ভারতের গম বিশ্বের জন্য কতটা জরুরি?

ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্য সরবরাহে যে সংকট দেখা দিয়েছে, ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত সে পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মত সমালোচনাকারীদের। যদিও ভারত সরকার তাদের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে নানা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2022, 04:44 PM
Updated : 6 June 2022, 05:22 PM

গত ১৩ মে ভারত তাদের গম রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। অথচ আশা করা হয়েছিল, গম রপ্তানি বাড়িয়ে বিশ্ববাজারের চলমান খাদ্যসংকট পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

ভারতের গমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে জার্মানির খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী জেম অসডেমির বলেন, ‘‘যদি সবাই রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করে....তবে তা সংকট পরিস্থিতিকে আরো অবনতিশীল করবে।”

ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিয়ুষ গয়াল অবশ্য এ কথা মানতে নারাজ। বরং তার যুক্তি, যেহেতু ভারত বিশ্বের বৃহৎ গম রপ্তানিকারক দেশ নয়। তাই ভারতের গম রপ্তানি বন্ধ করার প্রভাব বিশ্ব বাজারে পড়বে না।

বিষয়টি আসলেই তাই কিনা তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছে

প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভারতে এবছর গমের উৎপাদন প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। ফলে দেশের বাজারেই গমের দাম বেড়ে গেছে। দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখার যুক্তি দেখিয়ে ভারত সরকার তাই গত ১৩ মে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

যদিও ভারত বিশ্বের বৃহৎ গম রপ্তানিকার দেশ নয়। তারপরও ভারতের ওই ঘোষণার পর গমের বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে। শিকাগো বেঞ্চমার্ক হুইট ইনডেক্স প্রায় ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে।

গত কয়েকদিন ধরেই বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি দাম ছিল গত ১৭ মে থেকে ১৮ মে। ইউক্রেইন যু্দ্ধের ফলে গত মার্চ ও এপ্রিল মাস ধরেই বিশ্ব বাজারে গমের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও আকাশ ছুঁয়েছে।

ইউক্রেইন বিশ্বের শীর্ষ খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর অন্যতম। যুদ্ধের কারণে একদিকে যেমন দেশটিতে কৃষিকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী দেশটির প্রধান প্রধান সমুদ্র বন্দরের দখল নেওয়ায় সমুদ্রপথে ইউক্রেইনের রপ্তানি বাণ্যিজ বলতে গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কারণেও বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেছে। কারণ, রাশিয়া শুধু বিশ্বের শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশই নয়। বরং অন্যান্য খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় দেশটির অবস্থান প্রথম দিকেই।

যুদ্ধের কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চল থেকে গম রপ্তানি থমকে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ভারতের গমের দিকে চেয়ে ছিলেন বলে জানান জিআরও ইনটেলিজেন্স গ্রুপের কেলি গৌহারি।

ভারতের নিষেধাজ্ঞায় কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গম উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু দেশটি বিশ্ববাজারে মাত্র ১ শতাংশ গম সরবরাহ করে। কারণ, ভারতের অভ্যন্তরীন বাজারেই গমের ব্যাপক চাহিদা আছে। এছাড়া, দরিদ্র জনসাধারণের জন্য সরকারের বিভিন্ন খাদ্য প্রকল্পে এই গম ব্যবহার করা হয়।

ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার ঠিক আগে দিয়ে গম রপ্তানিতে রেকর্ড গড়েছিল। ২০২১ সালে দেশটি রেকর্ড এক কোটি টন গম রপ্তানি করে। অথচ তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে দেশটি মাত্র ২০ লাখ টন গম রপ্তানি করেছিল। তাই আশা করা হয়েছিল, ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে গম সরবরাহে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা পূরণে ভারত গত উৎপাদন ও রপ্তানি আরো বাড়াবে।

ভারত গম রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে

ভারত সরকার বলেছে, যদিও তারা গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও কিছু দেশ এখনো তাদের কাছ থেকে গম কেনার সুযোগ পাবে। এবং তারা তাদের ‘প্রতিবেশী দেশগুলোতে জরুরি প্রয়োজনের সময় সহায়তার জন্য গম রপ্তানি করবে’।

ভারতের গম মূলত যায় বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ২০১৯-২০ সালে আরব আমিরাত এবং শ্রীলঙ্কা তাদের মোট গম আমদানির ৫০ শতাংশের বেশি নিয়েছে ভারত থেকে। আর নেপাল নিয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি।

এই দেশগুলো যেসব চুক্তি আছে সেগুলোর অধীনে এখনো ভারত থেকে গম আমদানি করতে পারবে কিনা বা নতুন চুক্তি করে ওইসব দেশে ভারত গম রপ্তানি অব্যাহত রাখবে কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে মিশর বলেছে, ভারত থেকে তাদের গম কেনা অব্যাহত থাকবে। মিশর বিশ্বর বড় গম আমদানিকারক দেশের একটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ভারত সরকারকে তাদের গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করে দেখতে বলেছে।

প্রতিকূল আবহাওয়া ও সারের উচ্চমূল্য

ইউক্রেইন যুদ্ধ ছাড়াও বড় বড় গম রপ্তানিকারক কয়েকটি দেশে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপান ব্যাহত হওয়ায় বিশ্ববাজারে গমের সংকট দেখা দিয়েছে।

জিআরও ইনটেলিজেন্সের কেলি গৌহারি বলেন, ‘‘খরা, বন্যা এবং তাপদাহের ফলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ফ্রান্সের মত বড় বড় গম উৎপাদনকারী দেশের ফসল উৎপাদন ব‌্যাহত হয়েছে।”

চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম উৎপাদনকারী দেশ। গত মার্চে তারা বলেছিল, ২০২১ সালে অতিবৃষ্টির কারণে শীতে তাদের শস্য উৎপাদন ‘ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ’ হয়েছে।

তারা কী পরিমাণ ফসল ঘরে তুলতে পারবে, অতিবৃষ্টির কারণে গমের উৎপাদন ঠিক কতটা প্রভাবিত হয়েছে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

যদি উৎপাদন অনেক কম হয় তবে চীন সরকার তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে মজুদ বাড়াতে বিশ্ববাজার থেকে গম কিনতে চাইবে। এতে সরবরাহে সংকট আরো বাড়বে, পাল্লা দিয়ে দামও বাড়বে।

গত এক বছরে সারের দাম তিনগুণ বেড়ে গেছে। ফসল উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে সারের দাম দ্রুত বেড়ে যাওয়াও ভূমিকা রেখেছে এবং ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন আরো ‘উল্লেখযোগ্য মাত্রায়’ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও করা হচ্ছে।