তেমনি শিল্প আর সঙ্গীতরসিক। নবাবী কাজকর্মের চাইতে তাঁর মন ছিলো কবিতায়, নাটকে, গানে। জানতেন ১৩ টি ভাষা, লিখেছিলেন ১০৫ টি গজল, ঠুমরী। ছিলেন কত্থক নাচের দারুণ পৃষ্টপোষক। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ আওয়াধের সাম্রাজ্য হারালেন ১৮৫৬ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি । উজিররা নবাবকে খুব করে বলেছিলেন পালিয়ে যেতে। কিন্তু নবাবের বয়ান অনুযায়ী তাঁকে জুতো পরিয়ে দেওয়ার কেউ না থাকাতে তিনি আর পালাতে পারেননি। প্রাণপ্রিয় লখনৌ ছাড়তেই হলো সে বছরের মার্চের ১৩ তারিখ। মে মাসের ৬ তারিখ এসে পৌঁছুলেন কলকাতা। লখনৌ ছাড়বার ব্যথায় বিদীর্ণ নবাবের সঙ্গে এলো তাঁর প্রিয় ৮-১০ জন খানসামা, বাদক- গায়ক – বাইজি নর্তকীর দল, এমনকী কিছু পোষ্য প্রাণীও। তিনি যেন তাঁর সাথে একটুকরো লখনৌকে তুলে নিয়ে এলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন ঠুমরীর কায়দা আর দমপোখত রান্নার শৈলী। গৃহবন্দী নবাবের জন্য শখ আহ্লাদ মেটানোর মতো অর্থের যোগান ছিলো না আর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে তাঁর মায়ের ভূমিকার কারণে ইংরেজের অধিকতর কোপের শিকার হন নবাব। পারস্য বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মসলার সরবরাহ কমে গেল, বিরিয়ানিতে মাংসের পরিমাণও কমিয়ে দিতে হলো অর্থের কম যোগানিতে। শাহী হেঁসেলের খানসামারা তখন মরিয়া কীভাবে ভোজন রসিক নবাবের মন চাঙা রাখা যায় আবার বিরিয়ানির স্বাদও কমে না যায় তাঁর সুলুক সন্ধানে। এই মাহেন্দ্রক্ষণেই জন্ম হয় আমাদের বাঙালি বিরিয়ানির। অনেকটাই হালকা ফুরফুরে, কম মসলাদার। মাংসের ঘাটতি ঢাকতে বিরিয়ানিতে জায়গা পেলো আলু। যদিও তখন আলু এতো স্বল্প দামী আর সহজলভ্য ছিলোনা, পর্তুগীজ বেনিয়াদের হাত ধরে সবে অভিজাত হেঁসেলে তার স্থান মিলতে শুরু হয়েছে। তবে মাংসের চেয়ে কম মূল্যে মেলায় এইভাবে মুঘল বিরিয়ানিতে স্থান পেলো আলু। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে যদিও আলু ছিল নবাবের অর্থনৈতিক অধোগতির প্রতীক, কিন্তু কে ভেবেছিল যে পরবর্তী দেড়শ’ বছরে সেই আলু শুধু বাঙালির বিরিয়ানির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গই হয়ে উঠবে না, বরং বিরিয়ানিতে বাঙালিয়ানার প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে! তাই বলছি নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের কাছে বাঙালির বিরিয়ানি আর ঠুমরীর ঋণ। বিরিয়ানির প্রতি নবাবের ভালোবাসার ফল তো আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আস্বাদন করে চলেছি। আর বিরিয়ানিপ্রেমী এই নবাব রাগ ভৈরবীকেই বেছে নিয়েছিলেন তার লখনৌ ছাড়বার বেদনাকে সুরময় কাব্যে রূপ দিতে। তাঁর কালজয়ী ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুট না যায়’ ঠুমরীর পরতে পরতে ছেয়ে আছে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে আসবার বেদনার গাঁথা, যা কালে কালে নানান শিল্পী তাঁদের নিজস্ব গায়ন শৈলী দিয়ে অনন্যমাত্রিক করে তুলেছেন। লখনৌ ছেড়ে এসেও যেমন বিরিয়ানি ছাড়েননি বরং তাঁর শেকড় ছেড়ে আসবার বেদনায় লখনৌর স্মৃতির মূর্তরূপ হয়ে রসে বশে রেখেছে বিরিয়ানি, হোক না সে তার অভিযোজিত নতুন রূপ। ঠিক তেমনি ভৈরবীর কোমল স্বর কিংবা প্রয়োজনে শুদ্ধ, কড়ি, কোমলের সহাবস্থান ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুট না যায়’-এর প্রবল গভীর আর্তির সুরেলা রসদ যুগিয়েছে। বিরিয়ানির সুবাসিত স্বাদে আর ভৈরবীর অচঞ্চল গভীর স্বরসঙ্গতীতে তাই কোথায় যেন আমার মতো শেকড় ছেড়ে আসা সকল অভিবাসী আশ্রয় খোঁজে, প্রশ্রয়ের সন্ধান করে বিদীর্ণ হৃদয়কে সজীব রাখে, উতলা মনকে পুষ্ট করে, তুষ্ট করে। আর তাই তো আমি বিরিয়ানিতে ভৈরবীর সুর খুঁজে পাই।