খোলা বাজারেও ডলার পেতে হিমশিম, দাম বেড়ে ১১৯ টাকা

একদিন ছুটির পর বুধবার এক লাফে পাঁচ টাকা বেড়ে খোলা বাজারে ডলারের দর ১১৯ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2022, 06:31 PM
Updated : 10 August 2022, 06:31 PM

ঢাকার মিরপুরে একসঙ্গে ৫০০ ডলার না পেয়ে পল্টনে এসেছিলেন পল্লবীর মো. আসাদুল ইসলাম। এতটা পথ পেরিয়ে এসেও লাভ হল না, প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করতে পারলেন না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঢাকার এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘এখানেও বলছে ২০০ এখন দেবে আর বাকিটা বিকালে নিতে হবে। তাতে রাজি হলেও এখনকার দরের চেয়ে বিকেলের দর আলাদা হবে।’’

জানালেন পল্টনের কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ ১১৯ টাকায় তার কাছে ডলার বিক্রির প্রস্তাব করেছে। কী করবেন তা নিয়ে দোটানায় ছিলেন তিনি।

স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুর যেতে ৫০০ ডলার লাগবে তার। এত অল্প ডলারে ভ্রমণ কিভাবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসায়িক অংশীদাররাই সেখানকার সব খরচ বহন করবেন। শুধু হাত খরচের জন্য এটুকু নিলেই চলবে।

তার মতই বিপাকে পড়েছেন শান্তি নগরে বসবাসকারী ব্যবসায়ী মো. নাজমুল হোসেন। তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পুত্রবধুর জন্যও প্রয়োজন ৫০০ ডলার। সোমবার থেকে দুদিন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে কিনতে পেরেছেন ২০০ ডলার।

সোনালী ব্যাংকের শাহবাগ শাখা থেকে এ পরিমাণ ডলার কিনতে পারার কথা জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘ম্যানেজার সাহেবকে অনুরোধ করার পরও তিনি ২০০ ডলারের বেশি দিলেন না।’’

ব্যাংকে ১০৪ টাকায় কিনতে পারলেও সোমবার খোলা বাজারে গিয়ে দেখলেন দর উঠেছে ১১৪ টাকায়। তাও ২০০ ডলারের বেশি কেউ দিতে পারেনি।

স্বল্প পরিমাণে ডলার সংগ্রহেই যেখানে এমন সংকট সেখানে যাদের বেশি পরিমাণ দরকার তারা নানা জায়গায় ধর্ণা দিয়েও পাচ্ছেন না।

নগদ ডলার কেনাবেচার খোঁজখবর নিতে গিয়ে গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, ‘অনেক বেশি’ পরিচয় থাকলেই শুধু ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ থেকে বেশি পরিমাণ ডলার কিনতে পারছেন কেউ কেউ। বাড়তি দর দিতে চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তারা।

এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার সরকারি ছুটির পরদিনই খোলা বাজারে ডলারের দর এক লাফে পাঁচ টাকা বেড়ে ১১৯ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

সরবরাহ সংকটে ক্রমাগত চড়তে থাকা ডলারের বাজারের অস্থিতিশীলতা ও মজুদের পেছনে কারসাজিকারকদের হাত রয়েছে কি না তা যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিদর্শন ও অভিযানের পর দৃশ্যত বড় অঙ্কের ডলারের হাতবদল কমে গেছে।

পরিচিত ও যাচাই বাছাই ছাড়া কেউ বেশি পরিমাণে ডলার কিনতে বা বিক্রি করতে আসছেন না বলে জানিয়েছেন মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কর্মীরা।

গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি তুলে ধরে বুধবার পল্টনের নিউ জনতা মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রয় কর্মী আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আজ আমাদের কাছে একজন মাত্র ডলার বিক্রি করতে এসেছিলেন। ১১৫ টাকা দরে কিনেছিলাম ১০০ ডলার।

‘‘১১৬ টাকায় বিক্রি করেছি। তারপর আর কোনো ডলার বিক্রি করতে আসেনি কেউ। বিকেলেই দাম অনেক উপরে উঠে গিয়েছে। এখন ডলার কেনাবেচা বন্ধ রেখেছি। এত দামে ডলার কিনে কার কাছে বিক্রি করব?’’

একই অবস্থা মেক্সিমকো মানি এক্সচেঞ্জেও। এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেইন বলেন, ‘‘আমার সব কাস্টমার যারা নিয়মিত ডলার নেয়, তাদের বলেছি অপেক্ষা করতে। দর এক জায়গায় না টেকা (স্থিতিশীল হওয়া) পর্যন্ত দেখতে বলেছি।

“আর আমি পাসপোর্ট ছাড়া ডলার বিক্রি করছি না। আজ (বুধবার) ১০ জন আসছিল ডলার কিনতে ৯ জনই পাসপোর্ট ছাড়া।’’

মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন শিকদার

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এখন অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে রেখেছেন অভিযানের ভয়ে, এটি সাময়িক। ডলার বেশির ভাগ চলে গিয়েছে মৌসুমীদের কাছে। অভিযান হওয়ায় তারা বাজারে নেই।

‘‘এতে ডলার সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। আবার ব্যাংকও দিচ্ছে না। এতে দাম বেশি বেড়েছে। কয়েকদিন লাগবে বাজারে ডলার আসতে।’’

বুধবার যখন এমন অবস্থা তখন মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকা থেকে পল্টনে এসেছিলেন মো. ইমরানুল হক। সন্ধ্যায় কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে তার কাছে দর চেয়েছে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৯ টাকা।

তিনি বলেন, ‘‘রুটিন চেকআপ করতে ভারতের চেন্নাই যাব মাসের শেষের দিকে। দাম বাড়তি দেখে আসলাম ২০০ ডলার কিনতে। টিকিট তো টাকা দিয়েই কিনবো। তাই বেশি ডলার লাগবে না।

‘‘কিন্তু দাম চাচ্ছে ১১৯ টাকা করে। বাইরের ফুটপাতে ও মার্কেটের ভেতরে একই দাম। এখন আর কিনব না। দেখি দাম কমে কি না, বাড়লে তো যাওয়ার সময়ে বেশি দামেই কিনতে হবে।“

আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকায় ডলারের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত বিক্রি এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের পরেও ঊর্ধগতিতে ছুটছে ডলারের দাম।

দর নিয়ন্ত্রণে নীতি সহায়তাসহ ছাড় দিয়েও যখন কাজ হচ্ছে না তখন অনিয়ম, মজুদ ও কারসাজির খবরে খোলা বাজারে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন অভিযান চলার মধ্যেই এ বাজারে দাম উঠেছে ১১৯ টাকায়।

অভিযানে নেমেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও। এতে মৌসুমী ও ফারিয়ারা আড়ালে চলে যাওয়ায় ডলার সরবরাহে ‘ভিন্ন মাত্রা’ যোগ হয়েছে বলে মনে করছেন মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, এক্সচেঞ্জগুলোর বাইরে মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় যারা একেবারে খুচরা পর্যায়ে যারা ডলার কেনাবেচা করতেন তাদের বেশির ভাগই

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছেন। তাদের কাছে ডলার মজুদ রয়েছে। তারা বিক্রি করছেন না। ফলে জরুরি প্রয়োজনে যারা ডলার নিতে আসছেন তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

গত সপ্তাহে ৪২টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘কারণ দর্শানোর নোটিস’ দেওয়া এবং ১১টির বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মামলা করার নির্দেশনা দেওয়ায় সবাই এখন সতর্ক। দৃশ্যত নিয়ম মেনে সবাই লেনদেনের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।

খোলাবাজারের মত ব্যাংকেও নগদ ডলারের এবং এলসি নিষ্পত্তি ও খোলায় আগের চেয়ে বেশি দাম দিতে হচ্ছে।

বুধবার সিটি ব্যাংক নগদে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করেছে। আরও কয়েকটি ব্যাংকের দরও ছিল এমনই। ওয়ান ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, তারা নগদে প্রতি ডলার ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। এনআরবি ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা বিক্রি করেছে ১০৭ টাকা দরে।

অপরদিকে ডলারের চাহিদা মেটাতে ১০৯-১১০ টাকা দরে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের কাছ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এজন্য বেশি দামেই বিক্রি করছেন বলে তারা জানিয়েছেন।

ডলারের এমন উঠা-নামার মধ্যেই সোমবার পাঁচটি দেশি ও একটি ব্হুজাতিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তাদের অপসারনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ট্রেজারি অপারেশনে অতিরিক্ত মুনাফা করায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনার একদিন পর বুধবারও ব্যাংকগুলোর ডলার চাহিদা মেটাতে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর গত সোমবার ডলারের দর আগের চেয়ে ৩০ পয়সা বাড়ানোর মাধ্যমে টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আরও পড়ুন

Also Read: অস্থির ডলার বাজারে মানি এক্সচেঞ্জে ক্রেতা কম

Also Read: ডলার সঙ্কট: ৬ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি

Also Read: ডলারে অনিয়ম: ৮০ মানি চেঞ্জারে গিয়ে ৪২টিকে ‘শো কজ’

Also Read: ৩ মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত, ১১টির বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

Also Read: ব্যাংকের রেমিটেন্স আনা সহজ করতে নীতিমালায় ছাড়

Also Read: ডলারের দামে 'কিছু কারসাজি' চিহ্নিত: অর্থমন্ত্রী

Also Read: ডলার মজুদ করলে কঠোর ব্যবস্থা: ডিবি

Also Read: ডলার ফের ছুঁয়েছে ১০০ টাকা