কোভিড-১৯: র‌্যাপিড টেস্ট কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

করোনাভাইরাস সনাক্ত করার জন্য অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন পর্যায়ে আমদানি করা র‌্যাপিড টেস্ট কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2020, 02:27 PM
Updated : 30 April 2020, 12:10 PM

তারা বলছেন, এসব কিট দিয়ে পরীক্ষায় ভুল ফল আসার শতকরা হার অত্যন্ত বেশি। কাজেই দেশের এই পরিস্থিতিতে এসব র‌্যাপিড কিট ব্যবহার করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় এই শনাক্তকরণ কিট এখন বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি বস্তুগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকার পরও শুধু এই কিটের অভাবে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে খাবি খেতে হচ্ছে অনেক দেশকে।  

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ স্বল্প সময়ে ফল দিতে পারে-এমন কিট তৈরির কথা বলছে। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রও এ ধরনের র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের দাবি করেছে।

অন্যদিকে ঢাকার আইইডিসিআরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি পর্যায়ে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তে এখন পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পদ্ধতি, যা বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাস পরীক্ষায় নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে।

দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন বড় হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব থাকলেও পর্যাপ্ত কিট না থাকায় এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না রেখে পরীক্ষা করাতে গেলে অন্য রোগী ও হাসপাতাল কর্মীরা ঝুঁকিতে পড়বেন বলে করোনাভাইরাস সঙ্কটের শুরুতে এ পরীক্ষা করা হচ্ছিল কেবল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআরে।

বিদেশ থেকে কিট আসার পর এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ১৭টি জায়গায় নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৯২ হাজার পিসিআর কিট সংগ্রহ করে ২১ হাজার কিট বিভিন্ন হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারে বিতরণ করা হয়েছে।

তবে এর বাইরেও চীন থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে র‍্যাপিড টেস্ট কিট এনে হাসপাতালে বিতরণের খবর আসছে, যেসব কিট আদৌ দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত নয়।

সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমও চীন থেকে ৫০ হাজার র‌্যাপিড টেস্ট কিট এনেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে। তবে জাহাঙ্গীর আলম তা নেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. নজরুল ইসলাম এসব কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, জরুরি অবস্থা হলেই উল্টাপাল্টা কাজ করা যাবে না।

পরীক্ষায় ভুল ফলাফল এলে তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন ভাইরোলজিস্ট নজরুল।

 

পিসিআর-র‌্যাপিড কিটের তফাত

দেশে সরকারি ব্যবস্থায় যে পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষা হচ্ছে তাকে বলে আরটি-পিসিআর বা রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমেরেজ চেইন রিঅ্যাকশন।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনাভাইরাস যেহেতু মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, তাই নমুনা হিসেবে রোগীর লালা, শ্লেষ্মা বা কফ পরীক্ষা করা হয়।

নমুনায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা বুঝতে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ রি-এজেন্ট। আইইডিসিআর এই পরীক্ষায় যে কিট ব্যবহার করে, তাকে বলা হচ্ছে পিসিআর প্রাইমারি প্রোব রি-এজেন্ট।

প্রতিটি প্রাণীর ডিএনএ বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা, তেমনি প্রতিটি ভাইরাসের জিন বিন্যাসও হয় আলাদা ধরনের। একে বলে ভাইরাল জিনোম। রোগীর নমুনায় করোনাভাইরাসের জিনোম বৈশিষ্ট্যের কোনো জেনেটিক বিন্যাস পাওয়া যায় কি না- সেটাই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার লক্ষ্য।

নভেল করোনাভাইরাস যেহেতু আরএনএ ভাইরাস, সেহেতু পরীক্ষার জন্য প্রথমে রোগীর নমুনা থেকে সব ধরনের আরএনএ আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর তার সঙ্গে মেশানো হয় রি-এজেন্ট এবং সত্যিকারের করোনাভাইরাস থেকে পাওয়া জিনের উপাদান। পরে সেই মিশ্রণ পরীক্ষা করা হয় নির্দিষ্ট যন্ত্রে।

রোগীর নমুনায় যদি করোনাভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে এ পরীক্ষায় তার সংখ্যা বাড়বে। ফলাফল আসবে ‘পজেটিভ’।

