২০২১-২২ অর্থবছর: ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি

দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি হয়েছে।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2022, 08:01 PM
Updated : 1 August 2022, 08:01 PM

কয়েক মাস থেকে বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি আগের রেকর্ডকে পেছনে ফেলে গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে; আর দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ইতিহাস সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি হয়েছে।

আমদানি পণ্যের পরিমাণ এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অতিমাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণেই অর্থবছর শেষে এমন দুই রেকর্ডের চাপে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ দুই সূচক।

সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের তথ্যসহ চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।

এতে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ২৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে ঘাটতি ৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার বা শতকরা হিসাবে ৩৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। আর গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ রপ্তানি থেকে আয় করে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

গত অর্থবছরের শেষের দিকে প্রতি মাসেই আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ফারাক বাড়ায় বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি একের পর এক আগের রেকর্ড ছাড়ায়; সবশেষ মে মাসে তা বেড়ে হয়েছিল ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

একই ভাবে অর্থবছরের শেষ মাসগুলোতে প্রায় প্রতি মাসেই বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার করে বেড়েছে।

এতে অর্থবছর শেষে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি হিসাব ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়ে রেকর্ড ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে যা ছিল ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তা চার গুণের বেশি বেড়েছে। তার আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫৪৪ কোটি ডলার।

গত মে মাসেও চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ, যা জুনে নতুন রেকর্ড গড়ে। মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ১৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।

এর আগে এপ্রিল শেষেও এ সূচকে রেকর্ড হয়েছিল; চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে হয়েছিল ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। মার্চ এর পরিমাণ ছিল ১৪ দশামিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

দেশ চলতি হিসাবে এত ঘাটতিতে আর কখনই পড়েনি। এর আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ৯ বিলিয়ন ৫৬ কোটি ডলারের ঘাটতিই ছিল সবচেয়ে বড়।

কেন এত ঘাটতি

পণ্য আর সেবা আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের জোগান সেভাবে না বাড়ায় ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে।

সোমবার ব্যালেন্স অব পেমেন্টের যে প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আর এসময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।

এতে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। যদিও সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন বা ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি হয়েছে রপ্তানি। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যের এ ব্যবধান কমিয়ে আনতে অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।

কিন্তু গত অর্থবছর শেষে প্রবাসী আয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়, মোট এসেছে ২১ বিলিয়ন ডলার। এতে চলতি হিসাবে লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতিও বেড়ে যায়।

সামগ্রিক লেনদেনও ঘাটতিতে

উদ্বৃত্ত নিয়ে শুরু করলেও গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সামগ্রিক লেনদেনে (ওভার অল ব্যালেন্স) ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন। ওই অর্থবছরের শুরুতে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও এই সময়ে আগের বছরের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি এসেছে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)। এরপরও সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি রয়ে গেছে।

আমদানি কমাতে যত পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে পেট্রোলিয়াম পণ্য। এরপর বেশি এসেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি রয়েছে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে।

কোভিড মহামারীর ক্ষত কাটিয়ে আমদানি চাঙ্গা হওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে হামলা করে রাশিয়া যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার পর থেকে টালমাটাল হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক পণ্য বাজার। বিশ্ব অর্থনীতির মত এর উত্তাপ লাগে বাংলাদেশেও।

জ্বালানিসহ উচ্চ মূল্যে পণ্য আমদানি করতে গিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেনের প্রধান মুদ্রা ডলারের সংকট তৈরি হলে দ্রুত মান হারাতে থাকে টাকা। ক্রমাগত টাকার অবমূল্যায়ন করে এবং রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে।

পরে এপ্রিল থেকে বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে আনতে ডলার সাশ্রয়ে একের পর এক ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্যোগ নিয়ে থাকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

পণ্য আমদানিতে লাগাম টানার পাশাপাশি কড়াকড়িও করা হয়। আবশ্যকীয় ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আবার আমদানি বাণিজ্যের নামে অর্থ পাচারের বহু পুরনো অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে প্রথমবারের মত ৩০ লাখ ডলার বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণের এলসি (ঋণপত্র) খোলার আগেই যাচাই-বাছাই করা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ পর্যন্ত পাঁচটি এলসির বিপরীতে ২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি বাতিল করে দিয়েছে ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না পাওয়ায়।

এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত এপ্রিল থেকে নেওয়া এসব উদ্যোগের ফল জুলাই মাসে পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত জুলাই শেষে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ বিলয়ন ডলার, যা আগের মাস জুনের চেয়ে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ কম।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে গত জুনের প্রথম দিকেই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের এ চাপ সামাল দিতে এ দুই পদক্ষেপ কাজে আসবে সামনের দিনগুলোতে।

রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ডলার সংকট ও বাণিজ্য ঘাটতির এ ধারা ছয় মাসের মধ্যে অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসবে।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শে সরকারও আমদানি পণ্যের চাহিদা কমিয়ে ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটেও কৃচ্ছতা ও কৌশল নির্ধারণের গুরুত্ব দেয়।

আরও পড়ুন

Also Read: বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই, এবার ছাড়াল ৩০ বিলিয়ন ডলার