২০২২: যুদ্ধের ঝড়ে এলোমেলো অর্থনীতি

দুর্দিন আর দুরবস্থার দিন পেরিয়ে আশা জাগাচ্ছে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও সারের দাম কমার খবর; খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী ধারাও পড়তির পথ ধরেছে। এর কতটা সুফল বাংলাদেশ পাবে সেটাই দেখার বিষয়।

শেখ আবু তালেবনিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2022, 07:24 PM
Updated : 30 Dec 2022, 07:24 PM

অনেক শঙ্কা জাগিয়ে অর্থনীতিতে আরেকটা টালমাটাল বছর কাটল আশা নিরাশায় দোলাচলে; বৈশ্বিক মন্দা আর চড়া পণ্যমূল্যের আছড়ে পড়া ঢেউয়ে দেশেও সেই দুঃসময়ের পালার অবসান হয়নি, যে কারণে দুরূহ জীবনযাত্রার বাস্তবতা নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছর।

দুর্দিন আর দুরবস্থার দিন পেরিয়ে নতুন ভোরের প্রত্যাশা সবারই; দুর্যোগ ও সংকটের সময়কে পেছনে ফেলতে সরকারও সাশ্রয় ও কৃচ্ছ্বতা সাধনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে গতি ধরে রাখতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে।

যুদ্ধের ঝড়ে অর্থনীতিতে এক ঝঞ্ঝার বছরের শেষ দিকে আশা জাগাচ্ছে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও সারের দাম কমার খবর; খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী ধারাও পড়তির পথ ধরেছে। দেশে অস্থিরতা কাটিয়ে ডলারের বাজারও এখন একটা পর্যায়ে এসে স্থিতিশীল। আর বন্যার বিপর্যয় কাটিয়ে আমনের ভালো ফলনের সুখবর নিয়েই পঞ্জিকা বর্ষ শেষ মাসের পাতা ওলটাচ্ছে।

বছরজুড়ে অর্থনীতিতে নানা সংকটের ডালপালা মেলার মধ্যে খাদ্যপণ্যে পরনির্ভরশীলতা কমাতে সরকারের একের পর এক আহ্বান ও উদ্যোগের মধ্যেই বছরের শেষ সময়ে আমনের ভালো ফলনের খবর দিয়েছেন সরকারপ্রধান। এতে খাদ্যপণ্যের অভাব নিয়ে তৈরি হওয়া ভয় অনেকটাই কাটবে বলে আশ্বস্থ করে ফলন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন; আশ্বস্থ করেছেন অন্য দেশের মত ততটা দুরবস্থায় নেই বাংলাদেশ।

অথচ মহামারীর ক্ষত কাটিয়ে ওঠার মধ্যে যুদ্ধের কারণে তেঁতে ওঠা বিশ্ববাজার বছরের বড় অংশজুড়েই ভুগিয়েছে; সময়ে সময়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কাও প্রকাশ পেয়েছে অর্থনীতিবিদসহ সরকারি নীতি নির্ধারকদের মুখেও। ‘দুর্ভিক্ষের’ অশনির কথাও উঠেছে কখনও কখনও।

খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতে আমদানিতে বাড়তি নজর দিতে দেখা গেছে সরকারকে। কর কমিয়ে, শুল্ক মওকুফ করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর চেষ্টা চলেছে।

এরপরও অস্থির পণ্যবাজারে হিমশিম খেতে হয়েছে ভোক্তাদের; উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ত্রাহি অবস্থা নিয়েই কাটছে দিনকাল।

যুদ্ধের ঝড়

কোভিড ১৯ ভাইরাস সংক্রমণে নজরবিহীন এক মহামারীর রেশ কাটিয়ে ওঠার মধ্যেই এক দশক পর আরেকটি বৈশ্বিক মন্দার আবহ তৈরি হয় ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধে; বছরের বড় অংশজুড়েই এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সুদূরের বাংলাদেশকেও।

Also Read: যুদ্ধে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: আরও বেশি চাপ সামলাতে কী করবে বাংলাদেশ?

