বেসরকারি ঋণে গতি বাড়ছে

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহেও গতি ফিরছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2020, 05:44 PM
Updated : 31 Oct 2020, 05:44 PM

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৩ হাজার ৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

এ বছর অগাস্টে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।

মহামারীর অভিঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর টানা তিন মাস অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকল।

অপরদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেশ কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মেষ মাস জুনে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, টানা প্রায় ১০ বছর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক বা ১০ শতাংশের উপরে ছিল। তবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে এই প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত এপ্রিলে ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে।

ওই মাসে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে যায়। গত জুনে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও এই একই লক্ষ্য ধরা ছিল, বিপরীতে ঋণ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকার সোয়া লাখ কোটির টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামারীর ধাক্কা আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। রেমিটেন্স, রপ্তানি আয়, রাজস্ব আদায়ের পাশপাশি অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলোও ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।

“সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঘুঁরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে।”

২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি ঋণ। সেই ঋণ যদি না বাড়ে তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে না। কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না।

“বেশ কিছু দিন ধরে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে তা আরও নাজুক হয়ে পড়েছিল। এখন ভালো খবর যে, নতুন অর্থবছরের শুরুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দিয়ে শুরু হল। আমরা প্রত্যাশা করব, আগামী দিনগুলোতেও যেন এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির বড় কারণ হচ্ছে প্রণোদনা।

“কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ থাকায় ঋণ বিতরণ বাড়ছে। আবার ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকায় ব্যাংকাররাও চাচ্ছে ঋণ বাড়ুক। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও ঘুরে দাঁড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। অর্থনীতির জন্য এটা ভালো খবর। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

“আর এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে অন্য খাতে যেন ব্যবহার না হয়- সে বিষয়টির দিকে কড়া নজর রাখতে হবে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খালেদ জোর দিচ্ছেন ঋণ আদায়ের ওপর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি, “এই যে সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো যেনো যথাসময়ে আদায় হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যারা ঋণ নিচ্ছে, তারা যেন মনে না করে, প্রণোদনার ঋণ আর ফেরত দিতে হবে না।

“এমনিতেই আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ। খেলাপি ঋণ লাগামহীন। এরপর যদি প্রণোদনা ঋণ আদায় না হয়, খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।”

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঋণ খেলাপিদের আরেক দফা সুবিধা দিয়েছে সরকার; ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না।

অর্থাৎ ২০২০ সালের বাকি সময় জুড়েই কোনো ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি হতে হবে না কোনো উদ্যোক্তাকে।

ঋণ খেলাপিদের এই সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তে হতাশা ও উষ্মা প্রকাশ করে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “কী আর বলব…! কী হচ্ছে ব্যাংক খাতে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ব্যাংক খাতে যে এক ধরনের অরাজকতা চলছে, এটা তারই নিদর্শন।”

গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০-২১ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ; যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হচ্ছে যথাক্রমে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

কিছু ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে দুই বছর আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে ঋণ প্রবৃদ্ধি। ওই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের শুরুতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। এর মধ্যে কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল।

করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন পর্যন্ত শতাধিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। কমানো হয়েছে নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর), নীতি সুদহার রেপো ও ব্যাংক রেট।

প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণসুবিধা নিয়ে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য যথাসময়ে শুরু করা যায়, সেজন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মহামারী মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত সোয়া লাখ কোটি টাকার যে ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে বড় শিল্প ও সেবা খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং কটেজ মাইক্রো ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (সিএমএসএমই) ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল অন্যতম। এই দুই তহবিলের জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা (১৫ হাজার ও ১০ হাজার কোটি টাকা) যোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।