কোভিড-১৯: কিট নিয়ে গণস্বাস্থ্যের কাছে প্রশ্ন বিশেষজ্ঞের

নতুন করোনাভাইরাস শনাক্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে কিট উদ্ভাবন করেছে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শুদ্ধতার (ভ্যালিডেশন) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে আসা পর্যন্ত এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2020, 01:16 PM
Updated : 27 April 2020, 03:36 PM

এই কিট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনার মধ্যে জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব প্রশ্ন তুলে ধরেন।

তিনি বলছেন, রক্ত পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ শনাক্ত করার পদ্ধতি এখনও গ্রহণযোগ্য নয়। পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা হিসেবে রোগীর লালা কিংবা শ্লেষ্মা পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়কেই এখনও পর্যন্ত শতভাগ সফল বলে ধরা হচ্ছে।

“আমি আক্রান্ত কি না সেটার এখনও স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা হচ্ছে সোয়াব নিয়ে পিসিআরে পরীক্ষা করা।”

এই গবেষক বলেন, “যেহেতু এই ভাইরাসটা রক্তে এত পরিমাণে পাওয়ার কথা না, সেই হিসাবে উনারা যদি দাবি করে থাকেন যে, এটা পিসিআরের সমমূলক সেনসেটিভ তাহলে অনেক ডেটা আমাদের দিতে হবে। কারণ আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরও রক্তে এটা পাওয়া যায়নি।

“যার জন্যে এত কষ্ট করে নাক দিয়ে, শ্বাসপ্রণালী থেকে এটা নিতে হয়। নেওয়াটাও কষ্ট, যে নিচ্ছেন- ডাক্তারও ইনফেকটেড হন।”

ড. আকবর বলেন, “যেহেতু একটা প্রতিষ্ঠিত পিসিআর সারা বিশ্বে আছে যেটা শতভাগ বিশ্বাস করা হয়। সেক্ষেত্রে এই কিটের ভ্যালিডেশন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক জিনিসগুলো যদি গোপন থাকে তাহলে হবে না।”

নতুন করোনাভাইরাস শনাক্তে রোগী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবন করেছে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ নামে র‌্যাপিড টেস্টিং কিট।

এই ধরনের র‌্যাপিড টেস্টে রক্তের নমুনায় অ্যান্টিবডির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। এই ধরনের দ্রুত পরীক্ষার কিট অনেক দেশ তৈরি করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিষেধের মুখে তা ব্যবহৃত হচ্ছে না।

কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র‌্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাস থাকলেও এই পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না।

আবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও তার রক্তে অ্যান্টিবডি থেকে যাবে। ফলে তার শরীরে ভাইরাস না থাকলেও র‌্যাপিড কিটের টেস্ট ফলাফল পজিটিভ আসবে।

গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের গবেষণা দলের প্রধান বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল বলেছেন, “অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন এই দুইটির সমন্বয় করে কিট তৈরি করা হয়েছে। এটি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সুনির্দিষ্টভাবে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম।”

এই নতুন কিটের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে করোনাভাইরাস শনাক্তে ‘একশভাগ সফলতা পাওয়ার’ দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে ড. ফজলে আকবর বলেন, “উনাদের কিটটার কথা যেটা শুনেছি যে, পিসিআরের সমান বা পিসিআরের থেকে বেশি সেনসেটিভিটি আছে। এখানে খুব একটা ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন আছে, এ পর্যন্ত পিসিআরে রক্ত পরীক্ষা করেও ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি পজিটিভ পাওয়া যায়নি। সেখানে কীভাবে আমরা এই ধরনের একটা কিট দিয়ে ১০০ শতাংশ বা পিসিআরের মতো পাব- সেটা একটা বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন।

“কারণ রক্ত নিয়ে পরীক্ষায় প্রথমে ১ শতাংশ পজিটিভ পাওয়া যায়। তারপর সম্প্রতি একটা চাইনিজ পত্রিকায় এসেছে, সেখানে তারা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাহলে ১০০ শতাংশ কীভাবে পাব?”

