গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট কিট’ অ্যান্টিবডি চিনতে পারলেও সংক্রমণের প্রথমভাগে করোনাভাইরাস শনাক্তে ‘কার্যকর নয়’ বলে প্রতিবেদন দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মূল্যায়ন কমিটি।
Published : 17 Jun 2020, 01:48 PM
মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বুধবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।
তিনি বলেন, “এই কিট উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রোগ শনাক্তকরণে কার্যকর নয়। উপসর্গের প্রথম দুই সপ্তাহে এই কিট ব্যবহার করে শুধুমাত্র ১১ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।”
পারফরম্যান্স কমিটি গণস্বাস্থ্যের ৫০৯টি র্যাপিড কিট পরীক্ষা করে ওই প্রতিবেদন দিয়েছে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, এই কিট অ্যান্টিবডি শনাক্ত করতে পারলেও আইজিএম (ইমিউনোগ্লোবিন এম, যা ইনফেকশনের শুরুতে তৈরি হয়) এবং আইজিজি (ইমিউনোগ্লোবিন জি, ইনফেকশনের বিলম্বিত পর্যায়ে তৈরি হয়) তা আলাদাভাবে পার্থক্য করতে পারে না।
তবে এই কিট কোভিড-১৯ এর বিস্তার বোঝার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “এর মাধ্যমে ৭০ শতাংশ রোগী, যাদের ইতোপূর্বে কোভিড-১৯ হয়েছিল, তাদের শনাক্ত করা সম্ভব।”
আর অ্যান্টিবডি টেস্টের ওই তথ্য প্লাজমা বিতরণ, কোয়ারেন্টিন সমাপ্তির সময় নির্ধারণ এবং লকডাউন উত্তোলনের রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত দেন অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “যেসব স্থানে প্রচলিত আরটি-পিসিআর পদ্ধতি চালু নেই, অথবা যাদের কোভিড-১৯ উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও আরটি-পিসিআর নেগেটিভ এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই কিট কিছুটা সহায়ক হতে পারে।”
কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য গঠিত এই কমিটির প্রধান অধ্যাপক শাহীনা তাবাসসুম বুধবার দুপুরে উপাচার্যের কাছে তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেন।
ওই কিটের উদ্ভাবক গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজন কুমার শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিবেদন সম্পর্কে এখনো তারা বিস্তারিত জানেন না।
“প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরে তা বিশ্লেষণ করে দেখব কেন কার্যকর নয়? কোন আঙ্গিকে তারা (বিএসএমএমইউ) এটা বলেছে।
“তবে দুচিন্তার কোনো কারণ আমরা দেখছি না। আমরা তো আমাদের তৈরি করা কিট চিনি। এই কিটের প্রতি আমাদের আস্থা আছে।”
র্যাপিড টেস্ট কী
করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য বিশ্বে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর)। বাংলাদেশে এখন কেবল এ পদ্ধতিতেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমতি রয়েছে।
করোনাভাইরাস যেহেতু মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, তাই নমুনা হিসেবে রোগীর লালা, শ্লেষ্মা বা কফ পরীক্ষা করা হয়। নমুনায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা বুঝতে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ রি-এজেন্ট। পিসিআর পরীক্ষার কিটকে বলা হয় পিসিআর প্রাইমারি প্রোব রি-এজেন্ট।
রোগীর নমুনায় নতুন করোনাভাইরাসের জিনোম বৈশিষ্ট্যের কোনো জেনেটিক বিন্যাস পাওয়া গেলে ফলাফল আসবে ‘পজিটিভ’।
পরীক্ষাটি করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি। তাছাড়া ব্যয়বহুল আরটি-পিসিআর ব্যবহারে দক্ষ জনবল প্রয়োজন হয়।
সে কারণে স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে ফল দিতে পারে-এমন কিট তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। একে বলা হয় র্যাপিড টেস্টিং কিট। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটও এ ধরনের কিট।
এই কিটে পরীক্ষার জন্য নমুনা হিসেবে রোগীর রক্ত ব্যবহার করা হয়। ভাইরাস নয়, এই কিট দিয়ে আসলে শনাক্ত করা হয় অ্যান্টিবডি। অবশ্য গণস্বাস্থ্যের দাবি, তাদের কিট অ্যান্টিজেনও শনাক্ত করে।
শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এর বিরুদ্ধে লড়তে শরীরই এক পর্যায়ে প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে তৈরি করে নেয়, যাকে বলে অ্যান্টিবডি। আর যে জীবাণুর প্রতিক্রিয়ায় অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে বলে অ্যান্টিজেন। সেই অ্যান্টিবডির কাছে ভাইরাস পরাজিত হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, কেউ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাস থাকলেও এই পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না।
আবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও তার রক্তে অ্যান্টিবডি থেকে যাবে। ফলে তার শরীরে ভাইরাস না থাকলেও র্যাপিড কিটের টেস্ট ফলাফল পজিটিভ আসবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই বিশেষজ্ঞরা র্যাপিড কিট ব্যবহারের এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে আসছেন। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থাও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিতর্ক
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সঙ্কটের শুরুর দিকে যখন কিট সঙ্কট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তখনই দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষে কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তে কিট উদ্ভাবনের খবর দেন বিজন কুমার শীল।
এরপর চীন থেকে কাঁচামাল (রি-এজেন্ট) এনে কিটের স্যাম্পল তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের এই ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট কিট দিয়ে ৫ মিনিটে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে, খরচ হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বলে আসছে, এ ধরনের র্যাপিড কিটে পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ‘ফলস পজেটিভ কিংবা ফলস নেগেটিভ’ রেজাল্ট আসে। মহামারীর এই সময়ে এরকম ভুল ফলাফল মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কারণ ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়ে কেউ নিজেকে ভাইরাসমুক্ত মনে করলেও বাস্তবে তিনি হয়ত বহু মানুষকে আক্রান্ত করবেন।
এর মধ্যেই গত ২৫ এপ্রিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের উদ্ভাবিত টেস্টিং কিটের নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রতিনিধির কাছে কিটের নমুনা তুলে দেওয়া হয়। তবে সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেখানে ছিলেন না।
গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে কিট অনুমোদনে গড়িমসির অভিযোগ আনেন।
এর জবাবে ২৭ এপ্রিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ‘অপপ্রচার’ না করতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান।
দীর্ঘ বিতর্কের পর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গত ৩০ এপ্রিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তাদের উদ্ভাবিত কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউ অথবা আইসিডিডিআরবিতে নমুনা জমা দেওয়ার অনুমতি দেয়।
এরপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ২ মে কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ৬ সদস্যের কমিটি করে এবং ১৩ মে তাদের উদ্ভাবিত কিট বিএসএমএমইউতে জমা দেয়। ৩৪ দিন পর বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত জানাল।
মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যা জানালেন উপাচার্য
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গণস্বাস্থ্যের কিটের ‘একটি বিজ্ঞানসমম্মত মূল্যায়ন’ করতে বলার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শাহীনা তাবাসসুমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল গঠন করে ওই কিট পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়।
ওই দলটি ‘ইভালুয়েশন অব জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড অ্যান্টিবডি ডট টেস্ট অ্যান্ড জি আর কোভিড-১৯ র্যাপিড অ্যান্টিজেন ডট টেস্ট ফর ডিটেকশন অব সার্স–কোভ ২’ শিরোনামে একটি গবেষণার কাজ শুরু করে।
অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া জানান, এ কাজের জন্য ঔষধ প্রশাসন এক বছর সময় দিলেও ‘বাস্তবতার নিরিখে’ গবেষণা দল এক মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে। গবেষণার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে আরও এক সপ্তাহ ব্যয় হয়।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিউক্যালস ১২ মে প্রথম ২০০ অ্যান্টিবডি কিট পরীক্ষার জন্য দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষণা করার কথা থাকলেও ১৯ মে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিউক্যাল রক্তের পরিবর্তে রোগীর লালার নমুনা পরীক্ষার অনুরোধ জানায়।
“পরবর্তীতে লালা পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ায় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিউক্যালস বিএসএমএমইউর গবেষণা দলকে লালার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা সাময়িক স্থগিত রাখার অনুরোধ জানায়, শুধুমাত্র অ্যান্টিবডি কিটের গবেষণা চালু রাখার অনুরোধ জানায়।
“গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিটিউক্যালস বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কারণে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন বিলম্বিত হয়। কিন্তু গবেষণা টিম অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পরিশ্রম করে এক মাসের মধ্যেই তাদের কার্যক্রম শেষ করেন ও রিপোর্ট তৈরি করেন।”