ধাক্কা সামলে নভেম্বরে ৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে রপ্তানি

আগের দুই মাসের কমার ধারা থেকে বেরিয়ে এসে একক মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬.০১ শতাংশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2022, 12:51 PM
Updated : 2 Dec 2022, 12:51 PM

নানা সংকটের মধ্যেও গত দুই মাস ধরে পিছিয়ে পড়া রপ্তানি আয় নভেম্বরে চমক দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে; একক মাসে প্রথমবারের মত পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সব রেকর্ড অতিক্রম করে এ মাসে ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২৬ দশমিক ০১ শতাংশ বেশি। একক মাস নভেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ।

২০২১ সালের একই মাসে ৪০৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির পর ২০২২ সালের নভেম্বরে ৪৩৫ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

অতীতে কখনও একক মাসে রপ্তানি আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার হয়নি। কোভিড পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সর্বোচ্চ রপ্তানির রেকর্ড হয়েছিল। এক বছরের মাথায় সেই রেকর্ড অতিক্রম করে বিস্মিত রপ্তানিতে বেশি অবদান রাখা পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা।

সংকটের কথা মাথায় রেখে রপ্তানির এ রেকর্ডকে ‘বিস্ময়কর’ বলছেন অনেক শিল্প মালিক। তবে কোভিডের পর পোশাক রপ্তানির নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ ও উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরির দক্ষতার কারণে এমন সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের রপ্তানি শিল্প। তারপরও কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়া, উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি ও কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের মত নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ার ফলে নভেম্বরে এ বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতে চীন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম গত ৪/৫ মাসে রপ্তানিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। এসব দেশের কিছু কিছু ক্রেতা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে। সে কারণে গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের মধ্যেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এটি রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের টেকসই অবস্থান ও ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত বহন করছে।

গত প্রায় চারমাস ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট কারণে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাহত হওয়ার অনুযোগ করে আসছিলেন রপ্তানিকারকরা। আবার ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপে-আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ায় ক্রয়াদেশও কমে আসছিল বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছিল।

ব্যবসায়ীদের এসব পূর্বাভাসের সঙ্গে মিল রেখে টানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধিতে থাকা রপ্তানি হোঁচট খায় গত সেপ্টেম্বরে এসে; আগের মাসের মত অক্টোবরেও আগের বছরের একই মাসের চেয়ে রপ্তানি আয় কমে যায়।

সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ পিছিয়ে ৩৯০ কোটি ডলার এবং অক্টোবরে আগের বছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ পিছিয়ে ৪৩৫ কোটি ডলারে নেমেছিল।

বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত নভেম্বরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মূলত পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিই গত মাসের রপ্তানি আয়ে একাধিক ইতিবাচক রেকর্ড বয়ে এনেছে। মোট ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারের রপ্তানির মধ্যে শুধু নিট ও ওভেন পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৪৩৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৮৬ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। সাধারণত সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রপ্তানির ৮২ থেকে ৮৩ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে।

নভেম্বর শেষে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে মোট রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ১৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৯৭৯ কোটি।

সামগ্রিক রপ্তানির তথ্যে দেখা যায়, কৃষিপণ্য খাতে এ পাঁচ মাসে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ৪২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ কম। চামড়া ও চামড়াজাত খাতে আয় এসেছে ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ শতাংশ কম।

অনেক কারখানায় কাজ নেই

বিকেএমইএর সহ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান মনে করেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের মধ্যে দেশের রপ্তানি আয়ে নতুন রেকর্ড হলেও বাস্তবে পোশাক শিল্পের চিত্র ভিন্ন। এখনও অনেক কারখানা ক্রয়াদেশের খরায় ভুগছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এখন কোনো কারখানাতেই ওভার টাইমে কাজ চলছে না। অনেক কারখানা কাজ না পেয়ে সাব কন্টাক্টে কাজের জন্য ঘুরছে। আবার যাদের কাজের সুযোগ আছে তারাও গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের কারণে বিগত দিনগুলোতে পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করতে পারেনি। তার মধ্যেও রপ্তানিতে এমন প্রবৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর।

অবশ্য নভেম্বরের শেষে এসে গ্যাস বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটাই কেটেছে বলে জানান তিনি।

“গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের সমস্যাটা কেটেছে। গ্যাসের চাপও আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তবে গ্যাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।”

এদিকে সম্প্রতি গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট কিছুটা কাটলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিও বাড়তে থাকায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা নিয়ে ভাবনার কথা জানাচ্ছেন পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা সরকারের সঙ্গে বারবার বসেছি, আলাপ করেছি। কিন্তু সম্প্রতি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে কর্মসূচি দিচ্ছে তা ‘অস্থিতিশীলতার শঙ্কা’ তৈরি করছে।

তার আশা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেশের অর্থনৈতিক গতি যাতে ব্যাহত না হয়, দলগুলো সেই দিকটি মাথায় রাখবে।

পোশাক রপ্তানিতে ‘শঙ্কার’ কথাই বলল বিজিএমইএ

সেপ্টেম্বরে রপ্তানিতে পিছুটান, প্রবৃদ্ধি কমেছে ৬.২৫%
অগাস্টে রপ্তানি বেড়েছে ৩৬%

Also Read: ইউরোপে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে বাংলাদেশ

Also Read: রপ্তানিতে ধাক্কা অক্টোবরেও, কমেছে ৭.৮৫%