Published : 03 Nov 2022, 08:28 PM
সন্তান হিমাদ্রী মজুমদার হিমু হত্যা মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড উচ্চ আদালতে বহাল থাকলেও বাকি দুই আসামি খালাস পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে আতঙ্কিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন তার মা-বাবা।
ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।
জজ আদালত যে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, তাদের মধ্যে জাহিদুর রহমান শাওন, জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ ও মাহবুব আলী ড্যানির সাজা বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।
এই তিনজনের মধ্যে শাওন জামিন নিয়ে এবং রিয়াদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
জজ আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া শাহ সেলিম টিপু ও শাহাদাত হোসেন সাজুকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা বলেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা হতাশ। ফাঁসির আসামির ন্যূনতম সাজাও হলো না, সরাসরি খালাস পেল। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে ড্যানি ছাড়া বাকি দু’জনও পলাতক।
“গত ১০ বছরেও তাদের আইনের আওতায় আনা গেল না। মামলা যতদিন চট্টগ্রামে নিম্ন আদালতে ছিল, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। উচ্চ আদালতে যাবার পর আর তেমন কিছু করতে পারিনি। আমাদের মত সাধারণ মানুষ আর কীই বা করতে পারব।”
মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল বন্দর নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে হিমুকে ধরে নিয়ে যায় আসামি শাওন, রিয়াদসহ কয়েকজন। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সদ্য ‘এ’ লেভেল পাস করা হিমুর বয়স তখন ১৮ বছর।
আসামিরা তাকে ধরে পাঁচলাইশ এলাকায় আসামি রিয়াদের বাবা ব্যবসায়ী শাহ সেলিম টিপুর বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে মারধরের পর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে ও ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়।
হাসপাতালে ২৬ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছরের ২৩ মে মৃত্যু হয় হিমুর। ওই ঘটনায় হিমুর মামা শ্রী প্রকাশ দাশ অসিত বাদী হয়ে শাওন, রিয়াদ, সাজু, ড্যানি ও রিয়াদের বাবা ব্যবসায়ী শাহ সেলিম টিপুকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন।
২০১৬ সালের ১৪ অগাস্ট চাঞ্চল্যকর এ মামলার পাঁচ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ নুরুল ইসলাম।
মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের নিয়ম অনুযায়ী ওই বছরই মামলার সব নথিপত্র আসে হাই কোর্টে। এদিকে দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন আসামিরা। দীর্ঘদিন শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার এই রায় হল।
হিমুর মা গোপা মজুমদার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “মামলার প্রধান আসামি ছিল শাহ সেলিম টিপু। জজ আদালতে ফাঁসির দণ্ডিত আসামির তো কিছু হলেও শাস্তি হওয়ার কথা। সেই আসামি বেকসুর খালাস কিভাবে পায়!
“আমার ছেলেকে টিপুর নির্দেশেই তার ভবনের ছাদে নিয়ে আটকে রাখা হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় সীমাহীন বর্বরতা চালিয়ে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। মাদকের প্রতিবাদ করা যদি অপরাধ হতো, আমার ছেলেকে তারা পুলিশে দিতে পারত। খুনের হুকুমদাতা টিপু।”
খালাস পাওয়া দুই আসামিকে নিয়ে আতঙ্ক বোধ করার কথা জানিয়ে গোপা মজুমদার বলেন, “তারা হিংস্র ছোবল মারতে পারে। আমরা কীভাবে নিরাপদ থাকি? আমার এক ছেলেকে হারিয়েছি। মামলা চালাতে গিয়ে আমরা আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি।
“আমার ছোট ছেলেকেও নিরাপত্তার কারণে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের এখন আর্থিক বা অন্য কোনো সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই। তাদের অনেক টাকা।”
গোপা মজুমদার কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “গত ১০ বছর আমরা এক অভিশপ্ত জীবন কাটিয়েছি। এটা কী একটা জীবন? আমরা সংখ্যালঘু পরিবার। এখন একটাই চিন্তা, ছোট ছেলেটাকে কিভাবে নিরাপদে রাখতে পারি।”
বৃহস্পতিবার আপিলের রায় ঘোষণার বিষয়টি সকালে প্রথম গণমাধ্যম কর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারেন বলে জানান গোপা মজুমদার।
তিনি বলেন, “আমরা লেগে থাকতে পারলে হয়ত নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকত। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করে তা আর সম্ভব হয়নি। আজ রায় হবে- সেটাও আমাদের আগে জানানো হয়নি।
“তবে এখনও পর্যন্ত যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে- সেজন্য সৃষ্টিকর্তা, মিডিয়া ও রাষ্ট্রপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। মিডিয়া না থাকলে ১০ বছর আগেই হিমু হত্যা মামলা তলিয়ে যেত।”
আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে দুই আসামির খালাসের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান গোপা।
বিচারিক আদালতে দণ্ডিত সাজু ও টিপুর খালাসের বিষয়ে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমদ হিরু বলেন, “অপরাধ সংঘটনের সময় তাদের উপস্থিতি সাক্ষ্য-প্রমাণে আসেনি, যে কারণে তাদের খালাস দিয়েছেন।”
রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “শিকড় নামে একটি মাদকবেরোধী সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল হিমাদ্রী। এরকম একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকে হিমাদ্রী কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড চালাতেন। সে একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী ছিল। তার এই সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকে ভালোভাবে নেয়নি প্রভাবশালী মহল।
“যে কারণে হিমাদ্রীসহ সংগঠনের অপরাপর অনেকেই হুমকি পেয়েছে। হুমকি পাওয়া অনেকেই থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তারপরও প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের থাবা থেকে রেহায় পায়নি হিমাদ্রী।”
কুকুর লেলিয়ে হত্যায় ৫ আসামির ফাঁসির রায়
বার বার বিলম্বিত হিমু হত্যার বিচার