ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় মাথায় রেখে ঋণ প্রবাহ সম্প্রসারণ ও সংকোচনের মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন দুই অর্থনীতিবিদ যাতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখতে গিয়ে অর্থায়নের ধারা বাধাগ্রস্ত না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের রাজস্ব নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়নে এ দুটি বিষয়সহ আরও কয়েকটি চ্যালেঞ্জ দেখতে পেয়েছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ, ঋণ প্রবাহ ঠিক রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো মূল্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন তারা।
‘‘বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ ঠিক রাখার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। আবার বিনিময় হার দেখতে গিয়ে আমদানি-রপ্তানির দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে।’’
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সোমবার মুদ্রানীতি কেমন হবে তা চূড়ান্ত করতে গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বে গঠিত ‘মুদ্রানীতি সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন’ সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে বসার সূচি রয়েছে।
এটি বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদে প্রণয়ন করা শেষ মুদ্রানীতি হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী ৩ জুলাই শেষ হচ্ছে তার মেয়াদ। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোমবারের বৈঠকে সরকারি-বেসরকারি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রাসহ মুদ্রানীতির বিভিন্ন সূচকের প্রাক্কলনসহ বাস্তবায়নের কৌশল ঠিক করা হবে। বৈঠকেই নির্ধারণ করা হবে মুদ্রানীতি কবে ঘোষণা করা হবে।
এর আগে বাজেট পাস হওয়ার পর অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে জুলাইয়ের শেষ দিকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হত। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয় ২০২১ সালের ২৯ জুলাই। তবে আগামী ৩০ জুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতে পারে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে।
আগামী মুদ্রানীতির জন্য ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মে মাসে মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে একটি খসড়াও তৈরি করেছে; যেটি ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।
পরিচালকদের দেওয়া মতামত সামনে রেখেই সোমবারের বৈঠকে চূড়ান্ত হতে পারে আগামী মুদ্রানীতির আঙ্গিক ও ঘোষণার তারিখ।
আগামীর মুদ্রানীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বাজেটের রাজস্ব নীতি অনুসরণ করে সম্প্রসারণমুখী হওয়া উচিত বলেই মনে করছি। একেবারে সংকোচন করা যাবে না। আবার এমন সম্প্রসারণ করা যাবে না যাতে মূল্যস্ফীতির উপর চাপ পড়ে।
“সবদিকে ভারসাম্য আনতে বিশেষ কৌশলী ভূমিকায় যেতে হবে। বেসরকারি ঋণ প্রবাহ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ঋণ যেন উৎপাদনমুখী ও মাঝারি ও ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে বেশি যায়।’’
এর কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘‘বড়দের অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মাঝারি ও ছোটদের ঋণ নিশ্চিত করতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে বেশি। স্থানীয় বাজার শক্তিশালী হবে।’’
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার ধীরে ধীরে সমন্বয়ের কথাও বলেন সাবেক এ গভর্নর।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘সংকোচন ও সম্প্রসারণের মধ্যে থেকে ভারসাম্য বজায় রেখে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়।
‘‘বেশি সংকোচনের পথে যাওয়া উচিত হবে না। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে রেমিটেন্স প্রবাহের দিকে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।’’
উচ্চ মুল্যস্ফীতির মধ্যে বর্তমান ডলার সংকটের বিষয়ও মুদ্রানীতি প্রণয়নের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অথর্নীতিবিদ হাবিবুর বলেন, ‘‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়াতে হবে। নইলে চলমান ডলার সংকট আরও স্থায়ী হলে রিজার্ভ ক্ষয় হয়ে যাবে।
এছাড়া কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মাকণ্ডের দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সব মিলিয়ে আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো একটু জটিল আকার ধারণ করেছে। গত সময়ে সবগুলো পরিষ্কার ছিল। এতটা জটিল ছিল না। তবে উপায় বের করে আনা যাবে।’’
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি আট বছরের সর্বোচ্চে পৌঁছে হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা ছিল ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। মে পর্যন্ত ১১ মাসে সরকারি ঋণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৫৯ শতাংশ। অর্থবছরের শেষ সময়ে দ্রুত তা বাড়ছে।
ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে পারে বলে এটিও মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আর বেসরকারি খাতের জন্য ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের সংকুলান রেখে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এপ্রিল শেষেপ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে চলতি মুদ্রানীতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ‘সম্প্রসারণ ও সংকুলানমুখী’। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ে দেশের অর্থনীতি ও সমাজে কোভিড-১৯ সংকট এর প্রভাব তীব্র আকারে ছিল।