ঘুম, খাবার, নিঃশ্বাস, ক্ষমা- এসব বিষয় মন প্রশান্ত করতে প্রভাব রাখে।
Published : 04 Jan 2024, 11:23 AM
কথায় বলে, মগজের ধার নাকি কমে বয়সের তালে। তবে কথাটা সত্যি নয়।
মগজে চলতে থাকা নানান ভাবনা-চিন্তার প্রভাব দেহেও পড়ে। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর কিছু বিষয় আয়ত্তে আনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যক্রম সচল রাখা যায় স্বাভাবিক ভাবে।
মস্তিষ্কের বিশ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া
পর্যাপ্ত বিশ্রাম মস্তিষ্কের সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে।
‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’য়ের অধ্যাপক এবং ‘মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল ইউনিট ফর লাইফলং হেল্থ’য়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক ভিক্টোরিয়া গার্ফিল্ড বলেন, “আমরা সবসময় বলি রাতে গড়ে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন আছে।”
সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি মন্তব্য করেন, “এটা করতে পারলে অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। তবে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাতে না পারলেও কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ভালো মানের ঘুম মস্তিষ্কের ক্ষতি পূরণে সহায়তা করে।”
এছাড়া দিনে অল্প ঘুম বা ‘ন্যাপ’ নিতে পারলে মস্তিষ্কের উপকার হয়। গার্ফিল্ডের করা গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গড়ে প্রতিদিন দিনে স্বল্প মাত্রার ঘুম দেয় তাদের মস্তিষ্কের ঘনত্ব অন্যদের তুলনায় বেশি।
তিনি বলেন, “এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মস্তিষ্কের সার্বিক ঘনত্ব কম থাকলে নানার ধরনের রোগ, অকাল মৃত্যু ও মানসিক চাপে ভোগার সম্ভাবনা বাড়ে।”
এছাড়ও আরও দুটি বিষয় পালন করার পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক, একটি হল- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ওঠা। আর কিছু সময়ের জন্য হলেও মাথার কাজ বন্ধ করা। এক্ষেত্রে না ঘুমাতে পারলেও মনের খোরাক দেয় এমন কিছু নিয়ে থাকতে হবে। সেটা হতে পারে বাগান করা বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো।
মস্তিষ্ক পুষ্ট করা
সঠিকভাবে কাজ করতে মগজের দরকার খাবার। তবে কোন ধরনের জ্বালানি বেছে নেওয়া হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
“আপনি জানেন, আপনার মন কী চায়! তাই যে কোনো খাবারই বেছে নিতে পারেন। তবে সেগুলো স্বাস্থ্যকর হওয়া প্রয়োজন”- একই প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন বস্টনে অবস্থিত ‘ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল’য়ের পুষ্টিবিষয়ক মনোবিজ্ঞানি ডা. উমা নাইডু।
পাশাপাশি একজন পেশাদার লেখক ও রন্ধনশিল্পী হিসেবে তিনি রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য খাবার ব্যবহার করে থাকেন।
তার কথায়, “আমরা বলতে চাই না যে, ‘এই পরিমাণ’ ব্লু বেরি খাওয়া মগজের জন্য উপকারী। তবে আধুনিক বিজ্ঞান নানান প্রমাণ দিয়েছে, কিছু খাবার মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটায়।”
প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ কাপ শাক-পাতা ও পত্রল সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন এই পুষ্টিবিদ। কারণ এসবে থাকে ফোলেইট; এই উপাদান কম থাকা মানে মন-মেজাজও খারাপ থাকা।
এছাড়া মন-মেজাজ উন্নত রাখতে পারে ডার্ক চকলেট। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’য়ের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে এই পুষ্টিবিদ জানান, ১২ হাজার অংশগ্রহণকারীকে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যারা অতিরিক্ত ডার্ক চকলেট গ্রহণ করেছেন তাদের বিষণ্নতার পরিমাণ কমেছে ৭০ শতাংশ।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ খাওয়ারও পরামর্শ দেন ডা. ডাইডু। এছাড়া গাঁজানো খাবার যেমন- টক দই এবং কাঠবাদাম, চিয়া ও তিসির দানাও মস্তিষ্কের জন্য উপকারী।
ক্যাফিন প্রয়োজন, তবে বেশি নয়
