অনূদিত গল্প
Published : 05 May 2025, 11:16 AM
কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাক। তার প্রথম ইংরেজি অনুবাদবই ‘হার্ট ল্যাম্প: সিলেক্টেড স্টোরিজ’ ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দীপা ভাস্তির অনুবাদে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে ১২টি ছোটগল্প, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনসংগ্রাম, কষ্ট আর আত্মমর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে।
বানুর গল্পে নারী শুধু নিপীড়িত নয়—প্রতিবাদী, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলের ভেতর থেকেও নারীরা কীভাবে নিজেদের শক্তি খুঁজে পায়, সেটাই তার লেখার মূল বিষয়। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পে এক স্বামীর অন্যত্র বিয়ের পর মেয়ের চোখে উঠে আসে মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা। সরল ভাষায় লেখা হলেও বানুর গল্পগুলো গভীর আবেগ ছুঁয়ে যায়।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া বানু মুশতাক একজন আইনজীবী ও অধিকারকর্মী। তিনি কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৯) এবং পেন ইংলিশ ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড (২০২৪) পেয়েছেন।
মেহরুন দরজার আধফাঁকা পাল্লা কেবল ছুঁয়েছে, যেন নদীর জলে পা ডুবিয়ে দেখা, ঠিক তখনই ঘরটা থমকে গেল। সময়টা হঠাৎ ঘুম ভেঙে চমকে উঠল। ড্রইংরুমে দেবদারু কাঠের খাটে আধশোয়া বাবা, আর পাশে বসে গম্ভীর স্বরে কথাবার্তা বলা বড় ভাই, দু’জনেই একসঙ্গে নীরব হয়ে তাকাল তার দিকে। ঘরের ভেতর থেকে বাতাস ছেদ করে ছোট্ট রাবিয়া ছুটে এলো, যেন শালিক পাখি ডানা ঝাপটে ঘোষণা দিল, ‘মেহরুন ফুপি এসেছে! মেহরুন ফুপি এসেছে!’ আর ঠিক তখনই আমান ভাই, গালে ঝকঝকে শেভিং ফেনা, হাতে বুরুশ, দাঁড়িয়ে পড়ল ড্রইংরুমে, চোখে এমন বিস্ময়, যেন মৃত্যুর পর কেউ জীবন্ত ফিরে এসেছে।
সবচেয়ে বড় ভাই আতিক, যার কণ্ঠে কুরআনের আয়াত এক একটা ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছিল, তিনিও এলেন। চোখে বিস্ময়ের ধাক্কা, সেরাগুলের আঁচল অজান্তেই কাঁধ থেকে খসে পড়ছে, তবু খেয়াল নেই। মা, যিনি একদিন এই মেয়েকে গর্ভে রেখেছিলেন, দুনিয়ার সব যন্ত্রণায় রক্ষা করে বড় করেছিলেন, তার হাতের তসবিহর দানাগুলো থমকে গেছে। চোখে জিজ্ঞাসা, ‘এ কি স্বপ্ন? তুই কি সত্যিই ফিরেছিস?’ কিন্তু তার মুখে নেই সেই চেনা স্নেহভরা আহ্বান, ‘আয় মা, আয়।’
রেহানা আর সাবিহা, রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, তাদের চোখে ভয়, বিস্ময়, কৌতূহল, এ যেন বহু পুরনো কোনো কুয়াশাচ্ছন্ন গল্প হঠাৎ চোখের সামনে ধরা দিয়েছে। রুটি তখন তাওয়ার উপর পুড়ে যাচ্ছে, তবু কারো মনে নেই। যেন সংসারচক্রটা ক্ষণিকের জন্য ঘুরতে ভুলে গেছে। কেবল আতিফ ছিল না, এটাই স্বস্তির মতো।
মেহরুনের মনে হলো, এই বাড়িটা তার পরিচিত, তবু যেন কোথাও অচেনা। এই দেওয়াল, এই জানালা, এই দরজার হাতল, সব আছে, তবু কোথাও নেই। এই সেই মা, যিনি তার কপালে চুমু দিয়ে বলতেন, ‘তুই আমার চোখের তারা।’ সেই বাবা, যার বুকের উপর উঠে সে বলত, ‘আমার রাজত্ব শুরু এখান থেকে।’ সেই ভাইয়েরা, যারা তার মুখ দেখে ঈদেও আনন্দ করত, তার কলেজে যাওয়া নিয়ে লড়ত, তারা আজ যেন তাকে দেখেও দেখছে না। ভাবীদের চোখে এমন শীতলতা, যেন সে বহু দূরের কোনো গ্রহ থেকে হঠাৎ নেমে এসেছে। ঘরটা দাঁড়িয়ে রইল নিঃশব্দে, বাতাস থেমে গেল, আলো নিঃশব্দে বদলে গেল তার রঙ।
মেহরুনের বুকের ভেতরটা যেন ধসে পড়ল। তার কোলে থাকা ন’মাসের শিশুকন্যাটি চিৎকার করে উঠতেই ঘরের সবাই হতবিহ্বল অবস্থা থেকে সাড়া দিল। বড় ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
‘ইনায়াত কোথায়?’