Also Read: ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের কারণ হতে পারে: জাতিসংঘ

Also Read: সঙ্কটের কারণ শুধুই যুদ্ধ? আলোচনা বিআইডিএস সম্মেলনে

Also Read: ইউক্রেইন থেকে বিশ্বের কত শস্য দরকার

যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের ধাক্কা ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলতে থাকে দেশের অর্থনীতিতেও। যুদ্ধের ফেরে অর্থনীতিতে হাজির হয় ভয় ধরানো এক সময়। আতঙ্ক আর শঙ্কার কথা ঘুরে ফিরে এসেছে সরকারি নীতি নির্ধারকদের মুখেও।

বিদেশের মত দেশেও সাম্প্রতিক সময়কালের সবচেয়ে খারাপ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যে ‘দুর্ভিক্ষের’ অজানা আশঙ্কায় নানান গুজবেও জেরবার হয়েছে মানুষ।

মহামারীর ধকল কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টাতে সামনে উদাহরণ হয়ে এসেছে শ্রীলঙ্কার বিপর্যয়। বাংলাদেশের পরিণতি শ্রীলঙ্কা হবে কি না দীর্ঘ সময় ধরে এই আলোচনার মধ্যেই রিজার্ভ কমতে থাকার খবর তর্ক বিতর্কের রসদ জুগিয়েছে।

সেই তর্ক পেছনে ফেলে ‘দেউলিয়া’ হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি তীব্র চাপ কাটিয়ে এগিয়েছে গুটিগুটি পায়ে। সরকারের সাশ্রয়ের পথ আর ডলার বাঁচাতে কড়াকড়ির মধ্যে ঘাটতি মেটাতে আইএমএফের সঙ্গে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির প্রাথমিক সমঝোতা সামনে এগিয়ে যাওয়ার রসদ জুগিয়েছে।

এরমধ্যেই নভেম্বরে রপ্তানি ও রেমিটেন্সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার খবরে নতুন বছরের প্রথম মাস থেকেই বিদেশি মুদ্রার সংকটের সূত্র ধরে অর্থনীতিতে নেমে আসা কালো মেঘের ছায়া কাটতে শুরু করবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা।

Also Read: একটি দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?

Also Read: যে কারণে বাংলাদেশ বেশি বিদেশি ঋণ পাচ্ছে

অর্থনীতিবিদদের আশা ঝঞ্ঝাবহুল অর্থনীতির কারণে গত বছরজুড়ে যে আঁধার ছড়িয়েছে তা সরানোর উদ্যোগে থাকবে কোভিড মহামারী থেকে উত্তরণের পথের অভিজ্ঞতা। যুদ্ধকে সঙ্গী করে মূল্যস্ফীতি ও বিদেশি মুদ্রার চাপে অস্থির হয়ে ওঠা অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। কাজটা যে খুব বেশি সহজ নয় সেটাও মানছেন তারা।

যুদ্ধ না থামলে অর্থনীতিতে এ ঝঞ্ঝাট কবে কাটবে, আগামী বছরও এ উত্তাপ কমে আসবে কি না সেই ভরসার কথা যদিও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না কেউ। অর্থনীতিতে এ চাপ আরও বেশ কিছু সময় থাকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এই নির্বাহী পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না বাড়া পর্যন্ত সরকারকে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিদেশি খরচ কমাতে হবে। যতদিন না বাণিজ্য ঘাটতি একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আসছে, ততদিন অর্থনীতিতে এই চাপ থাকবে।’’

সরকার, মন্ত্রীসহ অন্যান্য নীতি নির্ধারক ও বাংলাদেশ ব্যাংক যদিও আশ্বস্ত করে বলছে, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপনের কৌশল নিয়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি উৎপাদান বাড়ানো।

সার্বিক বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি দল কাজ করছে। শিগগির তারা এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করবে।

যুদ্ধ জেরবার ডলার আর রিজার্ভ

আমদানি চাপ বাড়ছিল ২০২১ সালের অগাস্ট থেকেই। পরের দিকে রপ্তানি বেড়ে রেকর্ড হলেও তা আমদানির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না। প্রবাসীদের পাঠানো আয়েও তা পূরণ হচ্ছিল না।

ওই বছর শেষে নতুন বছরে পরিস্থিতি বদলাবে এমন আশার মধ্যেই ২০২২ সালের দ্বিতীয় মাসেই যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেইন সীমান্তে। পরের মাসেই দুই দেশে যুদ্ধে জড়ালে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারসহ সর্বত্র।

