ইউক্রেইন থেকে বিশ্বের কত শস্য দরকার

যুদ্ধের আগে ইউক্রেইন থেকে বছরে ২৩ লাখ টন গম আমদানি করত বাংলাদেশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2022, 05:17 AM
Updated : 3 August 2022, 05:17 AM

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে ঐতিহাসিক এক চুক্তির আওতায় প্রথমবারের মত ইউক্রেইন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের দাম কমার আশা তৈরি হচ্ছে।

সোমবার ইউক্রেইনের স্থানীয় সময় সকালে দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর ওডেসা থেকে ২৬ হাজার টন ভুট্টা নিয়ে ছেড়ে যায় ‘রজনি’ নামের একটি জাহাজ। সিয়েরা লিওনের পতাকাবাহী জাহাজটি মঙ্গলবার লেবাননে পৌঁছানোর কথা।

ইউক্রেইন সরকার বলছে, আসছে সপ্তাহগুলোতে ১৬টি জাহাজে আরও ছয় লাখ টন খাদ্যশস্যের চালান পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে কৃষ্ণসাগর অবরোধ করে রাশিয়া। তাতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের দামে উল্লম্ফন দেখা দেয়। শস্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেইনের ওপর নির্ভরশীল অনেক দরিদ্র দেশে দেখা দেয় খাদ্য সংকট।

শস্য পরিবহনে জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত মাসে ইউক্রেইন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ১২০ দিন মেয়াদী ওই চুক্তি করতে সময় লেগে যায় প্রায় দুই মাস। ঠিক হয়েছে, উভয়পক্ষ রাজি থাকলে চুক্তির মেয়াদ আবার বাড়ানো হবে।

চুক্তির শর্তানুযায়ী, চালান পরিবহনকালে ইউক্রেইনের বন্দরগুলোতে হামলা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়া। আর ইউক্রেইন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মাইনপাতা জলপথ দিয়ে মালবাহী জাহাজগুলো যাওয়ার সময় সেগুলোকে তাদের নৌবাহিনীর জাহাজ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তুরস্ক ওই জাহাজগুলোকে পরীক্ষা করে দেখবে; কারণ রাশিয়ার আশঙ্কা, এসব জাহাজের মাধ্যমে ইউক্রেইনে অস্ত্র পাচার করা হতে পারে।

মূলত ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় তিনটি বন্দর, ওদেসা, চর্নমোর্স্ক ও পিভদেন্নি দিয়ে দেশটির শস্যের চালান গন্তব্যে পাঠানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেজন্য ইস্তাম্বুল প্রণালীর ৩১০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ এবং ৩ নটিক্যাল মাইল প্রশস্ত একটি করিডোর এই চুক্তির আওতায় থাকবে। রাশিয়াও কৃষ্ণ সাগর দিয়ে খাদ্য ও সার রপ্তানি করতে পারবে।

এই শস্য বিশ্বের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

ইউক্রেইনে কত শস্য আটকেছিল?

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেইনে প্রায় ২ কোটি টন খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য আটকা পড়ে।

অচলাবস্থা চলতে থাকলে এ বছর আবাদ হওয়া শস্য মিলে এই পরিমাণ সাড়ে ৭ কোটি টনে পৌঁছাতে পারে বলে জুনের শুরুতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

গবেষণা সংস্থা চ্যাথম হাউজের খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লরা ওয়েলেসলি বলছেন, ইউক্রেইনে প্রতিবছর ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হলেও এবার যুদ্ধের কারণে তা অন্তত ৩০ শতাংশ কমবে।

শস্য সংকটে অন্য দেশগুলো কতটা বিপদে?

শস্য রপ্তানিতে বিশ্বে চতুর্থ হিসেবে ধরা হয় ইউক্রেইনকে; বিশ্বের ৪২ শতাংশ সূর্যমুখি তেল, ১৬ শতাংশ ভুট্টা এবং ৯ শতাংশ গম ইউক্রেইনেই উৎপাদন হয়।

আর রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ। যুদ্ধের কারণে এবার রাশিয়াও সেভাবে শস্য রপ্তানি করতে পারেনি।

ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমারা দিয়েছে, তাতে কৃষি খাত অন্তভুর্ক্ত না থাকলেও ইন্স্যুরেন্স ব্যয় বৃদ্ধি এবং দাম পরিশোধে জটিলতার কারণে রপ্তানিতে বিঘ্ন ঘটছে বলে ক্রেমলিনের ভাষ্য।

আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানিয়েছে, আফ্রিকার চাহিদার ৪০ শতাংশ গম সাধারণত ইউক্রেইন ও রাশিয়া থেকেই সরবরাহ করা হত। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এ অঞ্চলে ৩ কোটি টন খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, যার ফলে আফ্রিকায় খাদ্যপণ্যের দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। নাইজেরিয়ায় পাস্তা ও রুটির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

একই চিত্র ইয়েমেনে। দেশটি সাধারণত ইউক্রেইন থেকে ১০ লাখ টনের বেশি গম আমদানি করে প্রতিবছর। কিন্তু সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় জানুয়ারির তুলনায় মে মাসে সেখানে আটার দাম ৪২ শতাংশ এবং রুটির দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে।

ইউক্রেইনের বড় গম আমদানিকারক সিরিয়াও একই সংকটে পড়েছে, সেখানে রুটির দাম দ্বিগুণ হয়েছে।

এর মধ্যে ইউক্রেইন থেকে জাহাজ ছাড়ার খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে লরা ওয়েলেসলি বলছেন, ইউক্রেইন থেকে দ্রুত বিপুল শস্য রপ্তানি না হলে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্য সংকট থেকেই যাবে।

“আর সেক্ষেত্রে এসব দেশে খাবারের দাম আরও বাড়বে। তেমন ঘটলে সেটা ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতার কারণ ঘটাতে পারে।”

জাহাজের বীমা কে দেবে?

সমুদ্রগামী জাহাজে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বীমা করা থাকে, যাতে কোনো দুর্ঘটনায় পণ্য নষ্ট হলে আমদানি ও রপ্তানিকারণের ক্ষতি এড়ানো যায়। তবে যেখানে যুদ্ধ চলে, সেই এলাকায় বাণিজ্যিক জাহাজের বীমার প্রিমিয়াম বেড়ে যায় অনেক।

লয়েডস মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের একজন শীর্ষ নির্বাহী নেইল রবার্টস বলেছেন, ওডেসা বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজ ‘রজনি’ এ যাত্রার জন্য বীমার আওতায় রয়েছে।

ইউক্রেইনের বন্দরগুলোতে এখন জাহাজ যাওয়া আসার ক্ষেত্রে বীমার জন্য কত প্রিমিয়াম দিতে হবে, বীমাকারী কোম্পানিগুলো সেটা ঠিক করবে।

“বলা যায় রজনির এই যাত্রা অনেকটা পরীক্ষামূলক। চুক্তি অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক থাকছে কি না, এ যাত্রায় সেটা দেখা হবে।”

যুদ্ধ শুরুর পর কৃষ্ণসাগরে চলাচলকারী জাহাজের জন্য বীমার খরচ বেড়ে গেছে অনেক। কিছু কিছু কোম্পানি জাহাজের দামের ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রিমিয়াম ধরছে একবারের যাত্রাতেই।

চুক্তির অনুযায়ী সাগরে নিরাপদ করিডোর মেলায় প্রিমিয়াম এখন কমে যাবে বলে মনে করছেন রবার্টস।

“কোম্পানিগুলোর এখন বাস্তবসম্মত ও প্রিমিয়াম ধরতে হবে, কারণ এটা একটা মানবিক সংকট সামাল দেওয়ার বিষয়, লাভ করার সময় এটা নয়।”

চুক্তির আগে কীভাবে রপ্তানি হচ্ছিল?

যুদ্ধের আগে ইউক্রেন তার ৯০ শতাংশ শস্য সাগর পথেই রপ্তানি করত। কিন্তু বন্দরগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় দেশটি ট্রাক ও ট্রেনে করে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করে।

আবার বাল্টিক সাগর দিয়ে যাতে ইউক্রেনের পণ্য যেতে পারে সেজন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় ইউরোপ। তবে তা বেশ সময়সাপেক্ষ ছিল।

রোমানিয়ার কনস্টানটা বন্দরেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেজন্য ইউক্রেইন থেকে বার্জে করে দানিউব নদী দিয়ে পণ্য পাঠানো হচ্ছিল কনস্টানটা বন্দরে।

বিবিসি লিখেছে, ভবিষ্যতেও হয়ত এসব সুবিধা চালু রাখতে হবে, কারণ রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপদ করিডোরের চুক্তির মেয়াদ মাত্র ১২০ দিনের এবং এরপর তা নবায়ন নাও হতে পারে।

পুরনো খবর

Also Read: রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির অধীনে ইউক্রেইন ছাড়ল প্রথম শস্যবাহী জাহাজ

Also Read: ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের কারণ হতে পারে: জাতিসংঘ

Also Read: গম কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ

Also Read:  ভারতের গম বিশ্বের জন্য কতটা জরুরি?