“বর্ষাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবারই স্কুলে আসতে কষ্ট হয়। বাচ্চাদের নিয়ে ভয়ও থাকে।”
Published : 05 Jul 2024, 11:42 AM
বুধবার সকাল ৯টা। আকাশে মেঘের ওড়াওড়ি। মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলে ফুঁসে উঠছে সুনামগঞ্জের সুরমা নদী।
নদীর তীর লাগোয়া সদর উপজেলার একটি সড়ক ঢলের তোড়ে বেশ কয়েকটি স্থানে ভেঙে গেছে। সোয়া দুই কিলোমিটার সড়কের নয়টি স্থানে ভাঙনের কারণে তিনটি ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামের লোকজন এখন যোগাযোগ বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।
সকালে পাহাড়ি ঢলে বিধ্বস্ত সদর উপজেলার কোরবান নগর ইউনিয়নের খাইমতিয়র সড়কে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙনের দুই দিকে মানুষজন দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে কয়েকজন শিক্ষিকাকেও দেখা গেল। উপচানো সুরমা নদী থেকে তীব্র বেগে স্রোত আসছে সড়কের ভাঙা অংশ দিয়ে।
সড়কের পাশের আমন ক্ষেত দিয়ে নেমে তিন শিক্ষিকা একজন আরেকজনের হাত ধরে স্রোত কেটে পার হচ্ছেন। তবে সড়কে উঠার সময় বাধে বিপত্তি। তখন উপর থেকে একজন পুরুষ এগিয়ে এসে তাদের সহায়তা করেন রাস্তায় উঠতে।
তিন শিক্ষকের একজন স্মৃতিশ্যাম পুরকায়স্থ। তিনি সুনামগঞ্জ শহরের বাঁধনপাড়ার বাসা থেকে সকালে বেড়িয়েছেন স্কুলের উদ্দেশে। একাধিক ভাঙন পেরিয়ে গোদারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছান সকাল সোয়া ৯টার মধ্যে।
এলাকাবাসী জানান, সদর উপজেলার কোরবান নগর ইউনিয়নের ধারাগাঁও থেকে খাইমতিয়র পর্যন্ত সড়কটি এবারের দুই দফা বন্যায় নয়টি স্থানে ভেঙে গেছে। পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে ভাঙন কবলিত অংশের মাটি, ঢালাই ও ইট-সুরকি। শিকড়শুদ্ধ কিছু বৃক্ষ সড়কের মাটি কামড়ে আছে।
এখন এই পথে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। কেউ নৌকায়, কেউ হেঁটে আমন জমি মাড়িয়ে শহরে যাতায়াত করেন। তবে নৌকা সহজে মিলে না। হঠাৎ পেলেও ভাড়া দ্বিগুন।
পৌনে ১০টায় গোদারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচজন শিক্ষিকা বসে আছেন। শ্রেণিকক্ষে একজনও শিক্ষার্থী নেই। স্কুলে ১ জুলাই পানি ওঠেছিল। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রক্ষার জন্য বেঞ্চর উপর রাখা হয়েছে। স্কুলের মেঝেও স্যাঁতস্যাঁতে।
গোদারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা শামীম মিয়া জানান, এই দুর্যোগেও যথাসময়ে শিক্ষকরা স্কুলে এসেছেন। কিন্তু রাস্তাটি স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াও অভিভাবকরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। তাছাড়া একদিন আগেও স্কুলে পানি ছিল।
“আমি কিছু লোক নিয়ে এসে বেঞ্চের উপর জরুরি জিনিস রেখে রক্ষা করেছি। রাস্তাঘাট ঠিক না হলে অভিভাবকরা এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পাঠাতে সাহস পাবেন না।”
গোদারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা স্মৃতিশ্যাম পুরকায়স্থ বলেন, সুরমা নদী লাগোয়া ধারারগাঁও-গোদারগাঁও সড়কটির বিভিন্ন অংশ পানির তোড়ে ভেসে গেছে। নদীতে পানি বেশি থাকায় স্রোতও বেশি।
তিনি বলেন, “তারপরও ঝুঁকি নিয়ে আমরা স্কুলে এসেছি। তবে বাচ্চাদের পাঠাতে ভয় করছেন অভিভাবকরা। তাই স্কুলে কোনো শিক্ষার্থী আসেনি। আমরা অন্যান্য দিনের মত স্কুল শেষে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাড়িতে ফিরব।”
গোদারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইলোরা দে বলেন, “সড়কের উপর দিয়ে সুরমার নদীর জল গড়িয়েছে। অনেক অংশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখন গাড়ি চলাচল করার উপযুক্ত নয় সড়কটি। বর্ষাকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবারই স্কুলে আসতে কষ্ট হয়। বাচ্চাদের নিয়ে ভয়ও থাকে।”
জরুরি ভিত্তিতে সড়কটি সংস্কার করে যাতায়াত স্বাভাবিক করার দাবি জানান প্রধান শিক্ষক।
গোদারগাঁও গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “দুইবারের বন্যায় আমাদের রাস্তার বেশিরভাগ অংশই ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে। আমাদের স্কুলেরও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। স্কুলে আসার মুখে বড় ভাঙন। দেখলেই ভয় লাগে।
“এই অবস্থায় আমরা কিভাবে শিশুদের পাঠাবো। রাস্তা ঠিক করা না হলে অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে ভয় করবেন।”
পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সদর উপজেলার হালুয়ারগাঁও সড়কের মুখে গিয়ে দেখা যায়, সড়কটি ডুবে আছে। সড়কের মুখে নৌকায় পার হয়ে জেলা শহরে যাচ্ছেন মানুষজন।
দেখা গেল, দেখার হাওর ঘেরা গ্রাম গোয়াচুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা বেগম আরও তিন শিক্ষককে নিয়ে একটি নৌকায় করে স্কুলে রওয়ানা দিয়েছেন।
এ সময় বাড়ি থেকে শহরের উদ্দেশে আসা অভিভাবক তারিছ উদ্দিন বলেন, “ম্যাডাম ইস্কুলে গিয়া কিতা করতা, আমরার বাচ্চারাতো আইতে পারতো না।”
এদিন দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ শহরের বড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই স্কুলে আছেন। তিনতলা ভবনের পুরোটাতেই বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। নিচের অফিস কক্ষের পাশে কিছু শিক্ষার্থী এসেছে। তাদেরকে সময় দিচ্ছেন শিক্ষকরা।
ওই স্কুলে ঢুকে দেখা গেল, ৭০ জন বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। তারা কেউ রান্নাবান্না করছেন, কেউ শুয়ে আছেন, কেউ সংসারের খুটিনাটি কাজ করছেন। ১ জুলাই সন্ধ্যায় বাড়িঘর পানিতে নিমজ্জিত হলে রাতেই তারা স্কুলে এসে ওঠেন। এখনও স্কুলেই আছেন।
তিনতলায় আশ্রয় নেওয়া বড়পাড়া এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, “আমরা ইবার লইয়া দুইবার আইয়া ইসকুলে ওঠলাম। পাইন্যে আমরার ঘরদুয়ার ভাঙ্গাইয়া নিলো। অনে দুই ছেলে আর আার এক মেয়ে লইয়া আইয়া উঠছি ইস্কুলে। আমরা খুব কষ্টত আছি।”
বড়পাড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, “আমার পরিবারো ১০ জন মানুষ। ১২ দিন আগে ইস্কুলে থাইক্যা গেছি। ইবারও পানি আইয়া আমরার ঘরবাড়ি ডুবাইলিছে। বারবার পানি উঠায় আমরার ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। গরিব মানুষ যাইবার জাগা নাই, তাই ইস্কুলই ভরসা।”
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস বলেন, বুধবার পর্যন্ত জেলার ৫৯টি স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তরা আছেন। ওইদিন পর্যন্ত ২৩৮টি স্কুলে পানি ছিল। এই অবস্থায় শিক্ষকরা স্কুলে যেতে পারলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা পাঠাতে ভয় করছেন। তবে পানি কমলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”