মেহরুন মাথা নিচু করল, যেন কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। ধরা গলায় বলল,
‘শহরে নেই।’
‘তবে কার সঙ্গে এসেছ?’
‘একাই এসেছি।’
‘একাই?’
চারদিক থেকে একসঙ্গে বিস্ময়ের আওয়াজ উঠল। মেহরুন চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল।
বড় ভাই আদেশ দিলেন, ‘ফারুক, ওকে ভেতরে নিয়ে যা।’
আদেশের পর, ভারী ও ক্লান্ত পায়ে মেহরুন ভেতরে এলো। মনে হচ্ছে কোনো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে সে। শিশুটি আবার কান্নায় ফেটে পড়ল। বোরখা সরিয়ে, নেকাব উঁচিয়ে, বাবার খাটের এক পাশে কাত হয়ে বসে শিশুটির মুখে দুধের স্তন চেপে ধরল মেহরুন। মুখ ধোয়ারও সময় পায়নি। পেটটা জ্বলছিল ক্ষুধায়, গত রাতের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। ঘরে শুধু মা, অন্য কোনো নারী এই বৈঠকে থাকতে পারবে না। বড় ভাই আবার প্রশ্ন করলেন,
‘মেহর, কাউকে জানিয়ে এসেছিলি?’
‘না।’
‘কেন? কেন বলিসনি কাউকে? মনে হচ্ছে, আমাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে তোর আর বাকি নেই।’
মেহরুন ফুঁসে উঠল নিভৃত স্বরে, ‘কাকে জানাতাম? কে আছে সেখানে? সপ্তাহ হয়ে গেল, সে ফিরেও আসেনি, না জানিয়ে কোথায় যে গেল! আমি চিঠি লিখেছিলাম তোমাদের, তোমরা তো কোনো জবাবই দাওনি। আমি মরেছি কি বেঁচেছি, তোমাদের কিছু যায় আসে না!’
‘তুই চিঠিতে লিখেছিলি তোর স্বামী নাকি কোনো নার্সের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। আমরা তা বিশ্বাস করব?’
মেহরুন মুখ তুলল, চোখে একরাশ জ্বালা।
‘বিশ্বাস না হলে এসে খোঁজ নিতেন! যারা ওদের একসঙ্গে দেখেছে, তাদের জিজ্ঞেস করতেন!’
বড় ভাই হুঁশিয়ার স্বরে বললেন, ‘ধরা যাক, এসে দেখে এলাম, ধরেও নিলাম। যদি সে বলে, হ্যাঁ, ঠিকই তো করেছি, তবে আমরা কী করতে পারি? মসজিদে দরখাস্ত দেব? সে বলবে, ভুল হয়েছে, মেয়েটাকে মুসলমান করে নিকাহ করে নেব। তখন সে তো তোর সতিন হয়ে যাবে। আর যদি তাকে আরও বকাঝকা করি, যদি সে সোজাসুজি বলে, আমি মেহরুনকে চাই না, তাকে তালাক দেব, তখন?’
এতক্ষণে মেহরুন কান্নায় ভেঙে পড়ল। শিশুটিকে অন্য স্তনে স্থানান্তর করে, বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বোরখার নিচে থেকে সারাগো টেনে বের করল, চোখ-মুখ মুছল। ঘরের ভেতর মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।
সে কথা বলল, স্বর যেন আগুনে পোড়া, ‘মানে, তোমরা কেউ কিছুই করতে পারবে না, তাই তো?’
কেউ কোনো উত্তর দিল না।
সে আবার শুরু করল, ‘আমি হাতজোড় করে বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে দিও না। শুনেছিলে? বলেছিলাম, বোরখা পরে কলেজে যাব, পড়াশোনা শেষ করতে দাও। কান দিয়েছিলে? আমার অনেক সহপাঠী এখনও বিয়ে করেনি, অথচ আমাকে তো বুড়ি করে ফেললে। পাঁচটা সন্তানের বোঝা কাঁধে চাপিয়ে দিলে। আর যার কাঁধে এই সংসার টানার কথা, সে আজ পথে পথে ঘুরছে। আমি নেই, আমার কোনো জীবন নেই। এক পুরুষ যখন এ রকম হারাম কাজ করে বেড়ায়, তোমরা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতেও পারো না কেন?’
মা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন, যেন দুঃখের ভার সহ্য করতে পারছেন না।
‘হ্যাঁ আম্মা, আমারও আর সহ্য হয় না।’ কণ্ঠে বিষাদের ধার। ‘শুরুতে লোকে কিসসা-কাহিনি করত, তারপর যারা নিজের চোখে দেখেছে, থিয়েটারে, হোটেলে ঢুকতে, তারা এসে আমাকে বলে গেছে। তারপর সে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠল যে সরাসরি তার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল। সবাই যখন মুখ খুলে কিছু বলল, তখন সে বেঙ্গালুরু চলে গেল, হাজার হাজার টাকা খরচ করে সেই মেয়েটার বদলির ব্যবস্থা করল। আট দিন ধরে সে ওই মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে আছে। আর কতদিন সহ্য করব বলো? আমি কীভাবে বাঁচব?’
মা শান্ত গলায় বললেন, ‘ধৈর্য ধর, মা। ভালোবাসা দিয়ে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর।’ মেহরুন কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আম্মা, আমারও তো একটা হৃদয় আছে, না? আমারও তো অনুভূতি আছে! যে মানুষ আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেছে, তার প্রতি আমি কীভাবে স্বামীসম্মান রাখি? ওকে দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। ভালোবাসা তো বহু দূরের কথা। তালাকের কথা ও বলুক আর না বলুক, আমি নিজেই আদায় করব। আমি আর সেই ঘরে ফিরব না।’ মা কেঁপে উঠলেন, ‘মেহর, এসব কী বলছিস? একটুখানি বেশি হয়ে গেল। সে তো পুরুষ, কাদায় পা ফেলেছে, ধুয়ে মুছে আবার ঘরে ফিরে আসবে। পুরুষের গায়ে কোনো দাগ চিরদিন থাকে না।’
মেহরুন উত্তর দেওয়ার আগেই আমান কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল, ‘দেখো তো, আমাদের সামনেই কেমন কথা বলছে! নিশ্চয়ই ওর সামনেও এভাবেই কথা বলেছে। তাই তো রাগ করে চলে গেছে।’ একটু থেমে নরম স্বরে বলল, ‘এই বাড়ির বউরা যদি এ রকম কথা শিখে নেয়, তাহলে তো ভালোই হবে, না?’ মেহরুনের দুঃখ মুহূর্তেই রূপ নিল রাগে, তারপর হতাশায়।
সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘অনেক ভালো কথা বলতে পারো, আন্না। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক। সত্যিই, আমি খারাপ মেয়ে। এখন বুঝতে পারছি নিজের দোষ। আমি বোরখা ছাড়া বাইরে বের হইনি। সে বলেছিল, বোরখা ফেলে দাও, নাভির নিচে শাড়ি পরে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াও। কিন্তু তোমরা তো আমাকে শিখিয়েছিলে মাথার উপর দিয়ে সারাগো টেনে শাড়ি ঢেকে রাখতে, আজও সেটা না থাকলে মনে হয় আমি নগ্ন।’
তোমরা আল্লাহর ভয় আমার ভেতর গেঁথে দিয়েছিলে। আমি তার কথা মেনে চলিনি, তাই সে এমন কাউকে খুঁজে নিয়েছে, যে তার ইশারায় নাচবে। আর আজ তোমরা সবাই ভয় পাচ্ছ, যদি সে আমায় ছেড়ে দেয়, তাহলে আমি তোমাদের বোঝা হয়ে যাব। এই জন্যই বলছ, সব সহ্য করতে। কিন্তু এখন আর সম্ভব না। ওই জীবন্ত নরকে পুড়ে মরার চেয়ে আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও মজুরের কাজ করব। তোমাদের ওপর একটা কণাও বোঝা হয়ে থাকব না, একটুকুও না।’
চলবে...