চিত্তবিনোদনকারী ওষুধ হিসেবে ক্যাফিন ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে; এর উপকারিতাও আছে। তবে প্রধান চাবিকাঠি হল পরিমাণে সংযত হওয়া। মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণে উল্টো ফল হতে পারে।
এই বিষয়ে মার্কিন বিজ্ঞান-ভিত্তিক লেখক মাইকেল পলেন বলেন, “ক্যাফিন বা নির্দিষ্ট করে বললে ক্যাফিন সমৃদ্ধ পানীয়- চা ও কফি’র নানান উপকারী দিক রয়েছে। সার্বিকভাবে হৃদস্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে, পার্কিনসন’স রোগের ঝুঁকি কমায়।”
এছাড়া ক্যাফিন সমৃদ্ধ পানীয় ভালো অনুভূতি দেয়, জেগে থাকতে সাহায্য করে। তবে কতটা ক্যাফিন গ্রহণ করা খারাপ সেটা নিজেকেই বের করে নিতে হবে। কারণ একেক জনের ক্ষেত্রে ক্যাফিনের প্রভাব একেক রকম।
দেহে সারাদিন ধরে অ্যাডেনোসিন রাসায়নিক উৎপাদনে বাধা দেয় ক্যাফিন। ফলে ঘুমের সমস্যা হয়।
তাই পলেন পরামর্শ দেন, “সারাদিনে কয় কাপ চা বা কফি গ্রহণ করছেন, দিনের কোন সময়ে এই ধরনের পানীয় শেষবারের মতো গ্রহণ করবেন সেটা নিজের ওপর পরীক্ষা করে বের করে নেওয়া যেতেই পারে।”
মানসিক চাপ কমাতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্বাস নেওয়া
এই সময়ে নানান ধরনের খবর আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা বিভিন্ন তথ্য মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতেই পারে। সারাদিন ধরে এসবের মধ্যে থাকতে থাকতে নেতিবাচকের ঘুর্ণিপাকে নিমজ্জিত হতেই হয়।
তাই ‘নিউ ইয়র্ক-প্রেসবেটেরিয়ান হসপিটাল অ্যান্ড ভায়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ’য়ের মনোরোগবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক ডা. গেইল সল্টজ বলেন, “আমি মনে করি, বর্তমানে আমরা যে বিশ্বে আছি সেটা আমাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারমানে এই না যে, সারাক্ষণ এসব খবরের মধ্যেই থাকতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে নিঃশ্বাসের ব্যায়াম জরুরি।”
এক্ষেত্রে প্রথমে সব ধরনের মাধ্যম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, শান্ত হয়ে বসে বুকে হাত দিয়ে পাঁচ পর্যন্ত গুনতে গুনতে নাঁক দিয়ে লম্বা গভীর শ্বাস নিতে হবে। বুকে হাত দেওয়ার কারণ- বাতাস যে পেটে যাচ্ছে না সেটা খেয়াল করা, বুক ফুলে উঠছে বাতাসে সেটা অনুভব করা।
তারপর সাত পর্যন্ত ধীরে গুনতে গুনতে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। সময় নিয়ে গভীর শ্বাস টানা ও ছাড়া- এই হল নিঃশ্বাসের ব্যায়াম। এর ফলে কিঞ্চিত হলেও হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হবে, যা কিনা মস্তিষ্কের জন্য উপকারী, কমবে উৎকণ্ঠা।
সল্টজ বলেন, “এই ধরনের নিঃশ্বাসের ব্যায়াম পাঁচ থেকে ১০ মিনিট করতে পারলে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরাম পাওয়া যায়।”
কাউকে ক্ষমা করার কথা বিবেচনা করা
হতে পারে বন্ধু, অপরিচিত কেউ এমন কি নিজেকে- ক্ষমা করার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উপকার মেলে, চাপ ও উদ্বিগ্নতা কমে, রক্তচাপ হ্রাস পায়, ঘুম ভালো হয়।
“ক্ষমা করতে পারাটা একটা নৈতিক গুণ। এই দয়ালু স্বভাবটা তাকেই দেখানোর চেষ্টা করতে হবে যে হয়ত আপনার প্রতি ভালো আচরণ করেনি”- মন্তব্য করেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন-ম্যাডিসন’য়ের ক্ষমা-বিষয়ক বিজ্ঞান ও মনোরোগ শিক্ষার অধ্যাপক রবার্ট এনরাইট।
ক্ষমা করতে পারাটা এক ধরনের অভ্যাস। এজন্য সময়ের প্রয়োজন হয়।
এনরাইট পরামর্শন দেন, “সেজন্য শুরু করতে হবে ছোট বিষয় থেকে, যা আপনাকে হয়ত কম ভোগাচ্ছে। সময়ের তালে অভ্যস্ত হলে বড় বিষয়গুলো ক্ষমা করে দেওয়ার অভ্যাস গড়ে নিতে পারবেন।”
মানসিকভাবে ভোগান্তির কারণ হচ্ছে এমন বিষয়ে আটকে থাকতে হলে ক্ষমা করাটা যথাযোগ্য হবে।
তিনি বলেন, “নিজেকে সারিয়ে তোলার রাস্তা কী? একবার চেষ্টা করা, আবার চেষ্টা করা, বার বার চেষ্টা করার পরেও সেরে উঠছে না মন! আমার কথা হল- এবার ক্ষমা দেওয়াটা বিবেচনায় আনতে হবে। যদিও বিষয়টা পুরোটাই ক্ষমাকারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।”
অভিজ্ঞরা মনে করেন, অন্তত এই পাঁচ বিষয় জীবনযাপনের ধারায় আয়ত্তে আনতে পারলে মস্তিষ্কের যেমন উন্নতি ঘটবে তেমনি মন হবে শান্ত নির্মল।
আরও পড়ুন