পিসিআরের মত ডায়াগনস্টিকেও রক্তের পরীক্ষায় যেখানে এত কম ফল পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে এই কিট দিয়ে কীভাবে সম্ভব- এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “যদি এন্টিজেন দিয়ে ১০০ শতাংশ পাওয়া যায়, তাহলে সেটা বিরাট একটা ব্যাপার! বিরাট আবিষ্কার।

“তবে আমার জানা মতে, এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনও ধরনের আর্টিকেল নাই যেখানে এই ধরনের পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ পাওয়া যায়।”

ড. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর

হেপাটাইটিস-বি চিকিৎসায় নাসভ্যাক নামের নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলে দেন শেখ ফজলে আকবর। এই ওষুধ উদ্ভাবনে ৩২ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি।

জাপানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে পিএইচডি করে সেখানেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ফজলে আকবর। তোশিবা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল সায়েন্সেস বিভাগের মুখ্য গবেষক হিসেবেও কাজ করেছেন এক সময়।

এই গবেষক যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া-প্যাসিফিক, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ও অঞ্চলের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সংগঠনের অ্যাকাডেমি সোসাইটির সদস্য। তিনি ‘ইউরোএশিয়ান জার্নাল অব হেপাটো-গ্যাসট্রোএনট্রোলজি’র প্রধান সম্পাদক।

জাপানের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এই স্কলার নব্বইয়ের দশকে আইসিডিডিআর,বিতে কাজ করেছেন।

অ্যান্টিবডি টেস্টের ব্যাখ্যা দিয়ে ফজলে আকবর বলেন, “ধরুন, এখন পৃথিবীতে বা যুক্তরাষ্ট্রে যত আক্রান্ত বা মারা গেছেন, এই সব কেইস কিন্তু পিসিআর করা।

“তার মানে এখন রোগী এলো, তার পিসিআর পজিটিভ বা ভাইরাস আছে কি না এটা জানা। এটাকে আমরা বলি ডায়াগনস্টিক কেইস। আরেকটা হতে পারে বাংলাদেশে প্রথম কেইস মার্চের ৮ তারিখে। তারপর প্রায় ২০ দিন চলে গেল। আমরা একটা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখতে পারি কতজন লোক আক্রান্ত হয়েছেন।”

তবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় সঠিক ফল না পাওয়ায় ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এ পরীক্ষা বন্ধ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কারণ এটা স্পেসিফিক না। যে উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। সেজন্যই আমাদের দরকার ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

“ধরুন, একটা রোগীকে আমরা সন্দেহ করছি যে, করোনাভাইরাস আছে। যেটার জন্য সোয়াব নিতে হত, ডাক্তারদের ইনফেকশনের ভয় ছিল। সেখানে রক্ত নিয়ে করে ফেলতে পারব? তাহলে তো এটা বিরাট একটা আবিষ্কার!”

ড. ফজলে আকবর বলেন, “আর যদি তাই হয়ে থাকে, যে কোনও নতুন আবিষ্কারকে পৃথিবীতে প্রথমে পেটেন্ট করা হয় অথবা সায়েন্টিফিক কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এ রকম জার্নালে দিলে সেগুলো আমরা পেতে চাই। আমরা সে রকম কিছু পাইনি।

“যদি বলা থাকে, এটা পিসিআরের থেকে বেশি সেনসেটিভ তাহলে নিশ্চয়ই উনারা একটা জায়গাতে তুলনা করেছেন। সেই তুলনার ডেটা উনারা হয় সায়েন্টিস্টদের দেবেন অথবা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে (সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ) দেবেন। তারা দেখাবেন যে, এই যে আমরা এতগুলো টেস্ট করেছিলাম। আপনার পিসিআর দিয়েও যতগুলো পজিটিভ, আমার এন্টিজেন দিয়েও ততগুলো পজিটিভ।”

সিডিসির কাছে কিটের নমুনা তুলে দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্স কাউন্সিলের প্রধান উপদেষ্টা ফজলে আকবর বলেন, “এই যে, ডেটার তুলনামূলক বিশ্লেষণের (ভ্যালিডেশন) কথা বললাম, এটা সব সময় থার্ড পার্টি দ্বারা হতে হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে আরও যেটা বলতে হয় যে, প্রথম একটা এন্টিজেন বের করার পরে সেই এন্টিজেনের স্ট্রাকচারটা আমাদের জানা দরকার হয়। এই ভাইরাসটার এন্টিজেন স্ট্রাকচারটা আমরা জানি, কোন স্ট্রাকচার দিয়ে কিট তৈরি করলে এটা শনাক্ত হতে পারে- এটাও ওনাদের বলা নাই। আমি জানি না, উনারা উনাদের লিফলেট দেবেন কি না?

