ঋণ খেলাপিদের ফের সুযোগ, ব্যাংকিং খাতে ‘অরাজকতা’

ঋণ খেলাপিদের আরেক দফা সুবিধা দিল সরকার; ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2020, 02:20 PM
Updated : 28 Sept 2020, 05:46 PM

করোনাভাইরাসের কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মহামারীর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় গত ১৫ জুন আরও তিন মাস বর্ধিত করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল।

সেই সময় আরও তিন মাস বাড়িয়ে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ঋণ খেলাপিদের তৃতীয় দফা সময় দেওয়ার সিদ্ধান্তে হতাশা ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কী আর বলবো…! কী হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী করছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ব্যাংকিং খাতে যে এক ধরনের অরাজকতা চলছে, এটা তারই নিদর্শন।

“এমনিতেই আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো না। এরপর একটার পর একটা এ ধরনের অযৌক্তিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যাংকিং খাত তথা আর্থিক খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”

দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় গত ১৯ মার্চ এক সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ১ জানুয়ারি ২০২০ ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ওই ঋণ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।

পরে ১৫ জুন এ সংক্রান্ত অপর একটি সার্কুলারে বলা হয়, ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই ঋণ/বিনিয়োগ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণের/বিনিয়োগের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।

সর্বশেষ সোমবারের নির্দেশনায় বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা থাকায় অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।

তাই ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই ঋণ/বিনিয়োগ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।

তবে কোনো ঋণের/বিনিয়োগের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।

সোমবারের সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অর্থনীতির অধিকাংশ খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা থাকায় অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।

এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এবং ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়ের উপর কোভিড-১৯ এর নেতিবাচক প্রভাব সহনীয় মাত্রায় রাখার লক্ষ্যে ঋণ/বিনিয়োগের মেয়াদ/পরিশোধসূচী নির্ধারণ ও শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে এখন নিচের নির্দেশনাগুলো অনুসরণীয় হবে:

>> ০১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণীমান যা ছিল, আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সময়ে উক্ত ঋণ/বিনিয়োগ তদাপেক্ষা বিরূপমানে শ্রেণীকরণ করা যাবে না। তবে, কোন ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণীমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণীকরণ করা যাবে।

>> এই নির্দেশনা পরিপালনের লক্ষ্যে ০১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বিদ্যমান মেয়াদী (স্বল্পমেয়াদী কৃষি ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণসহ) ঋণ/বিনিয়োগসমূহের বিপরীতে ০১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালীন প্রদেয় কিস্তিগুলো ডেফার্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে জানুয়ারী ২০২১ হতে সংশ্লিষ্ট ঋণ/বিনিয়োগের কিস্তির পরিমাণ ও সংখ্যা পুনঃনির্ধারিত হবে। পুনঃনির্ধারণকালে জানুয়ারি ২০২০ হতে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত যতসংখ্যক কিস্তি প্রদেয় ছিল তার সমসংখ্যক কিস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সময়ের কোন কিস্তি পরিশোধিত না হলেও উক্ত কিস্তিসমূহের জন্য মেয়াদী ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহীতা কিস্তি খেলাপী হিসেবে বিবেচিত হবেন না।

>> ০১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বিদ্যমান চলমান ও তলবী ঋণ/বিনিয়োগসমূহ এবং উক্ত তারিখ হতে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সময়ে সৃষ্ট তলবী প্রকৃতির ঋণ/বিনিয়োগের মেয়াদ/সমন্বয়ের তারিখ বিদ্যমান মেয়াদ হতে ১২(বার) মাস অথবা ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ (যেটি আগে ঘটে) পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

>> এই সুবিধা চলাকালীন ঋণ/বিনিয়োগের উপর সুদ/মুনাফা আরোপের ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা বলবৎ থাকবে। অর্থাৎ ঋণ শ্রেণীকরণ, পুনঃতফসিলকরণ, এককালীন এক্সিট সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণ/বিনিয়োগসহ যে সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি-নিষেধ রয়েছে, সে সকল ঋণ/বিনিয়োগের বিপরীতে নগদ আদায় ব্যতিরেকে আরোপিত সুদ/মুনাফা আয়খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। উক্ত সময়ে ঋণ/বিনিয়োগের উপর কোনরূপ দন্ড সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না।

>> কোন গ্রাহকের উল্লিখিত সুবিধা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত না হলে পূর্বনির্ধারিত পরিশোধসূচী অনুযায়ী অথবা ব্যাংকারগ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ/বিনিয়োগ সমন্বয়/পরিশোধ করা যাবে। এই বিশেষ সুবিধা গ্রহণ না করে কোন গ্রাহক কর্তৃক স্বেচ্ছায় মেয়াদী ঋণ/বিনিয়োগের (স্বল্পমেয়াদী কৃষি ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণসহ) কিস্তি পরিশোধ এবং চলতি ও তলবী ঋণ/বিনিয়োগ সমন্বয়/পরিশোধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক কর্তৃক যৌক্তিক রিবেট সুবিধা প্রদান করা যাবে।

>> এ সার্কুলারের মাধ্যমে কিস্তি পরিশোধ/সমন্বয়ের জন্য বর্ধিত সময়ের সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণ/বিনিয়োগের উপর আরোপিত সুদ আয়খাতে স্থানান্তর এবং ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের বিষয়ে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হবে।

>> ইতোপূর্বে এ বিষয়ে জারি করা নির্দেশনা রহিত করা হলো।

>> ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করা হলো।

ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। সরকার ঋণ খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সে দিকে কোনো নজর নেই।”

“হাতেগোনা চিহ্নিত কয়েকজন লোককে সুযোগ দিতে দিনের পর দিন ছাড় দিয়েই যাচ্ছে সরকার, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং খাতের বারোটা বাজছে।”

“নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কি করছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঋণখেলাপিদের এ ধরনের ঢালাও সুযোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঢেকে আনছে বলে আমি মনে করি।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

জুন মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।

বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের পরও মহামারীকালে বাড়ছে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের অংক।

তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।

এই অঙ্ক মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে যা ছিল ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ।

২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের ‘বিশেষ’ সুযোগসহ নানা ছাড় দেওয়ার পরও এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

জুন পর্যন্ত দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল।

আর মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।