হু হু করে বাড়তে থাকে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম; আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পড়ে হেঁচকা টান।

সরবরাহ সংকটে প্রধান বিদেশি মুদ্রা ডলারের বাজারে তৈরি হয় অস্থিরতা; পরিস্থিতি সামলাতে রিজার্ভ থেকে দেদারসে যোগান দেওয়া হয় ডলারের। উত্তাপ তবুও বাড়তে থাকলে টাকার মান কমিয়ে স্থিতিশীল করার চেষ্টাও চলে।

নানা কৌশল কাজ না করায় শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, যে পদক্ষেপের কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন অনেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ।

Also Read: খোলা বাজারেও ডলার পেতে হিমশিম, দাম বেড়ে ১১৯ টাকা

এসবের মধ্যে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন শেষে প্রতিডলারের বিনিময় হার ছাড়িয়েছে ১০৫ টাকা, রেমিটেন্সে ১০৭ টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি শেষে যা অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল ৮৬ টাকায়। সংকটের মধ্যে যা ২০২২ সালের অগাস্টে ৯৫ টাকা এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রথমবারের মত ১১৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দর ছাড়িয়েছিল ১২১ টাকা।

আমদানি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কড়াকড়ির মধ্যে ৪৬ বিলিয়ন ডলার নিয়ে শুরু করা ২০২২ সালে রিজার্ভ শেষ মাসে নেমে আসে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। শুধু শেষ পাঁচ মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে ছয় বিলিয়ন ডলার।

ডলার সাশ্রয়ে একের পর উদ্যোগের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি বাঁচাতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে ফিরিয়ে আনা হয় ভুলতে বসা লোড শেডিংয়কে। এতে আবার শিল্পোৎপাদন বিঘ্নিত হয়ে অর্থনীতিতে ভিন্ন চাপ তৈরি করে। কম গুরুত্বের প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেও অর্থ সাশ্রয়ের পথে হাঁটে সরকার।

চাপ কমবে কবে?

বছরের মাঝামাঝিতে চরমে ওঠা বৈদেশিক মুদ্রার এ চাপ অব্যাহত থাকায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিধারা রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে বলে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার কথাও বলছেন নীতি নির্ধারকরা।

অর্থনীতিতে জেঁকে বসা এ চাপের জন্য সরকার পুরো দায় যুদ্ধের উপর চাপালেও সময়ে সময়ে অর্থনীতিবিদরা যুদ্ধের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করার কথা বলেছেন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, দিয়েছেন নানা পরামর্শও।

মূল্যস্ফীতির পারদের চাপ টেনে ধরতে রেপো হার বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার আমদানি বাড়িয়ে, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করে, শুল্ক ও কর কমিয়ে পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়ে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখার চেষ্টা করেছে বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই।

বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে হুণ্ডি কমিয়ে বৈধ পথে প্রবাসীদের আয় আনতে প্রণোদনা বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে, শর্ত আর কাগজপত্রের কড়াকড়িও কমিয়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতির এসব চাপ সামাল দিতে ধারাবাহিক উদ্যোগের মধ্য দিয়েই গেছে ২০২২ সালের পুরোটা সময়। এর আঁচ নতুন বছরে আরও কমাতে এখন মনোযোগ সরকারের। এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ঠিক রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংকট উতরাতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার ছক কষার কাজ শুরু হয়েছে। এর নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।

কোভিড মহামারি ও ২০২২ সালের অস্থিরতা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা সেই প্রয়াসে শক্তি যোগাবে; ধাক্কা সামলে ২০২৩ সালের অর্থনীতি গতিশীল হবে বলে মনে করছে সরকার।

এর পেছনে সাহস জোগাচ্ছে বছরের শুরুতেই আইএমএফ, এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণ ছাড়ের প্রতিশ্রুতি। বিদেশি মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতাও কমাবে এসব অর্থায়ন বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

একই সঙ্গে বিলাসপণ্য কমিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ির সুফল মিলবে যা বাণিজ্য ঘাটতি এবং বিদেশি লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতিতে অনেকটাই ভারসাম্য আনবে।

স্বস্তি রাজস্ব ও এফডিআইয়ে

অর্থনীতিতে অস্থিরতার মধ্যেও প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশের উপরে; মোট ৬৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তবে অর্থনীতিবিদরা জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের এ হার অনেক কম বলে তা বাড়াতে আরও জোরালো পদক্ষেপ চান এনবিআরের।

বিদায়ী বছরে বেড়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগও। ২০২১ সাল শেষে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) স্থিতি ছিল ৩৮৮ কোটি ৩২ লাখ ডলারের। ২০২২ সালের জুনে তা বেড়ে সাড়ে ৪৬৩ কোটি এবং অক্টোবরে আরও বেড়ে হয়েছে ৬১৮ কোটি ডলার।

অর্থনীতিতে ঝঞ্ঝা এবং বিদেশি মুদ্রার এ টানাপড়েনের সময়ে বিদেশি বিনিয়োগাকারীদের আগ্রহকে স্বস্তি হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

মূল্যস্ফীতির চাপ

যুদ্ধের আঁচ দেশের বাজারে পড়তে শুরু করে কয়েক মাসের মধ্যেই। রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে যা আরও কাবু করে ফেলে সীমিত আয়ের মানুষজনকে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আর টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানির খরচ আরও বেড়ে যায়।

এরমধ্যে খরচ যতটা বেড়েছে, সংকটের সুযোগ নিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি সুযোগ নিয়ে অতি মুনাফার অভিযোগ উঠে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এতে করে বাজারে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় প্রায় সবাইকেই।

Also Read: অগাস্ট-সেপ্টেম্বর দু’মাসেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি

Also Read: মূল্যস্ফীতি: শহরের চেয়ে গ্রাম ভুগছে বেশি

Also Read: ঋণ সীমায় হাত না দিয়ে রেপোর কৌশল, মূল্যস্ফীতি বশে আসবে?

ফেব্রুয়ারি শেষে ঊর্ধ্বমুখী হওয়া মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকে মে থেকে। ওই মাস শেষে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে তা অগাস্টে ৯.৫২ শতাংশে উঠে- যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরের পর তা কিছুটা করে কমছে; নভেম্বর শেষে হয়েছে ৮.৮৫ শতাংশ। যদিও সরকারি এ হিসাব বাস্তবের মূল্যস্ফীতির চাপের চেয়ে অনেক কম বলে দাবি করে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।

নজিরবিহীন বাণিজ্য ঘাটতি

আমদানিতে জানুয়ারিতে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি হয় ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার এবং খোলা হয় সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলেও একই প্রবণতা থাকলে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পদক্ষেপ আসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।

আগের ধারাবাহিকতায় পরের কয়েক মাসে আমদানি বাড়লেও নভেম্বরে এসে নিয়ন্ত্রণের ফল মিলতে শুরু করে- এলসি খোলা ৪ বিলিয়ন ও নিষ্পত্তি ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এসময়কালেই বাণিজ্য ঘাটতি ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যায়।

Also Read: লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে আরও

Also Read: জুলাই-সেপ্টেম্বর: বাণিজ্য ঘাটতি ১১.৪১% বেড়ে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

Also Read: ২০২১-২২ অর্থবছর: ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি

বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি এবং বৈদেশিক আয় সেভাবে না বাড়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) চলতি হিসাবের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ৩৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

রপ্তানিতে আশার হাতছানি

আরও খারাপ সময় আসছে এমন সতর্কতার মধ্যেই রপ্তানিতে সুখবর আসে নভেম্বর শেষে। প্রথমবারের মত দেশের ইতিহাসে একক মাসে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়ে ৫০৯ কোটি ডলার হয়।

Also Read: ধাক্কা সামলে নভেম্বরে ৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে রপ্তানি

নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি কাটিয়ে ওই মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ২৬ শতাংশ। আর পঞ্জিকা বছরের মাঝামাঝিতে জুন শেষে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে শুধু পণ্য রপ্তানি প্রথমবারের মত ৫০ বিলিয়নের ঘর ছাড়ায়।

রেমিটেন্স বাড়ানোর প্রচেষ্টা

রেমিটেন্সের জন্য ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়িয়ে নির্ধারণসহ প্রণোদনা বাড়ানো এবং কাগজপত্রের কড়াকড়ি সহজ করার ফল পাওয়া যায় জুলাইতে এসে। কমার প্রবণতা কাটিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করে প্রবাসীদের পাঠানো আয়।

চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৮৭৯ কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তা ২ শতাংশ বেশি।

আলোচনায় আইএমএফের ঋণ

চলতি হিসাবে ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ঢাকায় নয় দিনের আলোচনা শেষে প্রাথমিক সমঝোতার ঘোষণা দেয় আইএমএফ ও বাংলাদেশ।

Also Read: আইএমএফের ঋণ: দুয়ার খুলবে আরও বিদেশি অর্থায়নের

Also Read: ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে আইএমএফ, প্রাথমিক সমঝোতা

এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে, আর্থিক খাতে সংস্কারও শুরুর কথা জানায় সরকার। আরও বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারের বিষয়গুলোও সামনে এসেছে এসময়কালে। এ ঋণ পেলে তা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে বলেও মনে করছেন সবাই।

পড়ছে পুঁজিবাজারও, ‘কেলেঙ্কারিতে’ নাম সাকিবের

অর্থনীতির খারাপ সময়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে পুঁজিবাজারও। বছরের একটা সময় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলেও টানা দরপতনেই কেটেছে বেশির ভাগ সময়। এরমধ্যে দ্বিতীয়বারের মত ফিরে আসে শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়ার সীমা ‘ফ্লোর প্রাইস’।

উত্থান পতনের মধ্যে বছরের বেশ কিছু সময়ে শেয়ার কারসাজি ও জরিমানার ঘটনাও আলোচনা তৈরি করে। এরমধ্যে শেয়ার কারসাজির ঘটনায় আলোচিত আবুল খায়ের হিরু ও তার মালিকানায় থাকা কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িয়ে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের নামও উঠে আসে।

সংকটেও বেড়েছে বেসরকারি ঋণ

চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ কমিয়ে আনার উদ্যোগ বছরের শুরু থেকেই দেখা গিয়েছে। এজন্য মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে ধার দিতে রেপো সুদহার বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অগাস্টে সর্বোচ্চ বেড়ে হয় ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। পুরো বছরই ছিল ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে।

এর ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, আমদানি অর্থায়ন বেড়ে যাওয়ায় ঋণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। এক মাস আগে যা ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

গুজবে ব্যাংকের আমানতে হাত

বছরের শেষ সময়ে এসে নানা গুজবের মধ্যে ব্যাংক আর টাকা দিতে পারবে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন গুজবের মধ্যে কয়েকটি শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ অনিয়মের তথ্য সংবাদ মাধ্যমে এলে তা সাধারণের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করে। অনেকেই ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলা শুরু করেন।

এতে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে নতুন করে অর্থ যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। এ নিয়ে কথা বলতে হয় সরকারপ্রধানকেও। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে ঘরে টাকা রেখে চোরের সুবিধা করে দেওয়ার বদলে ব্যাংকে নিরাপদে টাকা রাখার বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেন।

পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মাহেন্দ্রক্ষণ

এডিপি বাস্তবায়নে বরাবরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গতি কম থাকলেও প্রথমে পদ্মা সেতু এবং বছরের শেষ দিকে মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন বাস্তব রূপ পাওয়ার উচ্ছ্বাস ছিল সবার মধ্যেই।

বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষের জটও অনেকটা কেটেছে এ বছর, যা বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে সরকার।

মেগাপ্রকল্প চালুর এখানেই শেষ নয়। নতুন বছরে চট্টগ্রামে খুলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্ণফুলী টানেল। শেষ হবে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ কাজও। ঢাকায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাওয়া যাবে মেট্রোরেলে।

বছরের মাঝামাঝি ২৫ জুন এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতুর সেদিন দ্বার খোলে সেদিন।

এসব মাইলফলক প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বাসের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিছুটা গতি হারিয়েছে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। সাশ্রয় ও কৃচ্ছতা সাধনের সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাবধান হয়েছে সরকার। এর প্রভাব দেখা গেছে এডিপি বাস্তবায়নে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৪৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা।

Also Read: এক নজরে পদ্মা সেতু

Also Read: পদ্মা সেতু: স্বপ্ন থেকে বাস্তবের পথরেখা

Also Read: একটি সেতু, খুলবে নতুন যুগের দুয়ার

Also Read: বছর শেষে খোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল