স্বল্প আয়তনের বাংলাদেশ যেখানে জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ; যেখানে নগরায়ন, শিল্পায়নসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই ফসলের জমি ও নিচু জমি কমছে— সেখানে ব্যক্তির সম্পদ, বিশেষ করে জমির মালিকানা অর্জনের সীমা ঠিক করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
Published : 02 Jul 2024, 07:23 PM
নাগরিক কতটুকু ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন করতে পারবেন, রাষ্ট্র তার সীমারেখা ঠিক করে দেবে কি না; টাকা থাকলেই যে কেউ নিজের ইচ্ছেমতো জমির মালিক হতে পারবেন কি না— এই তর্কটি শুধু আজকের নয়, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদেও উঠেছিল। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কার্যকর করতে ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জনের সীমারেখা ঠিক করে দেয়া উচিত হবে কি না; দিলে সেটি ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবে কি না এবং উৎপাদন ব্যাহত হবে কি না; রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে কারও জমি অধিগ্রহণ করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্পষ্ট থাকবে কি না এবং অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের অংক অপ্রতুল বলে কেউ আদালতে যেতে পারবেন কি না— এসব নিয়ে গণপরিষদে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়। যদিও শেষপর্যন্ত ব্যক্তির সম্পত্তি অর্জনের সীমারেখা ঠিক করে না দিয়ে বিষয়টি ভবিষ্যৎ সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তবে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণের বিধান করা হলেও ক্ষতিপূরণের অর্থ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
কী বলেছিলেন ড. কামাল?
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে আইন এবং সংসদীয় বিষয়াবলি ও সংবিধান প্রণয়ন-মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন কমিটির রিপোর্টসহ খসড়া সংবিধান তথা সংবিধান বিল উত্থাপনের পরে যে ভাষণ দেন, সেখানে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে বলেন, ‘সম্পত্তির অধিকার বা ব্যবসা ও বাণিজ্যের অধিকার কোনো কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য ব্যবস্থার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা তাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। এইজন্য আমরা বলেছি যে, আইন-সাপেক্ষে এই সব অধিকার ভোগ করা হবে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন মনে করলে সংসদ এইসব অধিকার হরণ করতে বা সীমাবদ্ধ করতে পারবেন। সংসদ যদি সে রকম কোনো আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে আদালত তা নাকচ করতে পারবেন না।’ (গণপরিষদ বিতর্ক, মো. আব্দুল হালিম, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৭৫)।
৩০ অক্টোবরের বৈঠকে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘চীনে মালিকানার চার ধরনের বিধান আছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং পুঁজিভিত্তিক মালিকানা। আমরা পুঁজিবাদী মালিকানা-ব্যবস্থা রাখিনি। আমাদের আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানা। এইরকম ব্যবস্থা প্রত্যেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে রয়েছে। যেমন জি. ডি. আর.-এর সংবিধানে রয়েছে। অবশ্য তাতে যে সব কথা বলা হয়েছে, তা ব্যাখ্যার মুখাপেক্ষী। আমাদের মতো তাঁরাও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের সংবিধানে সম্পত্তি নিয়ে নিলে সেজন্য ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান নেই। ১৯৪৭ সালে জি. ডি. আর-এর যে প্রথম সংবিধান ছিল, তাতে এই ক্ষতিপূরণের বিধান দেখা যায়নি। তারপর, ১৯৬৮ সালের সংবিধানে এই বিধান দেখা গেল। প্রথম সংবিধানে আমরা দেখেছি, কোনো কারণ না দর্শিয়ে এবং ক্ষতিপূরণ না দিয়ে সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ এই একুশ বছর এই ব্যবস্থা ছিল। একুশ বছর পরে সেখানে সমাজতন্ত্র যখন বেশ গড়ে উঠেছে, তখন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র কীভাবে অগ্রসর হতে পারে, এই দৃষ্টান্ত থেকে সেই জিনিসটা বোঝা যাচ্ছে।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের হাতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সর্বময় ক্ষমতা থাকে উল্লেখ করে বলেন: ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি না- কিম্বা দেওয়া হলে কী পরিমাণে দেওয়া হবে, তা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে আদালতের কোনো এখতিয়ার থাকে বলে আমরা জানি না। কারণ সম্পত্তি নিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আদালত নাকচ করে দিতে পারেন এবং বলতে পারেন যে, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে সম্পত্তি নিতে পারবে না। আদালতকে এ রকম অধিকার দিলে সমাজতন্ত্র সফল হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে আমরা জোরজবরদস্তি করে কিছুই করতে চাই না। আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। (ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৫০০)।
