অনূদিত গল্প
Published : 06 May 2025, 10:47 AM
কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাক। তার প্রথম ইংরেজি অনুবাদবই ‘হার্ট ল্যাম্প: সিলেক্টেড স্টোরিজ’ ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দীপা ভাস্তির অনুবাদে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে ১২টি ছোটগল্প, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনসংগ্রাম, কষ্ট আর আত্মমর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে।
বানুর গল্পে নারী শুধু নিপীড়িত নয়—প্রতিবাদী, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলের ভেতর থেকেও নারীরা কীভাবে নিজেদের শক্তি খুঁজে পায়, সেটাই তার লেখার মূল বিষয়। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পে এক স্বামীর অন্যত্র বিয়ের পর মেয়ের চোখে উঠে আসে মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা। সরল ভাষায় লেখা হলেও বানুর গল্পগুলো গভীর আবেগ ছুঁয়ে যায়। আজ প্রকাশিত হল তার দ্বিতীয় পর্ব।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া বানু মুশতাক একজন আইনজীবী ও অধিকারকর্মী। তিনি কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৯) এবং পেন ইংলিশ ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড (২০২৪) পেয়েছেন।
মা ব্যথিত গলায় প্রতিবাদ করলেন, ‘ফলের বোঝা কখনও লতায় বোঝা হয়, মেহর? এই সব বাজে কথা বলিস না।’ বড় ভাই গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আম্মা, ওকে ভেতরে নিয়ে যাও। কিছু খেতে দাও। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে চিকমাগলুরের উদ্দেশে রওনা হব। বাস পেলে বাসে যাব, নাহলে ট্যাক্সি ভাড়া করব। ওর ইচ্ছেমতো নাচতে পারব না আমরা।’
মেহরুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমি তোমাদের ঘরে একফোঁটা জলও খাব না। আর আমি চিকমাগলুরও যাব না। জোর করে নিয়ে গেলে, কথা দিলাম, নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেব।’ বড় ভাই কঠোর হয়ে উঠলেন, ‘এটা বাড়াবাড়ি, মেহর। যারা মরতে চায়, তারা মুখে ফিসফিস করে বেড়ায় না। যদি পরিবারের ইজ্জতের এতটুকু খেয়াল থাকত, তাহলে এখানে এসে কান্নাকাটি না করে আগেই চুপচাপ কাজ শেষ করে ফেলতিস। নারীর জীবন তো এমনই, মেহর, যে দুলিতে চড়ে আসে, সে দুলি থেকেই একদিন বিদায় নিতে হয়। তোর একটা মেয়ে আছে, স্কুলে পড়ে। তোর দুই বোন আছে, তাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। একটিমাত্র ভুলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। তুই বলছিস আমরা তোর আবেগের কথা শুনে গিয়ে তোর স্বামীর সাথে ঝগড়া করবো? আমাদেরও তো সংসার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে। তাই চুপ করে ভেতরে যা, কিছু খেয়ে নে।’
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমান, তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ডেকে আন।’ পরে আবার মেহরুনের দিকে ফিরল, ‘আর তুই, মেহর, যদি তোর ছেলেমেয়েরা বা পাড়া-প্রতিবেশী কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবি বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিস। কখন রওনা হয়েছিলি?’ মেহরুন কিছু বলল না। আমান বলে উঠল, ‘এখন সাড়ে ন’টা বাজে। ও যখন এসেছে তখন ঠিক ৯টা। তিন ঘণ্টার রাস্তা। তাহলে সকাল ছ’টায় রওনা দিয়েছে।’ বড় ভাই বলল, ‘এই মুহূর্তে বেরোলে, বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।’
মেহরুন নড়ল না। যেখানে বসেছিল, সেখানেই জমে রইল। মা আর ছোট বোনেরা পালা করে এসে অনুনয় করল, ‘কিছু খা মা, একটু জল খা।’ কিন্তু সে মুখে একটুকরো খাবারও তুলল না, একফোঁটা জলও খেল না। ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। মেহরুন কারও সাথে কথা বলল না। শিশুটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে, দুই বড় ভাইয়ের পাশে পাশে চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে এল। কাউকে বিদায় জানাল না। শুধু শেষ সিঁড়ি বেয়ে নামার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল।
