“নানা কারণে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এটা সত্য। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরে ৩৯৩টি নতুন কারখানা রপ্তানিমুখী উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে,” বলেন তিনি।
Published : 04 Apr 2024, 06:53 PM
নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেও গত তিন বছরে পোশাক খাতে নতুন করে ৩৯৩টি কারখানা রপ্তানিমুখী উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর বিদায়ী সভাপতি ফারুক হাসান।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠনটির নেতা হিসেবে নিজের দায়িত্বের তিন বছরে বিভিন্ন অগ্রগতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, “নানা কারণে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এটা সত্য। কিন্তু আমরা বিজিএমইএর দায়িত্ব নেওয়ার পর দিন থেকে, অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ২০২১ থেকে আজ পর্যন্ত ৩৯৩টি নতুন কারখানা বিজিএমইএর সদস্য পদ গ্রহণ করেছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রেরণা।”
বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবে নিজের মেয়াদ শেষে বৃহস্পতিবার উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে কথা বলেন ফারুক। নতুন সভাপতি এসএম মান্নান কচির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
ফারুক হাসান বলেন, “আজকে আপনাদের সঙ্গে এই সভাটি বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবে আমার শেষ সভা। যদিও এই শিল্প বা ভিন্ন অনেক উপলক্ষে আপনাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে ও কথা হবে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বিজিএমইএর দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে আমি আপনাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেছি।”
কোভিড মহামারীর নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবে রুবানা হকের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক। দুই বছর মেয়াদী পরিচালনা পর্ষদে দুই ধাপে ছয় মাস করে এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৪ সালের এপ্রিলে এসে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। ঈদের আগেই ৭ এপ্রিল নতুন সভাপতি এসএম মান্নান কচির কাছে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
‘রপ্তানিতে মাইলফলক’
চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝিতে পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে জানান ফারুক হাসান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর আগে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামগ্রিক রপ্তানি আয় ছিল ৪০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পোশাক রপ্তানির শেয়ার ছিল ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ। সে বছরটিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেড়েছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় আমাদের পোশাক রপ্তানি নেমে আসে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা প্রায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট রপ্তানিতে পোশাকের শেয়ার পৌঁছেছে ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সবশেষ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এই শেয়ার ৮৫ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে এবং এ সময়টিতে আমাদের অর্জিত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২০২৪ ক্যালেন্ডার বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে পোশাক রপ্তানি ছিল ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ দশমিক ২৪ শতাংশ।
ফারুক হাসান বলেন, “২০২১ সালের এপ্রিল মাসে আমি ও আমার বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর এপ্রিল ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ এই এক বছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ৩৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিল-মার্চ ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি পৌঁছে ৪৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে, আর এপ্রিল-মার্চ ২০২৩-২৪ সালে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার।
“এর মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রতিটি মাসে এর আগে যেকোনো বছরের একই মাসের তুলনায় সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা একক মাস হিসেবে এ যাবত সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের মাস। আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ হল, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ আমাদের পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে।”
নতুন বাজার
নতুন বাজারগুলোতে রপ্তানি বাড়ার তথ্য দিয়ে বিদায়ী সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, নতুন বাজারে গত ১৪ বছরে রপ্তানি ১০ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ ৮৪৯ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষ করে তুরষ্কে ৬৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, সৌদি আরবে ৪৭ দশমিক ১৯ শতাংশ, চীনে ৪৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, রাশিয়ায় ২৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অষ্ট্রেলিয়ায় ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এসেছে। বর্তমান সংকটময় সময়ে নতুন বাজারে প্রবৃদ্ধি রপ্তানিতে ‘কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে’ বলে বিদায়ী সভাপতির ভাষ্য।
নন-কটন পোশাকের সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থ বছরের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৪ শতাংশ ছিল কটনের তৈরি, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ নন-কটন খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ছে। সঠিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে নন-কটন খাতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
“এর বাইরে, আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র যেমন- মসলিন, জামদানি, সিল্ক, খাদি ব্যবহার করে রপ্তানি পণ্য তৈরির বিষয়ে বেশকিছু সফল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। এসব পোশাক আমরা ইতোমধ্যে জার্মানি ও অষ্ট্রেলিয়ায় প্রদর্শন করেছি। এসব পণ্য ও কাঁচামালের যোগান আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে, যা ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বারা উন্মোচন হতে পারে।”
আমদানি নির্ভর পোশাক খাত ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন সক্ষমতা থেকে এখন ৭০ শতাংশ অতিক্রম করছে বলে তথ্য দেন বিদায়ী সভাপতি।
২০২৬ সালের পর এলডিসি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হলে স্থানীয় উৎপাদন ডাবল ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “তখন জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে ফেব্রিক্স এবং সেলাই দুটোই স্থানীয় পর্যায়ে হতে হবে। সেজন্য দেশে বস্ত্রকল খাতে প্রচুর বিনিয়োগ এখনই করতে হবে।
“স্থানীয় পর্যায়ে শিল্পের মূল্য সংযোজন সক্ষমতা বেড়েছে, যার ফলে একদিকে আমাদের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ছে, ক্রেতাদেরকে আমরা পূর্ণাঙ্গ (ফুল প্যাকেজ) অফার করতে পারছি, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) স্থানীয় মূল্য সংযোজন ৭১ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৭০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মহামারীর আগের অর্থবছর ২০১৮-১৯ সালে স্থানীয় মূল্য সংযোজন ছিল ৬৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।”
গ্রিন কারখানা
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সবুজ শিল্পায়নে অগ্রগতি চলমান রয়েছে জানিয়ে ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশে লিড সনদপ্রাপ্ত গ্রিন কারখানার সংখ্যা বেড়ে ২১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রিন কারখানার সংখ্যা ছিল ১২৮টি, গত তিন বছর ৩ মাসে নতুন ৮৬টি কারখানা যোগ হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫টি প্লাটিনাম, ৩৮টি গোল্ড, একটি সিলভার ও দুটি সাধারণ সার্টিফায়েড মানের।
শুধু ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত মোট আটটি পোশাক কারখানা লিড সনদ পেয়েছে, যার মধ্যে চারটিই ছিল প্লাটিনাম, আর চারটি গোল্ড সনদ প্রাপ্ত। এর মধ্যে একটি বিশ্বের প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বিশ্বে ‘শীর্ষ দুটি কারখানাই’ বাংলাদেশের।
বিশ্বের সর্বোচ্চ স্কোর এর ২৩টি লিড সার্টিফায়েড স্থাপনার মধ্যে ২১টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। আর বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার নয়টিই বাংলাদেশে অবস্থিত। এ অর্জন জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত করে।
সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর নতুন নেতৃত্বের মধ্যে পরিচালক আব্দুল্লা হিল রাকিব, নুসরাত বারি আশা, শোভন ইসলামসহ উপস্থিত ছিলেন।