সিদ্ধান্তের ভার ভবিষ্যৎ সংসদের ওপর ছেড়ে দেন সৈয়দ নজরুল
গণপরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবিধান বিলের ওপর ১৯৭২ সালের ১৯ অক্টোবর যে দীর্ঘ ভাষণ দেন, সেখানে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানা সম্বন্ধে বহু চিন্তা-ভাবনা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ সীমানির্ধারণ সম্ভব হয়নি— এমনকি, সোভিয়েট রাশিয়ার মতো দেশেও তা সম্ভব হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, কোন ব্যক্তির বাড়ি-ঘর, ভূমি ইত্যাদিতে তার বংশের উত্তরাধিকার থাকবে এবং উত্তরাধিকার-সূত্রে তা পাওয়ার যোগ্যতা থাকবে। কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা শাসিত দেশগুলিতেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সীমানির্ধারণ সম্ভব হয়নি, বরঞ্চ বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি লাভ করেছে।’
সৈয়দ নজরুল বলেন, ‘কতখানি সীমার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নির্ধারণ এখন করে দেওয়া উচিত কি উচিত নয়, এ সম্বন্ধে এখানে প্রশ্ন উঠেছে। কাল গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনে যে সংকট দেখা দেবে, তার সঙ্গে আইনপরিষদ-সদস্যরাই তা নির্ধারণ করবেন। এখন তা নির্ধারণ করে দিলে হয়তো কালের পরিক্রমায় এটা outdated হয়ে যেতে পারে। তাই এটা এখানে উল্লেখ না করে ভবিষ্যৎ আইন-প্রণেতাদের কাছে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ (বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, পৃ. ১০৬)।
একশো বিঘার বেশি জমি না রাখা
১৯ অক্টোবরের বৈঠকে কুমিল্লা-২ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আলী আজম বলেন, ‘গণতান্ত্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়-মালিকানা এবং ব্যক্তিগত মালিকানা সম্বন্ধে সংবিধানে এমন বিধান রাখা হয়েছে, যাতে ব্যক্তিগত মালিকানা অবাধ না হয়, তার জন্য আইনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করার ব্যবস্থা আছে। আইন-দ্বারা প্রতিটি বিষয় সীমাবদ্ধ করা যাবে। দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা: গরীব যাতে আরও গরীব না হয়, ধনী যাতে আরও ধনী না হয়, আইনের মাধ্যমে সেটা এমনভাবে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যাবে, যাতে দেশের আপামর জনসাধারণের উপকার করা যায়।’
২৪ অক্টোবরের বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ‘আজ এখানে ব্যাংক বিমা জাতীয়করণ করা হয়েছে। পাট ব্যবসা, পাট শিল্প জাতীয়করণ করা হয়েছে। জমির উচ্চ সীমারেখা ধার্য করে দেওয়া হয়েছে। ভূমিহীন চাষীদের ভূমি দেওয়া হচ্ছে। একশো বিঘার উপরে কেউ জমি রাখতে পারবে না।’
৩০ অক্টোবরের বৈঠকে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশও একশো বিঘার বেশি জমি না রাখার প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলেন, ‘পল্লীর কৃষকের নিকট কেবলমাত্র একশত বিঘা জমি থাকবে। এই এক শত বিঘা জমির মূল্য যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা ধরে নিই, তাহলে দেখা যায়, কৃষকের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা মূল্যের জিনিষ থাকতে পারবে। তারপর যদি পল্লীর কৃষক পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি সম্পদ না রাখতে পারে, তাহলে দেশের কোনো নাগরিকই এই পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশি সম্পত্তি- কোন দোকান, কোন অট্টালিকা রাখতে পারবে না। কাজেই ইসলামের বিধান অনুযায়ী যে সম্পদ রাখা যায়, তা রাখার ব্যবস্থা এই সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই, আমি অত্যন্ত আনন্দের সহিত এই সংবিধানকে সমর্থন করছি।’
সমবায়ের ওপর জোর তাজউদ্দীনের
সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা সকল দেশেই এক। উৎপাদন-যন্ত্র এবং উৎপাদন-ব্যবস্থায় ভূমিসহ সব কিছুর মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত নয়। আমি বলব সমাজের আয়ত্তে, সমাজের মালিকানাধীন থাকবে। এটাই সমাজতন্ত্রের সঠিক সংজ্ঞা। কিন্তু সব রাষ্ট্র আজও ভূমি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারেনি। আজকে পূর্ব জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখুন। তারা বিপ্লবের পরে একশো হেক্টরের উপর জমি বাজেয়াপ্ত করেছে বিনা ক্ষতিপূরণে। তারা একশো হেক্টর পর্যন্ত জমি কৃষকের হাতে রেখে দিয়েছে এবং একশো হেক্টরের উপরে ভূস্বামীর যে জমি ছিল, তা বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে বিলি করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে জমি এত অল্প যে, মাথা প্রতি ভাগ করে দিলে আধা বিঘা করেও পাবে কি না, সন্দেহ। কাজে কাজেই আমাদের দেশের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হবে। তাই এখানে যে সমবায়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেই সমবায়-পদ্ধতিতে ভূমি একত্র করতে হবে।
তাজউদ্দীন বলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানা আজও আমরা উচ্ছেদ করতে পারছি না। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা বা আমাদের পরবর্তীকালে আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী যদি দাবি করে যে, উচ্ছেদ করতে হবে, তাহলে নিশ্চয়ই তা করা হবে। কিন্তু আজকে এখানে বসে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে, এই পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের উপর কোনোরূপ ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট করে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না।’ (গণপরিষদ বিতর্ক, পৃ, ৪৩২)।
ক্ষতিপূরণকে প্রশ্নাতীত রাখার বিধান যুক্ত হয় শওকত আলী খানের প্রস্তাবে
ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া না হলেও রাষ্ট্র যেকোনো সময় যে কারও সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারবে বলে বিধান করা হয় খসড়া সংবিধানে। যদিও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শুরুতে স্পষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় পয়লা নভেম্বরের বৈঠকে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, প্রখ্যাত আইনজ্ঞ শকওত আলী খানের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিনিময়ে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি প্রশ্নাতীত রাখার জন্য ৪২ অনুচ্ছেদে একটি নতুন দফা যুক্ত করার প্রস্তাব আনেন।
শুরুতে ৪২ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’
কিন্তু শওকত আলী খান বলেন: আমাদের সংবিধানে সম্পত্তির তিন রকম মালিকানা দেওয়া হয়েছে। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা, দ্বিতীয়টা সমবায়-মালিকানা, তৃতীয়টা ব্যক্তিগত মালিকানা। ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পত্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানায় রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে এবং সেই পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এখানে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, সে কথা বলা হয় নাই। কেননা রাষ্ট্র যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে ক্ষতিপূরণ ছাড়াও সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র জনগণের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্র জাতীয়করণ করতে পারে সম্পত্তির মালিকের অনুমতি ছাড়াই। এ রকম একটা ঘটনা ভারতে ঘটেছিল এবং সে নিয়ে ভারতীয় হাইকোর্টে একটা আপিল হয়েছিল। ভারতীয় হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছিল যে, এটা করা যাবে।
তিনি ডেপুটি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে যদি কোনো সম্পত্তি নেওয়ার কারণ উদ্ভূত হয়, তাহলে সে সম্পত্তি নেওয়া যাবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে চাই, আদমজী জুটমিল যখন স্থাপিত হয়েছিল, তখন হয়তো ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। সেটার জন্যে যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাহলে হয়তো ৫০ কোটি টাকা বেশি দিতে হবে এবং সে টাকা দিতে হবে ট্যাক্সের মাধ্যমে। ট্যাক্সের মাধ্যমে না দিলে নোট ছাপিয়ে দিতে হবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। যেকোনো উপায়েই দিন না কেন, জনসাধারণের অসুবিধা হবে।
এমতাবস্থায় তিনি এই অনুচ্ছেদে একটি নতুন দফা যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। সেটি এরকম:
(২) এই অনুচ্ছেদের (১) দফার অধীন প্রণীত আইনে ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখলের বিধান করা হইবে এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ কিংবা ক্ষতিপূরণ নির্ণয় ও প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি নির্দিষ্ট করা হইবে; তবে অনুরূপ কোনো আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান অপর্যাপ্ত হইয়াছে বলিয়া সেই আইন সম্পর্কে কোনো আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এ ধরনের বিধান রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাই সংশোধনী-প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য। এটা গ্রহণ করা যেতে পারে।