“আমি যদি বলি আমার কাছে একটা কিট আছে, আপনি আসেন। এটা ভালো হবে। এটা থার্ড পার্টি এবং আন্তর্জাতিক ভ্যালিডেশন হয়। উনারা এটা করছেন কি না? সেটা যে কোনও সময় করতে পারেন। কাকে জমা দিচ্ছেন সেটা কিন্তু একটা ব্যাপার। তার মানে উনারা একটা জিনিস বের করেছেন, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিষয়টা পরিমিত পরিমাণে দেননি।”

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রতিনিধির কাছে কিটের নমুনা দিয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাদের অভিযোগ, সরকারকে দিতে চাইলেও তা নিচ্ছে না।

গণস্বাস্থ্যের কিট না নেওয়ার বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান রোববার বলেছেন, যেহেতু এই কিট এখনও অনুমোদিত নয়, তা তারা এটা হস্তান্তর হতে পারে না।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র‌্যাপিড কিটের অনুমোদন কোনো দেশের জন্য এখনও দেয়নি। ফলে তারাও এখনই দিতে চাচ্ছেন না।

ফজলে আকবর প্রশ্ন তোলেন, “প্রধান একটা ব্যাপার হচ্ছে, এটা ডায়াগনস্টিক কিট কি না? এটা আগের অ্যান্ডিবডি কিটের মতো কোনো কিট কি না? কিট আগের হলে- ভারত এটার ব্যবহার করবে না বলছে। যুক্তরাষ্ট্রে এটার ব্যবহারে বিভিন্ন রকমের ফল পাওয়া গেছে।

“আজকে আমাদের যেটা দরকার যে, বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র সবাই পিসিআর মেশিন দিয়ে করছে। এর বাইরে যেটা, সেটা হলো এপিডেমিওলজিক্যাল। আমাদের দরকার হল- এই মূহুর্তে এই রোগীটার করোনাভাইরাস আছে কি না সেটা জানা। আমার কত শতাংশ লোক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, সেটা এই মুহূর্তে দরকার না।”

তিনি বলেন, “আমার শরীরে ভাইরাসটা আছে কি না সেটা দেখতে গেলে ডায়াগনস্টিক কিট হতে হবে এবং সেটা পিসিআরের সঙ্গে তূলনা করতে হবে। সেটা করতে হলে এন্টিজেন স্ট্রাকচারের ডেটা দিতে হবে, পেটেন্ট হয়েছে কি না, পিয়ার রিভিউ হয়েছে কি না?”

চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন নিরাপত্তা, তেমনি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টকরণ (স্পেসিফিকেশন) জরুরি জানিয়ে এই বিজ্ঞানী বলেন, “আপনার নাই, বলা হল পজিটিভ হয়ে গেলেন। আবার আপনার আছে বলা হল নেগেটিভ। এই জিনিসগুলো জানতে চাই, পরীক্ষা করতে চাই।”

মহামারীর মতো সময়ে কোনো কিছু নিয়ে ‘সিরিয়াসনেসের’ যেমন ঘাটতি থাকা উচিৎ না, তেমনি কোনো কিছু নিয়ে ‘ছেলেখেলা’ করাটাও সম্ভব না বলে সতর্ক করে দেন তিনি।

গণস্বাস্থ্যের কিট কতটা কার্যকর সে বিষয়ে উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি তথ্য দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এই গবেষক বলেন, “বিজ্ঞানের ব্যাপারে প্রথম কথাই হল, আরও তথ্য প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে অনেক ‘যদি কিন্তু’ আছে। আমরা আরো বেশি তথ্য না পেলে অনেক সম্ভাবনাই নষ্ট হতে পারে, আবার অনেক আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে।”