যে বাড়িতে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই ঘরটাকে শেষবারের মতো দেখল। চোখের কোণে পানি জমল। ভেতরে বাবা বুকে হাত চেপে ধরে কাশছিলেন। মা হু হু করে কাঁদছিলেন, কখনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কখনো স্বামীর দিকে; কখনো বাবাকে শুইয়ে দিচ্ছিলেন, কখনো বাতাস করছিলেন, আবার কখনো পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। আর আপন মনে বিড়বিড় করছিলেন, ‘হে আল্লাহ, জীবনে যদি কোনো সওয়াব কামাই করে থাকি, আজ তার বিনিময়ে আমার মেয়ের জীবন ঠিক করে দাও।’
আমান গাড়ির দরজা খুলে চোখের ইশারায় মেহরুনকে উঠতে বলল, মুখের কোণে অসন্তোষের গুঞ্জন। মেহরুনের মনে পড়ে গেল, কতোবার সে গর্ব করে বলেছিল, ‘আমার ভাইয়েরা আছে। তারা সিংহের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইনায়াত যদি একচুল এদিক-ওদিক করে, ভাইয়েরা টুকরো টুকরো করে ফেলে দেবে।’ কিন্তু আজ সেই গর্ব মুছে গেছে। ভাইয়ের কথাগুলো কানে বাজছিল: ‘পরিবারের ইজ্জত বাঁচানোর বুদ্ধি যদি থাকত, তবে নিজেই আগুন দিয়ে শেষ করে ফেলতিস। এখানে এসে আমাদের মুখ পুড়াতিস না।’
গাড়িতে উঠতে উঠতে সে আর পেছন ফিরে তাকাল না, না মায়ের দিকে, যে হয়তো জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন; না বোনদের দিকে, যারা পর্দার আড়াল থেকে তাকিয়ে ছিল; না বৌদিদের দিকে, যারা হয়তো ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল।’ কিন্তু চোখের জলে বোরখার নিচে ভিজে যাচ্ছিল মুখ। সে ঠোঁট কামড়ে ছোট ছোট কান্না চেপে বসে রইল। গাড়ি দ্রুত ছুটছিল। কেউ কথা বলছিল না। ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসেছিল আমান, পাড়া থেকে ডাকা ড্রাইভার। তার সামনে কি পারিবারিক গোপন কথা বলা যায়?
চলার পথ ছিল নীরব। সে ছিল ইনায়াতের প্রেম আর ভোগের খেলায় এক টুকরো পাশা, পুরো ষোলো বছর ধরে। আর তারপর, ষোলো বছরের শেষে, ইনায়াত অপমান করেছিল তার নারীসত্তাকে। বলেছিল, ‘শুয়ে থাকো মরার মতো। কী সুখ পেয়েছি তোমায় পেয়ে? পোশাক দিয়েছি, আহার দিয়েছি, আর কী দিইনি? এখন আমার সুখ যেখানে, আমি সেখানে। কে আমায় আটকাবে?’
গাড়ি থামার আগে পর্যন্ত সে গাছ দেখেনি, পথ দেখেনি, কিছুই অনুভব করেনি। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে এক অচেনা বাড়ি, বলে দেওয়া হয়– এটাই তার। এক শুকিয়ে যাওয়া মুখের তরুণী ছুটে আসে, বলে, ‘আম্মি! ফিরেছ অবশেষে। কত চিন্তায় ছিলাম!’ তার হাত থেকে শিশুকে নিয়ে, বুকে আঁকড়ে ধরে, দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। মেহরুন ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর পা রাখে। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ছোটরা স্কুলে গেছে। ষোলো বছরের সালমা, যে মায়ের দুঃখ বুকে নিয়ে বড় হয়েছে, আজ ঘরে বড়জন। ভাইবোনদের পাঠিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল মায়ের জন্য।
মাকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মায়ের সঙ্গে মামাদের দেখে আশা জাগে মনে – তারা নিশ্চয়ই সেই অন্য নারীকে চুলের মুঠি ধরে তাড়িয়ে দেবে। সে হরিণছানার মতো ছুটে বেড়ায়, মামাদের খাবার দেয়, চা ফুটায়। মেহরুন তার ঘরে শুয়ে ছিল। সালমা আসে, মায়ের মুখের অশ্রু মুছে দেয়, দু-চার গাল খাইয়ে দেয়, তারপর থালাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসে। সে দৌড়ে আবার ঘরে ফেরে। ‘আম্মি, আম্মি, আব্বা এসেছে।’
মেহরুন কিছু শোনেনি যেন। আরও গুটিয়ে নেয় নিজেকে চাদরের ভেতর। মাথার শিরাগুলো টনটন করে। সালমা বাইরে বেরিয়ে যায়। মামারা চলে গেছে। পুরুষদের কথাবার্তা, হাসাহাসি, সালামের আওয়াজ ভেসে আসে বাইরে থেকে। ‘আরে ভাইয়া! কখন এলেন?’ ইনায়াত জিজ্ঞেস করল।
‘এইতো, একটু আগে এলাম। তুমি কেমন আছ?’
‘আল্লাহর কৃপায় ভালো আছি, আর আপনাদের দোয়ায়।’
আমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল: ‘কোথায় ছিলেন ইনায়াত ভাই?’