আসাদুজ্জামান খানের নোট অব ডিসেন্ট
তবে এ নিয়ে বিতর্ক এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এই ইস্যুতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান খানের অবস্থান ছিল ভিন্ন। তিনি শওকত আলী খানের প্রস্তাবিত এই দফার বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কিংবা ক্ষতিপূরণের অর্থকে আনচ্যালেঞ্জড রাখার বিরোধী ছিলেন। যে কারণে তিনি এরকম একটি দফা যুক্ত করে সংবিধান অনুমোদনের পক্ষে ভোট দিলেও মতানৈক্যমূলক বক্তব্য বা ভিন্নমতসূচক আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কমিটির যে ছয়জন সদস্য সংবিধান বিলের ওপর নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন, আসাদুজ্জামান খান তাদের অন্যতম। নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী বাকি পাঁচ সদস্য হলেন হাফেজ হাবীবুর রহমান, এ কে মুশাররফ হোসেন আকন্দ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল।
আসাদুজ্জামান খান খসড়া সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে বলেন: যতটুকু সম্পত্তি আইনগতভাবে কোনো নাগরিক মালিকানায় রাখতে পারবে, তার চেয়ে অল্প কিছু বেশি সম্পত্তি থাকলে তা রাষ্ট্র কর্তৃক অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সংবিধানে এই নিশ্চয়তা থাকতে হবে যে, জনস্বার্থে ছাড়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইনানুগ ব্যতীত এটি করা হবে না। এই নিশ্চয়তা খুব প্রয়োজন। কারণ, সংবিধান নাগরিকদের কাজ করার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বৃদ্ধ বয়সে ভরণপোষণের অধিকার বা অসুস্থতা ও ডিজঅ্যাবিলিটির ক্ষেত্রে সাহায্য পাওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়নি, যা সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে দেওয়া হয় এবং তার ও তার পরিবারের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টি এখানে নাগরিকদের নিজস্ব সক্ষমতা ও সম্পত্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন, ভোগ এবং হস্তান্তর করা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এসব সংবিধানে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে জনস্বার্থ ছাড়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করার কোনো আইন ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্র নিতে পারবে না। সমাজতান্ত্রিক দেশেও, যত অল্প পরিসীমাতেই হোক না কেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে সংবিধান দ্বারা রক্ষা করা হয়। গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক যেকোনো দেশেই হোক, সংবিধান এই নিশ্চয়তা দেয় যেকোনো ব্যক্তির সম্পত্তি জনস্বার্থ রক্ষা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করা ছাড়া নেওয়া যায় না।
ক্ষতিপূরণসহ নাকি এটি ছাড়াই বা জনস্বার্থ ব্যতিরেকে সম্পত্তি অধিগ্রহণ অনুমোদন করা হবে, এ বিষয়টি ঠিক করার ভার ইংল্যান্ডের মতো করে আমাদের এখানেও আইনসভার হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে কোনো কোনো সদস্য মত দিলেও আসাদুজ্জামান খান এটিরও বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেন, এটা গ্রহণ করা হলে মৌলিক অধিকার-সংবলিত সংবিধানের তৃতীয় ভাগ অর্থহীন হয়ে পড়বে। কেননা সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার হচ্ছে সেসব অধিকার, যা শুধু শাসন বিভাগ কর্তৃক লঙ্ঘন থেকে রক্ষা করা হয়েছে তা নয়, আইন বিভাগ (পার্লামেন্ট) কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমেও এর লঙ্ঘন করা যাবে না।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘পার্লামেন্ট শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের অস্থায়ী ইচ্ছের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটি মুহূর্তের আবেগে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে কোনো ভুল করে ফেলতে পারে। আর ইংল্যান্ডের উদাহরণ এখানে অনুপযুক্ত। ইংল্যান্ডের সংবিধান হচ্ছে অলিখিত এবং সেখানে লিখিত সংবিধানের মতো করে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ নয়। অধিকন্তু সেখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর জনগণের অসীম আস্থার ওপর ভিত্তিশীল এবং সেখানে জনস্বার্থে ছাড়া ও ক্ষতিপূরণ ব্যতীত পার্লামেন্ট ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণের আইন করেছে, এমন কোনো নজির নেই।’
সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে কেন সাম্প্রতিক বিতর্ক?
