“দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা একটু দুর্বল হয়ে গেছে, যা এক সময়ে প্রশংসিত ছিল,” বলছেন মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস।
Published : 04 Dec 2022, 02:28 AM
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হিসেবে সরকারের তরফ থেকে বার বার ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলা হলেও এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এই সম্মানীয় ফেলো বলছেন, যুদ্ধের প্রভাব ‘একটি অংশ মাত্র’, পুরোটা নয়।
“আমাদের অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাও দায়ী। অভ্যন্তরীণ সম্পদের সরবরাহে সমস্যা ছিলই। এ কারণে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ছে না। জ্বালানি নীতি ঠিক করা হয়নি। মেগা প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে পরিশোধ করব, তা দেশের উপর কোন ধরনের চাপ তৈরি করছে, তা নিয়ে কোনো প্রভাব মূল্যায়ন দেখা যায়নি।
“এসব তো আগে থেকেই ছিল। আমাদের এসব বিষয় উপেক্ষা করা উচিত নয়।”
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি যে চাপের মুখে রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসও তা মানছেন।
তিনি বলেন, “দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা একটু দুর্বল হয়ে গেছে, যা এক সময়ে প্রশংসিত ছিল। দুর্বল হওয়ার বিস্তারিত তথ্য আমার কাছে আছে। কেন এমন হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।’’
রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনে কথা বলছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও আহমদ কায়কাউস।
গুলশানের হোটেল লেকশোরে শনিবার শেষ হওয়া তিন দিনের এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। দেশি বিদেশি অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
মহামারীর আগে-পরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কোন ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেই আলোচনা গুরুত্ব পায় এবারের সম্মেলনে। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি তেলের দাম, ব্যাংক খাতের নৈরাজ্য, বিদ্যুতে ভুর্তকি, কর আদায় কম হওয়ার মত সমস্যার কথাও আলোচকদের বক্তব্যে আসে, যার কিছু কিছু মহামারীর আগে থেকেই ছিল।
দেবপ্রিয় বলেন, যুদ্ধই যদি একমাত্র কারণ হত তাহলে ‘সব দেশই’ বাংলাদেশের মত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেত।
“যুদ্ধের প্রভাব একেক দেশে একেক রকম হয়েছে। যে যার সক্ষমতা অনুযায়ী তা সামাল দিতে পেরেছে।”
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, “দুশ্চিন্তা আছে আমাদের বৈদেশিক খাত নিয়েও। বৈদেশিক দায় পরিশোধ করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদের যোগান যদি সঠিক হত, তাহলে এ সমস্যা হত না। এ কারণেই রিজার্ভে টান পড়েছে।”
এজন্য তার পরামর্শ হল, সমসাময়িক সমস্যার সঙ্গে আগের সমস্যার সমাধান করতে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া।
সরকার সমন্বিত পরিকল্পনাই নিচ্ছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খান বলেন, প্রতিটি প্রকল্প নেওয়ার সময়ে এর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
“আমরা একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করছি, যাতে সব সমস্যাকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য থাকে। বৈদেশিক ঋণ এখনো জিডিপির সহনীয় অনুপাতেই রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে।”
সমষ্টিক অর্থনীতিতে আস্থার সঙ্কটের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, “কৃষক আমাদের রক্ষা কবচ। তাদের বাঁচাতে পারলে খাদ্য উৎপাদনে সমস্যা হবে না। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে তথ্য-উপাত্তে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বাজারে সেই ভরসা বা ট্রাস্ট নেই। জনগণকে ভরসায় আনতে হবে।”
কৃষি অর্থনীতিবিদ আব্দুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, আগামী এপ্রিল পর্যন্ত কৃষিকাজে সেচ দিতে ১৪ লাখ শ্যালো মেশিন, ৫ লাখ ট্রাক্টর ও কম্বাইন হারভেস্টার চালাতে ডিজেল লাগবে।
“কিন্তু ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের পকেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটার সমাধান হওয়া প্রয়োজন।”
ব্যাংক খাতের সুদহার নির্ধারণ, কর ব্যবস্থার সংস্কার, সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিনিময় হার যথাযথ করা, দুর্নীতি, আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি, আস্থার সঙ্কট, বৈধপথে রেমিটেন্স বাড়ানো, সরকারের রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সংযোগ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয় বাড়ানোর কথা আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে।
তৈরি পোশাক খাতে কর ও শুল্ক অব্যাহতির সমালোচনা করে অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে দর কমলেও সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি কমাবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফ শর্ত দিলে ঠিকই কমাবে।”
এসময় অর্থনীতিবিদ জায়েদী সাত্তার বলেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও রপ্তানি খাতে কতোটুকু ছাড় দেওয়া হবে তা নির্ধারণের সময় হয়েছে, সেজন্য কর ও বাণিজ্য নীতি হওয়া উচিত।
শরিফা খান বলেন, আইএমএফ বাংলাদেশকে দুটি ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কর অব্যাহতি দেওয়া বিষয়ে।
“একদিকে কর অব্যহতি দেওয়া হচ্ছে, আবার বলা হচ্ছে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ বাড়ছে না। এটা একটা ডিলেমা। আইএমএফ এ বিষয়ে প্রেসক্রিপশন দিয়েছে।
“আরেকটি প্রেসক্রিপশন হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক দর না থাকা। এটি ইতোমধ্যে বাজারের উপর ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখন নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।’’
গত সেপ্টম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাফেদার (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন) ওপর ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এখনো আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও নগদে ডলার লেনদেন হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দরে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দরের মধ্যে পার্থক্য থাকছে ১১ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, এই বিনিময় হারের একাধিক দরের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার আগে এই ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ এক টাকা।
ডলারের একাধিক দরের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, “একই রেমিট্যান্স সবার কাছেই সমান মূল্য রাখে। তাই একাধিক দর থাকাটা কতোটুকু যৌক্তিক?’’
এ সময় তিনি সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো জনগণকে জানানোর আহ্বান জানান রাষ্ট্রের সংস্থা ও দপ্তরগুলোকে।
মহামারীর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়েই নানা জটিলতা তৈরি করছে। রিজার্ভ, প্রবাসী আয়সহ অন্যান্য সূচক মিলিয়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা ছিল, তা এখন অনেকটা নড়বড়ে। তার ওপরে বাড়তে থাকা জীবনযাত্রার খরচ সাধারণ মানুষকে আরও সঙ্কটে ফেলছে, বাড়াচ্ছে বৈষম্য।
শরিফা খান বলেন, “মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে আমরা কর্মসংস্থান বাড়াতে অগ্রাধিকারে থাকা প্রকল্পের বৈদেশিক অর্থ ছাড় করতে দ্বিগুণ চেষ্টা করছি। সাড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার আমাদের পাইলাইনে রয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘‘ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়া এখন ঠিক হবে না। এটা হয়ত তুলে দিতে হবে, কিন্তু তা হতে হবে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে, একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।”
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা তাত্ত্বিক কোনো উপায়ে সমাধান নিয়ে কাজ করছি না। প্রথাগত চিন্তার বাইরে কাজ করছি। আমরা কর আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভর্তুকি দিচ্ছি। বিদ্যুত খাতের ভর্তুকিকে ওভাবে দেখলে হবে না।’’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দীন সম্মেলনে বলেন, “বেশি দামে হলেও শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ চাই। নইলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বার্তা যাবে বাংলাদেশ যথাসময়ে পণ্য দিতে পারবে না।”