‘এই, এদিক-ওদিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে সারা দিন ঘরে বসে থাকা চলে নাকি? সালমা!’ সে ডাক দিল, ‘সালমা, আম্মি কোথায়? দেখো তো, কারা এসেছে। বলো, আম্মিকে বের হতে।’
ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়া এল না। ‘কোথায় যে গেল,’ ইনায়াত বলল। ‘শিশুকে নিয়ে ভেতরে আছে বোধহয়। দাঁড়াও, আমি নিজেই দেখি।’ সে ভেতরে এসে সালমাকে দেখতে পেল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কখন এলো এরা? আম্মি কোথায়?’ তার মনে সন্দেহের সরু সুতোর মতো কিছু একটুর জন্ম হলো। সালমা চালাকির সঙ্গে বলল, ‘মামারা এই আসল। আম্মি এখনো ঘুমাচ্ছে।’
ইনায়াত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ‘এখনো জাগেনি? কী হলো ওর?’ সে গিয়ে দাঁড়াল শোবার ঘরের দরজায়। মেহরুনের জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে থাকা দেখে তার মনে ঘৃণা জাগল। ওর একমাত্র পরিচয় , ও তার সন্তানের মা। চাইতেও পারল না, পা আর এগোল না ভেতরে। মেহরুন কল্পনা করছিল, কেমন দাঁড়িয়ে আছে সে দরজায়, তার জামাকাপড়ের গন্ধ, সিগারেটের দুর্গন্ধ, শরীরের ঘাম, বার্ধক্যের চিহ্ন, বড় বড় চোখ। যে পুরুষ তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছাপ রেখে গেছে, সে আজ তার কাছে এক অচেনা মানুষ। সে শক্ত করে চাদর মুড়ে শুয়ে রইল, কেবল কানে এলো তার কণ্ঠস্বর, ‘সালমা, এখানে এসো। বল তোমার আম্মিকে, এত নাটক বন্ধ করতে। ভাইদের ডেকে এনে যদি আমাকে বোঝাতে চায়, তবে নিজের গলায় দড়ি দিচ্ছে। এক নিঃশ্বাসে, এক, দুই, তিনবার,বলব, শেষ করে দেব। বলো, তালাকের পর দেখবে কেমন করে বোনদের আর মেয়েদের বিয়ে দেবে। বলো তাকে, তোমার মাকে, সে পরিবারের সম্মান ডোবাচ্ছে সবার সামনে।’
‘যাক, ভাইদের সালাম দিক, জিজ্ঞেস করো , মুরগি না খাসি খাবে? দুপুর তো প্রায় হয়ে এল, রান্না শুরু করুক তাড়াতাড়ি।’ সালমা তখন আর কাছেও ছিল না, তবু ইনায়াত নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল যেন তাকে শোনাতে। ইনায়াত আর তার শ্যালকরা যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে আড্ডা চালাতে লাগল। কখনও কফির দামের কথা, কখনও কাশ্মীরের নির্বাচন, কখনও পাড়ার এক বৃদ্ধ দম্পতির হত্যার তদন্তের খবর, আবার কখনও মহল্লার মুসলিম মেয়েটির এক হিন্দু ছেলেকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ের গল্প, কথা চলতেই থাকল।
চাপকলে সিটি বাজল, ব্লেন্ডারে মসলা পিষল, ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল ঘর। মুরগির মাংস আসতে লাগল টেবিলে, খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল – মেহরুন রেঁধেছিল। আর সালমা ছোটাছুটি করে সবার সামনে খাবার পরিবেশন করছিল। মেহরুন একবারই বেরিয়েছিল রান্নাঘর থেকে, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। পেটপুরে খাওয়ার পরে, মুখে তাম্বুল গুঁজে, ভাইয়েরা রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হলো। যাওয়ার আগে, আমান এসে দাঁড়াল রান্নাঘরের কাছে। বলল, ‘অল্প বুদ্ধি খরচ করো, সামলে নাও সব। আমি আবার আসব আগামী সপ্তাহে। দুই-চারদিন এমন করবে, তারপর আবার ঠিক হয়ে যাবে।
তুমি দায়িত্ব নাও। অনেক মেয়েকেই তো কত দুঃখ সহ্য করতে হয় , নেশাখোর স্বামী, অত্যাচারী শাশুড়ি। আল্লাহর শুকরিয়া করো, তেমন কিছুর মধ্যে পড়নি। স্বামী একটু দায়িত্বজ্ঞানহীন, ব্যস, আর কী? তোমাকেই বুঝে নিতে হবে।’
ভাইয়েরা চলে গেল। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই ইনায়াতও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, যেন কোনো বাধা নেই। সালমা চেয়ে রইল মায়ের দিকে। তার মামারা মাকে কোনো সান্ত্বনা দেয়নি, কোনো সাহায্য করেনি। সে মায়ের দুঃখের ঢেউয়ে কেঁপে উঠল।
চলবে...