বক্তিগত সম্পত্তি, বিশেষ করে জমির মালিকানার বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে সরকারের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিশেষ করে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমান, একই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল প্রমুখের বিপুল বিত্ত-বৈভবের সংবাদ প্রকাশের পরে। কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম এরকম:
১. একাই ৪৬৮ বিঘা জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী; দেশজুড়ে তার জমিদারি।
২. সাভারে সাবেক সেনা প্রধানের যত সম্পত্তি।
৩. সম্পদে পিছিয়ে নেই সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও।
৪. পুলিশের চাকরিতে ‘বাজিমাত,’ সম্পদের কুমির ডিআইজি শিমুল।
৫. গাজীপুরে ৬০ বিঘা জমির ওপর মতিউরের রিসোর্ট রয়েছে বিপুল সম্পত্তিও।
৬. মতিউরের ভাইদের নামেও আছে বিপুল সম্পত্তি।
৭. এবার ধরা পড়ল আরেক এনবিআর কর্মকর্তার ১ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, জব্দের আদেশ।
প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তারা কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন। কেননা তাদের সম্পদের যে ফিরিস্তি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তা কারও বৈধ আয় দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং এগুলো যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে অর্জিত— সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে বিতর্কটা শুধু তাদের সম্পদ অর্জনের প্রক্রিয়া নিয়ে নয় বরং একজন মানুষ সর্বোচ্চ কতটুকু জমির মালিক হতে পারবেন— সেটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। যে বিতর্কটি শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালেই। এই বিতর্কের কারণ ছিল এই যে, সম্পদ, বিশেষ করে জমির মালিক হওয়ার একটি সীমারেখা ঠিক করে না দিলে স্বল্প আয়তনের দেশে কিছু লোক তাদের বৈধ-অবৈধ আয় দিয়ে ইচ্ছামতো জমির মালিক হতে পারবেন এবং সেটি একপর্যায়ে বড় ধরনের বিপদ তৈরি করবে। সেজন্য একটি আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের এবং গণপরিষদ সদস্যরাও বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কী আছে ভূমি সংস্কার আইনে?
অবশেষে ২০২৩ সালে যে ‘ভূমি সংস্কার আইন’ প্রণয়ন করা হয়, সেখানে শর্তসাপেক্ষে জমির সর্বোচ্চ মালিকানার একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন: এই আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি একক নামে ৬০ বিঘার (১ বিঘা সমান ৩৩ শতাংশ) বেশি জমির মালিক হতে পারবেন না। কারও নামে ৬০ বিঘার বেশি জমি থাকলে অতিরিক্ত জমি সরকার অধিগ্রহণ করতে পারবে। আর এ জন্য সরকার কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না।
তবে আইনে কিছু ব্যতিক্রমের কথাও আছে। যেমন: সমবায় সমিতি; চা, কফি, রাবার ও ফলের বাগানমালিক; শিল্প কারখানার কাঁচামাল উৎপাদন হয়, এমন জমির মালিক; রপ্তানিমুখী শিল্প ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতের কাজে ব্যবহার হওয়া জমির মালিক; ওয়াকফ ও ধর্মীয় ট্রাস্টের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী কিংবা আরও যেসব ব্যক্তির শত শত বিঘা জমির মালিকানার খবর এসেছে, সেই মালিকানা কি এই আইন অনুযায়ী বৈধ? যদি না হয় তাহলে রাষ্ট্র কি এই জমি খাস হিসেবে ঘোষণা করবে?
বাস্তবতা হলো, স্বল্প আয়তনের বাংলাদেশ যেখানে জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ; যেখানে নগরায়ন, শিল্পায়নসহ নানা কারণে প্রতিনিয়তই ফসলের জমি ও নিচু জমি কমছে— সেখানে ব্যক্তির সম্পদ, বিশেষ করে জমির মালিকানা অর্জনের সীমা ঠিক করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। না হলে ভবিষ্যতে পুরো দেশটি অথবা দেশের বিরাট অংশই কিছু লোকের মালিকানায় চলে যাবে এবং বাংলাদেশ তখন আর জনগণের রাষ্ট্র নয়, বরং ভূমিদস্যু ও টাকাওয়ালাদের দেশে পরিণত হবে— যেটি স্পষ্টতই সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।