মূল্যস্ফীতি শঙ্কার, তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়: অর্থমন্ত্রী

“আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা খাবার বন্ধ করতে পারব না। আমদানিতে কোথায় কোথায় ছাড় দিতে হয়- তা দিচ্ছি,“ বলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2023, 04:05 PM
Updated : 2 June 2023, 04:05 PM

মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের কারণে ‘খুব খারাপ সময়ের’ মুখোমুখি হওয়ার কথা তুলে ধরলেও বছর শেষে তা প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে বলে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল।

অর্থনীতিবিদদের মতো মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কার কথা প্রকাশ করলেও অর্থনীতিকে চাপে রাখা এ সূচক নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন তিনি।

আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে থাকার যে উচ্চাশা অর্থমন্ত্রী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করেছেন তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না বলে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন একাধিক অর্থনীতিবিদ।

শুক্রবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ঘুরেফিরে একাধিক সাংবাদিকের থেকেও প্রশ্ন আসে মূল্যস্ফীতি নিয়ে। প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনি যে তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখেছেন তার মধ্যে মূল্যস্ফীতিও একটি বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।

সংবাদ সম্মেলনে এর পুরোটাই আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে হয়েছে দাবি করে মুস্তফা কামাল বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।“

মূল্যস্ফীতির মতো বাজেটের অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন অর্থনীতিবিদদের চোখে কঠিন ঠেকলেও ‘অতীতের ধারাবাহিকতায়’ সফলতা অর্জনে দৃঢ়ভাবে আশার কথা প্রকাশ করেন তিনি।

 “আমরা ফেইল করি নাই। ইনশাআল্লাহ এবারও ফেইল করব না, আগামীতেও আমরা ফেইল করব না। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”

Also Read: ফেইল করিনি, এবারও করব না: অর্থমন্ত্রী

Also Read: বাজেট আইএমএফের শর্ত মেনে নয়: অর্থমন্ত্রী

Also Read: নির্বাচন আর বাজেট, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা ‘অচল’: অর্থমন্ত্রী

সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও মূল্যস্ফীতি নিয়ে কথা বলেন।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ দুই মাসে ৯ শতাংশের বেশি হারে মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবন জেরবার হওয়ার মধ্যে তা আগামী অর্থবছর শেষে ৬ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করে গত বৃহস্পতিবার বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

মূল্যস্ফীতির বিশাল এ ধাক্কা সামলে অর্থনীতি গতিশীল করার মাধ্যমে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারের উচ্চাশার কথাও ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরার সময় বলেন তিনি। দুই লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সামাল দিতে রেকর্ড ব্যাংক ঋণ নেওয়ার মধ্যেও মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।

একই সঙ্গে বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, ডলার সংকটে টাকার অবমূল্যায়নের মতো প্রেক্ষাপটে সরকার যখন আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, সেই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার বিষয়টি বাজেট পরবর্তী আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে।“

আর এদিন সংবাদ সম্মেলনে একাধিক প্রশ্ন আসে এ নিয়ে। এর একটির উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আইএমএফ বলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমছে। আমরাও বিশ্বাস করি দেশেও দাম কমে যাবে।‘’

দেশের ও বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এজন্য আমরা একটা ফ্লেক্সিবল ওয়েতে এগোচ্ছি। যেসব কারণে এটি হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা খাবার বন্ধ করতে পারব না। আমদানিতে কোথায় কোথায় ছাড় দিতে হয়- তা দিচ্ছি।“

অতীতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এক সময়ে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশে ছিল। আমরা সেখান থেকে নামিয়ে ৬ শতাংশে এনেছিলাম। আগামীতেও বাজেটে নেওয়া লক্ষ্যমাত্রার ৬ শতাংশে নামবে।’’

শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এ সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য বাজেটে ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১০ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে; এপ্রিলে একক মাসে তা দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির উচ্চ এ হারের মধ্যেও সরকার আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে, যা আগের বারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি।

সরকারের ঋণ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতির যে উচ্চ হার তা মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণে নয়। ডলার বেচতে গিয়ে দুই লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে এসেছে। আমাদের রিজার্ভ মানি জিডিপির তুলনায় এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ব পর্যায়ে। সরকার ঋণ নিলে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।

‘‘জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে তা আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির কারণে। আমরা যদি সরবরাহ দিকটি ঠিক রাখতে পারি তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’’

তিনি বলেন, “এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি।“