লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে আরও

চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়া মানে হল, দেশের রিজার্ভে চাপ বাড়বে, আমদানি খরচ মেটাতে ঋণ করতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2022, 04:33 PM
Updated : 6 Dec 2022, 04:33 PM

বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে সরকার আমদানি কমিয়ে আনার নানামুখি চেষ্টা চালিয়ে গেলেও বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতি আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার (৪.৫০ বিলিয়ন)।

আগের অর্থবছরে এই সময়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি ছিল ৩৮৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর পুরো ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ১২ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার, যা দেশের হিসাবে সর্বোচ্চ।

আগের মাস সেপ্টেম্বর শেষেও চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। তার মানে হল, কেবল অক্টোবরেই ৯৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের অংক যোগ হয়েছে ঘাটতির হিসাবে।

তথ্য বিভ্রাট

গত ৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল, চলতি হিসাবের এই ঘাটতি গত নভেম্বর শেষে কমেছে, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও অক্টোবরের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজাবউল হক সেদিন বলেছিলেন, “চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে কমতে নভেম্বের শেষে ৮৯০ মিলিয়ন (৮৯ কোটি) ডলারে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া অ্যাকশনের রেজাল্টটা একেবারেই দৃশ্যমান।”

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নিজেই সেদিন ব্যাংকার্স সভায় ঘাটতি কমে আসার ওই তথ্য দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই তথ্য ঠিক থাকলে কেবল নভেম্বর মাসেই চলতি হিসাবের ঘাটতি ৪৫০ কোটি ডলার থেকে ৮৯ কোটি ডলারে নেমে আসার কথা। সেক্ষেত্রে এক মাসেই ঘাটতি কমবে ৩৬১ কোটি ডলার।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গড়ে প্রতি মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি গত কয়েক মাস ধরেই ১ দশমিক ১২ বিলিয়নের (১১২ কোটি) উপরে ছিল। সেই ঘাটতির পরিমাণ কমে ১ বিলিয়নের নিচে নেমে ৮৯০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ঘাটতি যে হারে বাড়ছিল তা কমতে শুরু করেছে।”

সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে-

• জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ১ হজার ৫৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।

• অন্যদিকে এ সময় আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছরের একই সময় থেকে আমদানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ।

• তাতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ঘাটতি ছিল ৯১৬ কোটি ডলার।

• বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ করেছিল ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে।

• চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এক মাসেই ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার।

• জুলাই-অক্টেবার সময়ে সেবা খাতেও বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়ে ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার হয়েছে। গত অর্থবছরের এই সময়ে তা ছিল ৯৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

• আর সামগ্রিক লেনদেনে (ওভার অল ব্যালান্সেস) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের আলোচিত সময়ে ঘাটতি ছিল ১৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) অবশ্য নভেম্বরের রপ্তানির তথ্যও ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে। ওই মাসে প্রথমবারের মত দেশের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়ে ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার হয়েছে। রপ্তানির ওই পরিমাণ আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২৬ দশমিক ০১ শতাংশ বেশি।

আমদানি- রপ্তানিতে সৃষ্ট বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রা। নভেম্বর মাসে প্রবাসীরা ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আর অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশে ৮৭৯ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছে।

পাঁচ মাসের এই রেমিটেন্স গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিটেন্স হিসেবে দেশে এসেছিল ৮৬১ কোটি ডলার।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে চলমান ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তন এখনও পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না।

ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবসহ নানা কারণে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি এখনো স্থিতিশীল নয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপে পড়ছে বাংলাদেশ।

এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০২ টাকা, আর খোলা বাজারে তা ১১৪ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

রিজার্ভের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে আনতে গত এপ্রিল থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে ৩০ লাখ ডলারের সম পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আর সরকারি পর্যায়ে অপেক্ষাকৃম কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সাময়িক স্থগিত রাখাসহ অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চলতি হিসাবের ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিতে। গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬০৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাণিজ্য ঘাটতি ও ডলার বিক্রি করায় কমে আসছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। ৩০ নভেম্বর শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

রিজার্ভের ওই হিসাব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। তারা বলছে, দায় বাদ না দেওয়ায় বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি দেখানো হচ্ছে।

চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকা মানেই কোনো দেশকে আমদানি খরচ মেটাতে ঋণ করতে হবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশের আমদানি দায় মেটাতে তিন মাসের সম পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হয়।

গত জুলাই-অক্টেবার সময়ে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি মাসে ৬ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এই হিসাব ধরলে বাংলাদেশের হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে অন্তত ৫ মাসের আমদানি বিল মেটাতে পারার কথা।