পরীক্ষাটি করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি। তাছাড়া ব্যয়বহুল আরটি-পিসিআর করতে দক্ষ জনবলেরও প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে দ্রুততম সময়ে নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে ব্যবহার করা হয় র‌্যাপিড কিট। তবে এ কিটের মাধ্যমে পরীক্ষায় কিছু অসুবিধাও রয়েছে।

এই কিটে পরীক্ষার জন্য নমুনা হিসেবে রোগীর রক্ত ব্যবহার করা হয়। ভাইরাস নয়, এই কিট দিয়ে আসলে শনাক্ত করা হয় অ্যান্টিবডি।

শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এর বিরুদ্ধে লড়তে শরীরই এক পর্যায়ে প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে তৈরি করে নেয়, যাকে বলে অ্যান্টিবডি। সেই অ্যান্টিবডির কাছে ভাইরাস পরাজিত হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণের পর কারও শরীরে একবার অ্যান্টিবডি তৈরি হলে সেই ভাইরাস আর পরবর্তীতে তাকে কাবু করতে পারে না বলে মনে করা হয়। তবে নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তা ঘটবে কি না, সেটা এখনও প্রমাণিত নয়। 

চিকিৎসকরা বলছেন, কেউ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র‌্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাস থাকলেও এই পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না।

আবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও তার রক্তে অ্যান্টিবডি থেকে যাবে। ফলে তার শরীরে ভাইরাস না থাকলেও র‌্যাপিড কিটের টেস্ট ফলাফল পজিটিভ আসবে।

ভুল ফলের বিপদ

ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, “র‌্যাপিড কিটে দেখতে হবে এটার স্পেসিফিকেশন। সেনসিটিভিটির (রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা) হার শতভাগের কাছাকাছি না হলে সেগুলো ব্যবহার করা যাবে না। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া আমদানি করা এসব কিটে ফলাফল ভুল আসতে পারে।”

ভুল ফলাফলের যে বিপদ, তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কারও শরীরে করোনাভাইরাস থাকার পরও নেগেটিভ এলে ওই ব্যক্তি মনে করবে আমি তো ভালোই আছি। সবার সঙ্গে মেলামেশা করবে, রোগটি ছড়িয়ে দেবে অন্যের মধ্যে। আবার শরীরে করোনাভাইরাস না থাকলেও যদি পজিটিভ আসে, সে নানাভাবে হয়রানির শিকার হবে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে।”

নিজের উদ্যোগে কিট আমদানির কারণ জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশে কিটের প্রয়োজন আছে মনে করেই তিনি আমদানি করেছেন। এর মধ্যে কিছু কিট বিভিন্ন হাসপাতালে দিয়েছেন, বাকিগুলো তার কাছে রয়েছে।

“দিয়া রাখছি, যদি কাজে লাগে। প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবে। বাকিগুলা আমার এলাকার হাসপাতালে ব্যবহার করা হবে।”

চীনে আরও এক লাখ কিট প্রস্তুত আছে, প্রয়োজন পড়লে সেগুলোও আনা যাবে জানিয়ে মেয়র বলেন, সরকার চাইলে যে কোনো সময় এর মান পরীক্ষা করে দেখতে পারে।

“না দেখেই খারাপ-ভালো বলা তো ঠিক না। সারা দুনিয়ায় বিমান চলাচল বন্ধ। এখন তো আমরা বেকায়দায় আছি, এ কারণে যার কাছে যা পারছি, সাহায্য সহযোগিতা চাইছি। যেহেতু সারা দুনিয়ায় ক্রাইসিস হয়ে গেছে, এজন্য এনে রাখছি।”

জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, অনেকে ‘না জেনে অনেক কিছু’ বলছে। কিন্তু কিট আমদানি করে তিনি ‘ভুল করেননি’।

“মানুষ মরে গেলে আইন দিয়ে কী করব! তাদের মনে হয়েছে তারা বলেছেন, কিন্তু আমার এখানে ৪০ লাখ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। যে কোনোভাবে হোক আগে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব। আমি মানবিক কারণে আমি আনছি, বাঁইচা থাকলে তখন আইন আদালত।”

সঙ্কটের শুরুতে চীনের কুনমিংয়ের মেয়রকে বিশ লাখ মাস্ক দিয়েছিলেন জানিয়ে গাজীপুরের মেয়র বলেন, সে কারণেই তারা কিট আনতে সহায়তা করেছে।

ব্যক্তি উদ্যোগে র‌্যাপিড টেস্ট কিট আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনুমতি ছাড়া আনার কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু তিনি (মেয়র জাহাঙ্গীর) আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেননি।”