Published : 05 May 2025, 05:29 PM
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড শীর্ষস্থান দখল করেছে টানা আটবার।
‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’-এর তালিকায় প্রথম স্থান দখলের পেছনে ফিনিশদের জীবনের কিছু সহজ তবে গভীর অর্থবহ অভ্যাস রয়েছে।
দেশটির পর্যটন বোর্ড ‘বিজনেস ফিনল্যান্ড’ পরিচালিত ‘ফিনিশ মাস্টারক্লাস ইন হ্যাপিনেস’য়ের মাধ্যমে এই অভ্যাসগুলো বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণা বলছে, এগুলো শুধু ব্যক্তিগত সুখ নয় বরং মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের পথও দেখায়।
প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, নিয়মিত ‘সনা’ বা ভাপ ব্যবহার আর খাবারের সঙ্গে সুস্থতা ও সৃজনশীলতার সংযোগ- এই তিন অভ্যাসে পাল্টে যেতে পারে জীবন দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও অভ্যাসগুলো বেশ প্রাসঙ্গিক।
প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা
ফিনল্যান্ডের ৭৫ শতাংশ বনাঞ্চলে ঢাকা। রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই জানালেন ‘বিজনেস ফিনল্যান্ড’-এর জনসংযোগ ও গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক সারি হেই ।
তার ভাষায়, “প্রতিটি ফিনিশ নাগরিকের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রাখা জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বৃষ্টি হোক, বরফ হোক, মানুষ প্রকৃতিতে যেতেই অভ্যস্ত।”
বিশ্বের নানান গবেষণাও এর পক্ষে কথা বলছে।
জার্মানির ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর হিউম্যান কগনিটিভ অ্যান্ড ব্রেইন সায়েন্সেস’–এর ২০১৭ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, যারা বনাঞ্চলের পাশে বাস করেন, তাদের ‘অ্যামিগডালা’ (মস্তিষ্কের একাংশ যা আবেগ ও চাপ নিয়ন্ত্রণ করে) বেশি কার্যকর থাকে। এর মানে, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি স্থির, আবেগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম ও কম চাপযুক্ত।
এমনকি ১০ থেকে ৩০ মিনিট প্রকৃতিতে হাঁটলেও হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ কমে, যা মানসিক চাপ হ্রাসে সহায়ক।
ঢাকা শহরের একটু বাইরে গেলেই সবুজ প্রকৃতি পাওয়া সম্ভব। তবে যারা ঢাকা শহরেই থাকেন তারা যে কয়েকটি সবুজ গাছে ঘেরা পার্ক রয়েছে নিয়মিত সেখানে হাঁটাহাঁটি বা সময় কাটাতে যেতে পারেন।
প্রতিদিন সকালে রমনা পার্ক, শিশুপার্ক বা ধানমণ্ডি লেকের মতো জায়গায় অন্তত ১৫ মিনিট হাঁটলেও কিছুটা উপকার মিলবে।
গরম বাষ্প বা সনার গুরুত্ব- গা গরমের বাইরেও অনেক কিছু
ফিনিশ সংস্কৃতিতে ‘সনা’ শুধুমাত্র শরীর গরম রাখার উপায় নয় বরং এটা এক ধরনের মেডিটেটিভ রুটিন।
দেশটির প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ব্যক্তিগত ‘সনা’ আছে, আর পাবলিক ‘সনা’গুলোর বেশিরভাগই পানিতে ডুব দেওয়ার সুযোগসহ থাকে।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক ‘ইউনিভার্সিটি অব ইভাস্কালা’ ২০১৯ সালের এক গবেষণা প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, ৪৮২ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৮৪ শতাংশ বলেছে, ‘সনা’ নেওয়ার পর তাদের ঘুমের মান অনেক বেড়েছে।
‘ব্রিটিশ জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিন’-এ প্রকাশিত আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘সনা’র মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে, স্মৃতিশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
‘সনা’ নেওয়ার সময় গরম বাষ্প ত্বকের ছিদ্র খুলে দেয়, ঘাম ঝরায় এবং প্রশান্ত করে। এরপর ঠাণ্ডা পানিতে ডুব দিলে রক্তসঞ্চালন বাড়ে ও শরীর তরতাজা হয়।
বাংলাদেশে ‘সনা’ খুব পরিচিত না হলেও ‘ভাপ নেওয়া’, ‘স্টিম বাথ’ কিংবা কুসুম গরম পানিতে শরীর ডুবিয়ে রাখার রীতি কিছুটা আছে।
তাই এই অভ্যাসকে নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল রুটিনে পরিণত করা যেতে পারে। শহরের কিছু ব্যায়ামাগার, স্পা ও হোটেলে স্টিম রুম বা ‘সনা’ সুবিধা পাওয়া যায়।
এছাড়া বাড়িতেও কুসুম গরম পানিতে পা ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে এক ধরনের মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি পাওয়া সম্ভব।
খাবার ও সুস্থতার সংযোগ
ফিনিশদের কাছে রান্না শুধুই পেট ভরানোর ব্যাপার নয়। বরং এটা তাদের কাছে আনন্দ, সৃজনশীলতা ও সংযোগের একটি উৎস।
সারি হেই বলেন, “ফিনিশরা খাবার তৈরি করে মৌসুমি সবজি, বুনো হার্বস বা স্থানীয় মাছ ব্যবহার করে। নতুন কিছু চেষ্টা করাই তাদের সংস্কৃতির অংশ।”
রান্নার সময় ধীরে ধীরে সব উপকরণ মেশানো, হাত দিয়ে কিছু তৈরি করা এসবই এক ধরনের ‘মাইন্ডফুলনেস’ (মনোসংযোগ, সচেতন উপস্থিতি, বা সতর্ক সচেতনতা)।”
যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেল্থ’-এর পুষ্টি বিভাগের গবেষক ড. ফ্রাঙ্ক হু বলেন, “রান্নার সময় মনোযোগ দিয়ে করা, টাটকা উপাদান ব্যবহার এবং পরিবারের সঙ্গে খাওয়া এসব অভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।”
ফিনল্যান্ড ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত পার্থক্য রয়েছে, তবুও সুখী জীবনের জন্য কিছু অভ্যাস সার্বজনীন।
ঢাকা শহরের মানুষ যেভাবে কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠে, তাদের জন্য প্রতিদিন কিছু সময় প্রকৃতিতে কাটানো বা ছাদে গাছের সঙ্গে সময় কাটানো খুবই কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনরা যদি ‘জিমে’ যাওয়ার পাশাপাশি বাষ্প বা স্টিম রুম ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে, তা ঘুম ও মানসিক প্রশান্তিতে ভূমিকা রাখবে।
আবার রান্নায় নতুনত্ব আনতে বাজার থেকে মৌসুমি ফল-মূল কিনে তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মজার কিছু তৈরি করাই হতে পারে একদিনের ‘ফিনিশ’ অভিজ্ঞতা।
ফিনল্যান্ডের এই তিন অভ্যাস প্রকৃতি, ‘সনা’ ও রান্না- যে কেউ সহজেই নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন। আর এতেই হয়ত একটু বেশি সুখ, আরাম ও মানসিক শান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন