৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে আইএমএফ, প্রাথমিক সমঝোতা

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, “যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আইএমএফের ঋণ পেতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় শর্ত তারা দিয়েছে, সেগুলো আমরা নিজেরাই শুরু করছিলাম।"

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2022, 09:41 AM
Updated : 9 Nov 2022, 09:41 AM

ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ এর কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ।

আগামী ফেব্রুয়ারিতেই এ ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যেতে পারে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বুধবার বলেছেন, “যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে আইএমএফের ঋণ পেতে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় শর্ত তারা দিয়েছে, সেগুলো আমরা নিজেরাই শুরু করছিলাম।"

বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানান, এই সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার আইএমএফ বাংলাদেশকে দেবে সাত কিস্তিতে। শেষ কিস্তি বাংলাদেশ হাতে পাবে ২০২৬ সালে। সুদের হার হবে ২.২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকায় দুই সপ্তাহের সফর এবং আলোচনার ফলাফল তুলে ধরতে সচিবালয়ে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে আসেন আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নেতা এবং সংস্থার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ।

ঋণের বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমএফের নির্বাহী পরিষদে উপস্থাপন করবেন। সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে আইএমএফ বোর্ড এ ঋণ প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পারে।

এ সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়, ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেওয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ( ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে ৩২০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাবে বাকি ১৩০ কোটি ডলার।

এ ঋণের অর্থ দিয়ে যেসব প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার হাতে নেবে, তার উদ্দেশ্য হবে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্দশায় পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিয়ে দৃঢ়, অর্ন্তভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি কমিয়ে আনতেও এই ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে।

কোভিড মহামারীর ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় ধরনের চাপে পড়েছে; ডলারের বিপরীতে মান হারিয়ে চলছে টাকা, মূল্যস্ফীতিও পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে।

রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানায় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে; জ্বালানি সংকটের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতেই গত জুলাই মাসে আইএমএফ এর কাছে ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রাথমিক সম্মতি জানানোর পর শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফ প্রতিনিধিরা অক্টোবরের শেষে ঢাকায় আসেন। গত দুই সপ্তাহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অংশীজনদের সঙ্গে তারা ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে রাহুল আনন্দ বলেন, “২০৩১ সালের মধ্যে সফলভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে অতীতের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধির চাকাকে আরও গতিশীল করার জন্য কাঠামোগত সমস্যাগুলোতে নজর দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ, উৎপাদন সুসংহত করা এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তুলতে হবে। 

“এই বাস্তবতায় এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় নেওয়া আগের উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিতায় বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ এর সহযোগিতায় বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা সাজিয়েছে, যা ঝুঁকি কমিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত করবে এবং সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমনের কাজ ত্বরান্বিত করে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে।”

আইএমএফ বলছে, আর্থিক খাতে আরও বেশি সুযোগ তৈরি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতির কাঠামোগত পরিবর্তন, আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করা, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অংশ।

Also Read: আইএমএফ টাকা না দিলে রসাতলে যাব না: বাণিজ্যমন্ত্রী

Also Read: ঋণ আমরা নেব, কঠিন শর্তে নয়: ওবায়দুল কাদের

Also Read: আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ নিয়ে ওয়াশিংটনে গভর্নরের আলোচনা

সেজন্য বাংলাদেশকে ঠিক কী কী শর্ত মানতে হবে তা কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে অর্থমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদী ঋণ কর্মসূচি নিতে যাচ্ছি।”

আইএমএফ-এর এই ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে চারটি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে।  

সেগুলো হল– অর্থনীতির বহিঃখাতকে স্থিতিশীল করা; ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেওয়া; আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।

যে সংস্কার কার্যক্রমের কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত প্রায় ১৪ বছর যাবত আমরা করে আসছি। আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতি-কে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫.১ শতাংশ যা এই অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ ধরা আছে।

“স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মত সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা হবে, যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে আমাদের বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭%।”

আর্থিক খাতের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ নতুন কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরোনো কয়েকটি আইন ‘সংশোধনের’ কাজ ত্বরান্বিত করাও হবে এই সংস্কার কার্যক্রমের অংশ।

অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এর তুলনায় কর আহরণ হার ১০ শতাংশের ঘরে। এ হার বাড়াতে অনেক আগে থেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ।

এ বিষয়ে সেরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, “রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হবে। ভ্যাট আদায়ের জন্য আমরা ইএফডি মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এযাবৎ ৬,৭৩২টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। আগামী বছরে আরো ৬০ হাজার মেশিন স্থাপন করা হবে এবং পরবর্তী ৪ বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার মেশিন স্থাপিত হবে।”

বিদ্যুৎ ও সারের মত খাতে সরকারকে ভর্তুকির পথ থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। ঋণ পেতে কোন কোন খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার হচ্ছে প্রশ্ন করলে উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা, যাতে সামনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলে দেশের অভ্যন্তরেও তা একইভাবে কমানো যায়। এটি করা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে এটি নিয়মিত করা হবে।’’

টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটিও ধীরে ধীরে বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার কথা সংস্কারের তালিকায় রয়েছে। সে কাজও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ‘শুরু করেছে’ বলে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য।

কর ছাড় ও অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে মুস্তফা কামাল বলেন, “দুটোই আমাদের দেওয়া লাগবে তাদের। তাদের বাঁচতে দিতে হবে।”

সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ; দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে একটি দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের পরিকল্পনা করার কথাও বলা হয়েছে সরকারের বিবৃতিতে।  

পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা সুযোগ দিয়েছি ফিরিয়ে আনতে। এজন্য কিছু কর দিতে হবে।”

আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “অতীতে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে সেই সংস্কারের বিষয়গুলো আগেই আলোচিত হয়েছে। সেগুলো একটি প্যাকেজ আকারে এক জায়গায় করা হয়েছে। সেই সংস্কারে তারা (আইএমএফ) সহায়তা করবে।”