রিটার্ন দিলেই ২০০০ টাকা কর কেন, ব্যাখ্যা দিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান

তিনি বলছেন, যাদের ক্ষেত্রে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক, সেই শ্রেণির মানুষদের জন্য এই ন্যূনতম কর বোঝা হওয়ার কথা নয়। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2023, 10:24 AM
Updated : 2 June 2023, 10:24 AM

করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনের বিপরীতে দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর আদায়ের প্রস্তাবটিকে কেউ কেউ বৈষম্যমূলক বললেও এ নিয়মে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে না বলে মনে করছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

তিনি বলছেন, যাদের ক্ষেত্রে টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক, সেই শ্রেণির মানুষদের জন্য এই ন্যূনতম কর বোঝা হওয়ার কথা নয়। 

শুক্রবার বিকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট প্রস্তাবে তিনি বলেন, “অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণ দেশের জনসাধারণের মাঝে সঞ্চারণের লক্ষ্যে করমুক্ত সীমার নিচে রয়েছে, অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে-এমন সকল করদাতার ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি।”

এর প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার এক বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার বিষয়টি ‘ভালো’ হলেও ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করারোপের প্রস্তাবটি ‘বৈষম্যমূলক’। 

“কারো যদি আয় সাড়ে তিন লাখের নিচেও হয়, তাহলে সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিন লাগবে। করযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে।

“মানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার উপর দুই হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা খুঁজে পাই না।”

তিনি বলেন, “যে কর দেওয়ার যোগ্য, ক্ষমতা-আয় আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নাই তার ওপর আবার বসিয়ে দিলাম। এটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক না। এটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবে। ফল মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেল।”

বিকালে অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নূন্যতম করের বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন একজন সাংবাদিক। অর্থমন্ত্রী তখন এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে উত্তর দিতে বলেন।

আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, “আমি আগে রিকোয়েস্ট করব আপনাদের, কাদের টিআইএন থাকতে হয়, টিআইএন বাধ্যতামূলক কাদের, সিই লিস্টটা যদি সামনে নেন, তাহলে সেখানে দেখবেন টিআইএন বাধ্যতামূলক আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ট্রেড লাইসেন্সধারীর জন্য, কমিশন এজেন্সির জন্য। টিআইএন বাধ্যতামূলক পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য। সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি, গাড়ির জন্য। 

“আপনি যেটা বললেন, সাধারণ গরিব মানুষের কোনো অসুবিধা হবে কি না, সাধারণ গরিব মানুষেরতো টিআইএন বাধ্যতামূলক নয়।”

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমি যে ক্যাটাগরিগুলো বললাম, আপনারা লিস্টে দেখবেন, এই ধরনের ক্যাটাগরিতে যে মানুষগুলো আছে, তাদের জন্য দুই হাজার টাকা বছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে উন্নয়নের অংশীদার হওয়া, এটি একটি গর্বের বিষয় হওয়ার কথা। বোঝা মনে করার কথা নয়।”   

Also Read: রিটার্ন দাখিলে দিতে হবে অন্তত ২০০০ টাকা, প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর

Also Read: বাজেট ‘সময়োপযোগী হয়নি’, দুই হাজার টাকা ন্যূনতম কর ‘অযৌক্তিক’: সিপিডি

যে যে সেবা পেতে টিআইএন বাধ্যতামূলক

গত অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ৩৮টি সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দেওয়ার প্রাপ্তিস্বীকার পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়। সেবাগুলো হল–

  • পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে;

  • ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার আবেদন করলে;

  • ব্যাংক জমার সুদ আয় থেকে উৎস কর কর্তনে টিআইএন সনদ থাকলে ১০ শতাংশ কাটা হয়ে থাকে। না থাকলে ১৫ শতাংশ কাটা হয়। এখন থেকে টিআইএনের পরিবর্ততে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে;

  • সিটি করপোরেশন, জেলা সদরের পৌর এলাকা অথবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি, বিক্রি, দলিল হস্তান্তর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে হলে;

  • যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে;

  • গাড়ি ক্রয়, মালিকানা পরিবর্তন: দুই বা তিন চাকা ছাড়া যেকোনো মোটরগাড়ি নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়ন করতে;

  • সিটি করপোরেশন বা জেলা সদর, পৌরসভায় সন্তান বা পোষ্যদের আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বা জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতায় ইংরেজি ভার্সনে ভর্তি করাতে হলে;

  • দেশের যেকোনো স্থানে বাণিজ্যিক বা শিল্প কারখানায় গ্যাসের সংযোগ নিতে হলে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় বাসা বাড়ির গ্যাসের সংযোগ নিতে বা আগের সংযোগ বজায় রাখতে হলে;

  • সিটি করপোরেশন বা সেনানিবাস এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হলে;

  • জমি বা বাড়ি ভাড়া দিয়ে অনেকে আয় করে থাকেন। আয় যাই হোক না কেন, এই ধরনের আয়ের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

  • সরকার বা সরকারি কোন সংস্থা, করপোরেশন থেকে বেতন হিসাবে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা বা বেশি হলে;

  • বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নেয়ার সময়;

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অংশ বা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আয় মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি হলে;

  • ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী শহরে ভবন নির্মাণের অনুমোদন চাইলে;

  • জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলায় কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে;

  • পেনশন ফান্ড, অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি ফান্ড, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড, অনুমোদিত সুপারএন্যুয়েশন ফান্ড এবং শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ছাড়া অন্যান্য ফান্ডের রিটার্ন দাখিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।

  • সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন করতে হলে;

  • ডিজিটাল প্লাটফর্মে কোন পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে হলে;

  • মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা ইলেকট্রনিক উপায়ে অর্থ হস্তান্তরে কমিশন, ফি জাতীয় অর্থ পেতে;

  • সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের আওতায় কোনো সমিতি বা ক্লাব গঠিত হলে বা এ ধরনের ক্লাবের সদস্য হলে;

  • ডাক্তার, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি ইত্যাদি পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য হলে বা সদস্য হতে চাইলে;

  • পরামর্শক, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনবল বা নিরাপত্তা সেবা দিয়ে অর্থ গ্রহণ করতে;

  • বিবাহ নিবন্ধক বা কাজী হিসাবে লাইসেন্স পেতে চাইলে;

  • আমদানি-রপ্তানির সনদ পেতে চাইলে;

  • আমদানির এলসি খুলতে চাইলে;

  • কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার পদ পেতে হলে;

  • ব্যবসা বা বাণিজ্য সংগঠনের বা সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ;

  • বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে তালিকাভুক্তি বা নবায়ন করতে হলে;

  • বীমা বা সার্ভেয়ার হিসাবে নিবন্ধন নিতে হলে;

  • অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়ার আবেদন করলে;

  • ওষুধ ব্যবসার জন্য ড্রাগ লাইসেন্স থাকলে বা করাতে চাইলে অগ্নি-নিরাপত্তা লাইসেন্স,

  • পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স পেতে চাইলে;

  • লঞ্চ, স্টিমার, ট্রলার, কার্গো, বার্জ ইত্যাদি নৌযানের সার্ভে সার্টিফিকেটের জন্য;

  • ইটভাটার অনুমোদন নিতে হলে পরিবহন সেবার ব্যবসা করলে;

  • কোনো কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টশিপ চাইলে;

  • পণ্য সরবরাহের ঠিকাদারি কাজে টেন্ডার জমা দিতে হলে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দিতে হবে;

  • এনজিও বা মাইক্রো ক্রেডিট সংস্থার জন্য বিদেশি অনুদানের ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।